যা-ই হোক! আপাতত উনার রহস্য আর আমার রহস্য একই। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে অ্যাডভোকেট সাহেবের ব্যাপারেও মুখ বন্ধ রাখতে লাগবে। তামান্না নিজের বোনের হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে চায়, ঠিক আছে। কিন্তু সেটার জন্য আমার যেন ক্ষতি না হয়, সে ব্যাপারও মাথায় রয়েছে। ডিটেকটিভ নিজামের সামনে এখন উভয় মানুষই মিথ্যার পর মিথ্যা বলেই যাচ্ছে। আসল খেলা শুরু হবে উনার যাওয়ার পর।
এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে অবশেষে ফোন খুঁজে পেলাম। ফোন নিয়ে এসে উনার হাতে দেওয়াতে; নিজে ব্যস্ত ডিটেকটিভ নিজামের ফোন নাম্বার নোট করতে, আর আমাকে ব্যস্ত করে দিলেন সবার জন্য নুডলস রান্না করে আনতে। রান্নাঘরে গিয়ে দেখি নুডলস তৈরির যথাযথ সামগ্রী নেই, তাই বাজার থেকে সব কিনে নিয়ে এলাম। আমাকে বাজার নিয়ে বাসায় প্রবেশ করতে দেখে, তামান্না পেছন থেকে এসে, আমার ডান হাত থেকে সামগ্রী নিয়ে, আমার সঙ্গে রান্নাঘরে চলে এলো। অনেক মানা করছিলাম তার সাহায্যের জন্য, তবুও নাছোড়বান্দা মেয়েটা আমার সাহায্য করবেই।
আমি নুডলস তৈরির জন্য চুলোয় পানি চড়িয়ে, পানি গরম হওয়া পর্যন্ত সবজি কাটতে লাগলাম। পাশ দিয়ে তামান্না এসে, আরেকটা ছুরি নিয়ে, আমার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সবজি কাটতে লাগল। আমি অনেক অনুরোধ করছিলাম, আমার সাহায্য না করতে, তবুও মেয়েটা তো সেই নাছোড়বান্দা।
চুলোর পাশে দাঁড়িয়ে, এভাবে সবজি কাটতে কাটতে আমাদের দুজনেরই ঘাম ছুটে গেল। শুধু চুলোর তাপের দোষ দিলে চলবে না। আবহাওয়ার অবস্থাও বেশ উত্তপ্ত ছিল। পানি যথেষ্ট গরম হওয়ায় সবজির টুকরোগুলো পানিতে ঢেলে দিলাম। এই ফাঁকে তামান্না এক গ্লাস পানি পান করল। সে সময়ে আমার হাত ব্যস্ত ছিল ছুরি দিয়ে পেঁয়াজ কাটাতে, কিন্তু আমার চোখ ছিল তামান্নার উপর। তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে ছিলাম না। মুখ সামনের দিকে রেখে, চোখের ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। পানি খাওয়ার জন্য যেভাবে পিঠ বেঁকিয়ে, উপরের দিকে তাকিয়ে, চোখ বন্ধ রেখে প্রত্যেকটা ঢোক গিলছিল, তার উপর থেকে চোখ সরানো বড় একটা কঠিন কাজ হয়ে গিয়েছিল। তার ঠোঁটের সঙ্গে গ্লাসের স্পর্শ দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। প্রতি ঢোক গেলার সময় গলার কম্পন আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। পানি পান করার শেষে এক ফোঁটা পানি তার ঠোঁট থেকে শুরু করে, ঘাড়ের পথ ধরে, অতি ধীরগতিতে, পিছলিয়ে নেমেই চলছিল। সেই ফোঁটার ধীরগতি দেখে আমার হৃৎপিণ্ডের গতি আকাশ ছুঁয়ে ফেলছিল। এমতাবস্থায় তামান্না সেই ফোঁটা বুকে পৌছানোর আগেই নিজের ওড়না দিয়ে মুছে ফেলল, আর এক হিসেবে আমাকে একটা হার্ট স্ট্রোক থেকেও বাঁচিয়ে দিল। কিন্তু স্ট্রোক করা হতে বেঁচে গেলে কি হবে? আসল কান্ড তো ঘটেই গেল! এই অতুলনীয় দৃশ্য দেখতে গিয়ে, আমার খেয়াল উঠে পড়েছিল ছুরি এবং পেঁয়াজ থেকে। ছুরি লেগে হাত কেটে গেল। কাটা স্থান থেকে রক্ত বের হচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে; তামান্না সঙ্গে সঙ্গে আমার হাতটা ধরে, কাটা ঘায়ে মুখ দিয়ে দিল। তার ঠোঁটের স্পর্শ আমার হাতে। আহ্! কি দারুণ একটা অতুলনীয় অনুভূতি। এমন অনুভূতির জন্য কি না করতে পারি! তবে মুহূর্তটা ছিল অতি ক্ষণস্থায়ী। নিজের মুখ থেকে বের করে, বেসিনের পানি ছেড়ে, আমার হাত পানির নিচে রেখে, আমার জন্য বরফ আনতে গেল। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, বড়সড় কোনো ঘটনা ঘটে গিয়েছে। উনার চেহারায় এমন অস্থিরতা দেখে, উনার চোখে এমন দরদ দেখে, উনার কন্ঠে এমন অসহায়তা শুনে, মনে হচ্ছিল যেন ব্যথা আমার নয় বরং তার নিজের হাতে পেয়েছে।
আমার প্রাথমিক চিকিৎসা করার সময়েও তাকে বলছিলাম, এমন করার কোনো প্রয়োজন নেই।
তাকে জিজ্ঞাস করলাম, "আপনি আমাদের অতিথি। অতিথিদের দিয়ে কি কাজ করানো চলে, বলেন?"
কিন্তু আমার এই প্রশ্নের উত্তর সে খুবই মিষ্টি সুরে দিল, "আপনি মনে ভুলে যাচ্ছেন, আপনিও এখানে একজন অতিথি যে আমারই সঙ্গে এসেছে। আপনি চিরকালের জন্য এখান থেকে চলে গিয়েছিলেন। একমাত্র আমার অনুরোধেই আপনার এখানে ফিরে আসা। তাই এই মুহূর্তে যদি আমি অতিথি হয়ে থাকি, তাহলে আপনিও একজন অতিথি।" বলে হেসে দিল।
আমি তখন সুযোগ করে বললাম, "আচ্ছা, আপনি অ্যাডভোকেট সাহেবের সঙ্গে ট্রেনের গুন্ডাদের প্রসঙ্গে কিছু বলবেন না।"
"কেন? বললে কি হবে? উনিই তো তাদেরকে পাঠিয়েছিলেন। তাহলে উনার কাছ থেকে গোপন রেখে কি লাভ?"
"কথা লাভের চেয়ে বেশি লোকসানের। একটু বোঝার চেষ্টা করুন। অ্যাডভোকেট সাহেব তো আপনাকে চিনতে পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। আর আপনিও উনার কাছে শুধু একটা কেস নিয়ে কথা বলতে এসেছেন। এখানে ডিটেকটিভ নিজাম এসবের মাঝে একজন সাক্ষী হয়ে রয়েছে। আমরা অ্যাডভোকেট সাহেবকে ধরা খাওয়ানোর চেষ্টা করলে, নিজেও ধরা খেয়ে যাবো। সেজন্যই বলছি, এ প্রসঙ্গে কথা ওঠানোর দরকারই নেই।"
"হুম... কথা ঠিক বলেছেন। তবে উনি আপনাকে এ প্রসঙ্গে কিছু জিজ্ঞাস করে থাকলে কি বলবেন?"
"বলে দিব, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সাক্ষাৎ হয়নি।"
"আর যদি জিজ্ঞাস করে, আমাকে কোথায় পেলেন?"
"বলে দিব, ইত্তেফাকের কারণে দুজন একই ট্রেনের, একই কম্পার্টমেন্টে বসে ছিলাম। সময় কাটাতে গিয়ে হালকা-পাতলা কথোপকথন হলো। তারপর আমার পরিচয় জানায় আপনি আমাকে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করে বসলেন।"
"ইত্তেফাকের কথা কি এতো সহজেই মেনে নিবে?"
"উনার কাছে আর কোনো উপায় নেই। কারণ ইত্তেফাকের মতো জিনিস রয়েছে বলেই এই শব্দটা ব্যবহার করতে পারবো।"
"ঠিক আছে। তাহলে উনার সামনে ট্রেনে ঘটা কোনো ঘটনা তুলবো না।" এ বলে তামান্না আশ্বাস দিয়ে থাকলেও, আমি মনে মনে জানতাম অ্যাডভোকেট সাহেবের মাথায় শুধু এই একটা বিষয়ই ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলই নিজেদের মাঝে বিষয়টি গোপন রাখা।
অতঃপর নুডলস তৈরি হয়ে গেল আপ্যায়নের জন্য। আমি এবং তামান্না একসঙ্গে, ট্রেতে করে নুডলস নিয়ে গেলাম সবার জন্য। ডিটেকটিভ নিজাম আমার হাতের ঘা দেখে জানতে চাইলেন কি করে কাটলো। সবজি কাটতে গিয়ে এই অবস্থা শুনে অ্যাডভোকেট সাহেব এক ঝাড়ি দিয়ে বললেন, "আরে বাবা, তুমি কানা নাকি? সবজি কাটার সময় মনোযোগ কথায় থাকা উচিত, বুঝ না?" ঝাড়ির শেষে কাছে ডেকে, ঘাটা দেখে কিছুক্ষণ আফসোস করলেন। করলেন বলতে কি, আফসোস করার ভাণ করলেন। দুনিয়ার যে কেউ এ দৃশ্য দেখে মনে করবে; ঠিক একটা বাবা যেভাবে সন্তানকে কষ্টে দেখে সইতে পারে না, ঠিক সেভাবেই উনার কলিজাটাও আমার জন্য ফেটে পড়ছে। কিন্তু আমি জানতাম এটা নিতান্তই একটা নাটক। সবার সামনে নিজের একটা সুন্দর চিত্র আঁকার এক সুবর্ণ সুযোগ। তাছাড়া আর কিছুই না।
এই নাটকের শেষে আরো কিছু গল্প হলো। গল্পে গল্পে জানতে পেলাম; পুরান ঢাকার শ্রেষ্ঠ গর্ব মোট তিনজন। তার মধ্যে দুজন এখন একই ঘরে বসে গল্প করছেন। অ্যাডভোকেট সাব্বির ক্বারি এবং ডিটেকটিভ নিজামুল; এই দুটো নাম শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বে খ্যাতনামা। এমন প্রখ্যাত দুজন কিংবদন্তির মাঝে বসে ছিল আমার মতো অশিক্ষিত একজন চাকর।
প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো গল্প করার পর, বিকেল হবার কিছুক্ষণ আগেই ডিটেকটিভ নিজাম বিদায় নিলেন। বিদায় নেওয়ার সময় স্বয়ং আমি উনাকে ছেড়ে এলাম। ডিটেকটিভ নিজাম গাড়ি ওঠার সময় আমাকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বললেন।
উনি প্রথম জিজ্ঞাস করলেন, "আপনি কি তাকে পছন্দ করেন?"
আমি অবাক হয়ে তার উত্তরে বললাম, "জি, বুঝতে পারলাম না!"
"তামান্নাকে পছন্দ করেন আপনি?"
"হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?"
"আপনার চোখে স্পষ্ট দেখা দেয়।"
"এমন কি দেখলেন?"
"সেটা আপনি ভাল করেই জানেন। তবে একটা কথা আপনাকে জানিয়ে দিই।"
"কি?"
"মেয়েটাও আপনাকে পছন্দ করে।"
আমি লজ্জায় হেসে জিজ্ঞাস করলাম, "কি বলেন এসব? তার মতো সুন্দর, শিক্ষিত এবং গুণাগুণ সমৃদ্ধ মেয়ে সব ছেড়ে আমার মতো একজনকে পছন্দ করবে কেন?"
উনি এ কথার সামান্য হেসে বললেন, "শুনেন! একটা নাগিনের জন্য যতই নাগ থাকুক না কেন, একজন সাপেরা তার বিন বাজিয়ে ঠিকই বশ করে ফেলতে পারে। হতে পারে মেয়েটার জীবনেও আপনি এমন কোনো ধরনেরই প্রভাব ফেলতে পেরেছেন।"
"হ্যাঁ। বলতে গেলে তো সবই হতে পারে। ঠিক তেমনিই, যেমনি এ প্রসঙ্গে আপনার ধারণা ভুলও হতে পারে।"
এ শুনে শেষবারের মতো একটা মুচকি হেসে বিদায় নিলেন ডিটেকটিভ নিজাম। উনার গাড়িটা এভাবে যেতে দেখে মনে কিছুটা কষ্ট পাচ্ছিলাম। এমন একটা লোকের সঙ্গে আর কখনও দেখা হয় না হয়। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। এরপরও একবার আমাদের দেখা হয়েছিল। কিন্তু আমি কখনও স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারিনি, শেষ পর্যন্ত এমন একটা কারণে উনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে।
সেদিনের রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে, রাতের খাওয়া শেষের কিছুক্ষণ পর, অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে কিছু কথা বললেন। তামান্না তখন ঘুমোতে চলে গিয়েছিল, কারণ তার শরীর বেশি ক্লান্ত লাগছিল।
"এই রাফি, একটু শুনে যাও তো।" বলে ডাকলেন আমাকে।
"জি!" বলে উনার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
"মেয়েটার সঙ্গে দেখা হবার ঘটনাটা একটু তোমার মুখে শুনতে চাই।"
আমি তামান্নাকে যা কিছু বলতে বলে রেখেছিলাম, ঠিক সেটাই উনাকে বলে দিলাম। কিন্তু ঠিক এমন সময়ে এমন কিছু হলো, যা আমি কখনও কল্পনাও করতে পারিনি।
অ্যাডভোকেট সাহেব নিজ থেকেই গুন্ডা পাঠানোর প্রসঙ্গ তুললেন।
আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, "মেয়েটার পেছনে কিছু লোক ছিল নাকি?"
চমকে যাওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, "না তো! কেন?"
"যে লোকটা তার বোনকে হত্যা করেছে, সে আমার মক্কেল। সে আমাকে বলেছিল যে সে একটা মাতাল পতিতাকে হত্যা করে ফেলেছিল মদের নেশায়। এটা নাকি তার শত্রুদের ষড়যন্ত্র। তাই তার শত্রুরা নাকি এমন নকল একটা মামলা দিয়ে তার ধনসম্পত্তি হাতাতে চায়। তাই আমার কাছ থেকে আমার লোকদের নাম্বার চেয়েছিল, তাদের মাধ্যমে এই মেয়েকে খুঁজে বের করে, তার কাছে থাকা নকল প্রমাণগুলো মেটাতে। আমিও আমার লোকদের বলে রেখেছিলাম; আমার মক্কেল যেভাবে যা করতে বলে, সেটা সেভাবেই করতে। তাই জিজ্ঞাস করলাম, তার পেছনে সেই লোকদের পাঠিয়েছিল কি না। এমন কিছু দেখেছ কি?"
আমি উনার কথা শুনে পুরোপুরি হতবাক হয়ে গেলাম। পায়ের নিচ থেকে জমিন সরে গিয়েছিল আমার। আমি তখন একটু কৌশল করে জিজ্ঞাস করলাম, "আপনি যে এভাবে লোকটার কথায় এসে নিজের লোকের নাম্বার দিয়ে দিলেন, সে যদি তাদের মাধ্যমে তামান্নার ক্ষতি করে বসত?"
আমার প্রশ্ন শুনে ভুরুকুঁচকে জিজ্ঞাস করলেন, "এর অর্থ তার পেছনে লোক ছিল, তাই না?"
আমার প্রতি ধীরে ধীরে উনার মনে সন্দেহ জন্মাচ্ছিল। এই সন্দেহ এড়াতে বললাম, "হ্যাঁ, ছিল। সে অনেক কষ্টে তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে এলো। তবে আমি তাদের কাউকে দেখিনি।"
"না দেখে থাকলে, তাকে বিশ্বাস করতে গেলে কেন? এমনও তো হতে পারত যে সে মিথ্যে বলে, তোমাকে ব্যবহার করতে চাচ্ছে।" বলে এক ঝাড়ি দিলেন।
"কিন্তু আপনিই তো মাত্র এর সততা যাচাই করলেন। তাহলে তো সব ঠিকই আছে। তাছাড়া তামান্নার কাছে যথাযথ প্রমাণাদি রয়েছে।"
"সেগুলো যে আসল, সেটা কীভাবে বুঝলে?"
"আসল না হলে কি কেউ এতো কষ্ট করে তার জন্য নিজের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়?"
"হায়রে! এই যুক্তিতে কাজ করলে তো বলতে হবে; একটা চোরও যখন জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে, চুরি করে পালায়, তখন সে নিজের জিনিসপত্র নিয়েই পালায়। কি, ঠিক বললাম না?" বলে হেসে দিলেন।
এর পাল্টা জবাব কি দেয়া যায়; তা ভাবতে না ভাবতেই, উনি আরো বললেন, "আচ্ছা, যেটাই হোক! মেয়েটার প্রমাণাদি আমার দেখা হয়েছে, আর আমি বুঝতে পেরেছি, তার সকল প্রমাণ সত্য। আমি আমার সেই মক্কেলকে মানা করে দিয়ে, এই মেয়েটার কেস লড়ব, ঠিক আছে?"
একথা শুনে মুখে এক বিশাল মুচকি হাসি ফুটল। নিজের কানে শোনা কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি বেশি কিছু না বলে, শুধু তার এই সিদ্ধান্তের প্রতি সাধুবাদ জানিয়ে গেলাম।
তবে কথা শেষ হবার পর, যখন আমি রুম থেকে বের হচ্ছিলাম, তখন আমাকে উনি জিজ্ঞাস করলেন, "আচ্ছা, আমার লোকদের ফোন আজ সকাল থেকে বন্ধ আসছে। এ সম্বন্ধে কোন ধারণা আছে তোমার?"
আমি না-সূচক মাথা নেড়ে, নিজের মতো চলে গেলাম।
তার পরের সকালে নাশতা করার পর, অ্যাডভোকেট সাহেব বসে ছিলেন অফিসে, আর আমি কাপড় ধুয়ে, শুখাতে দিতে ছাদে গেলাম। এমতাবস্থায় তামান্না আমার পেছনে পেছনে ছাদে এসে পড়ল। ছাদে এসে আমাকে জিজ্ঞাস করলো, "গতকাল রাতে চিল্লানোর শব্দ শুনতে পেলাম। সবকিছু ঠিক আছে তো?"
"জি, ঠিক আছে। তার উপরে একটা সুসংবাদ আছে।"
"কেমন সুসংবাদ?"
"অ্যাডভোকেট সাহেব আপনার পক্ষে লড়তে রাজি আছেন।"
"হঠাৎ কীভাবে রাজি হলেন? উনি তো আমাকে মারতে গুন্ডা পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন। এতো সহজেই মেনে গেলেন! বিশ্বাস হচ্ছে না।"
"উনি আমাকে যা বলেছিলেন, আমি তা-ই বলছি। তবে শত চেষ্টার পরও গুন্ডাদের প্রসঙ্গে কিছু কথা বলতেই হলো। কিন্তু আমি উনাকে বলেছি; আপনার পেছনে কিছু লোক লেগে ছিল। আপনি তাদের থেকে পালিয়ে এসেছিলেন।"
"আচ্ছা, তাহলে এ ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাস করলে, আমি কি এটাই বলবো, নাকি আরেকটু কিছু বাড়িয়ে বলবো?"
"আমার মনে হয় না, উনি আপনাকে এ ব্যাপারে জেরা করতে যাবেন। কারণ তারা উনার লোক ছিল, একথা শুধু আমিই জানি। আপনাকে এমন কিছু জিজ্ঞাস করলে, আপনি উনার উপর সন্দেহ করতে পারেন। তাই আশা করি, আপনাকে ওদের ব্যাপারে কি জিজ্ঞাস করবেন না।"
"আর যদি কোনো কারণবশত জিজ্ঞাস করে বসেন?"
"তাহলে বেশি কিছু না; শুধু কেন জিজ্ঞাস করে, একবার সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন কিছুক্ষণের জন্য। এমন করলে উনি আর বেশি কিছু জিজ্ঞাস করবেন না।"
"আপনি সিওর তো?"
"জি, আমি এই গত কয়েকমাস ধরে, উনার বাসায় কাজ করে, উনার সম্বন্ধে ভাল করে জানতে পেরেছি। উনার চালাকির সম্বন্ধে আমার ভাল ধারণা আছে। আপনার টেনশন নেওয়ার কোনো বিষয় নেই।"
"আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি এতো দূর পর্যন্ত আসতে পেরেছি শুধুমাত্র আপনার সহযোগিতার কারণে।" এ বলার সঙ্গে সঙ্গে সে আমার হাত ধরে বসল, অতঃপর আরো বললো, "আমার পাশে থাকার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আশা করি কোনো একদিন আমিও আপনার পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবো।"
তার চোখের কোণ থেকে অশ্রুর ফোঁটা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। আশেপাশের ছাদের লোকেরা আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারা হয়ত মনে করছিল, আমরা দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা। তাই হাত সরিয়ে নিয়ে, চুপচাপ ছাদ থেকে নেমে পড়লাম। মেয়েটাকে কিছু না বলে, এভাবে নামা উচিত হয়নি। তবে আশেপাশের লোকে কি না কি ভাববে, তাই দ্রুত করে নেমে এলাম। তখন খেয়াল এলো; কীভাবে ট্রেনের মধ্যে তামান্নার উপর মেজাজ চড়ছিল, যখন সে আমাকে জিজ্ঞাস করেছিল, লোকে কি ভাববে। কিন্তু নিজের বেলায় আমি তত কিছু ভাবিনি। মনে এলো, তাই করে ফেললাম। দোষ কি আমার, নাকি আমার মনের? সেই মুহুর্তে যদি এ নিয়ে ভাবতে যেতাম, তাহলে সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। আর শেষমেশ যদি মনে হতো, এভাবে আসলেই হাত ধরে সবার সামনে দাঁড়ানো ঠিক হবে না, তাহলে তো নেমে পড়ারও অনেক দেরি হয়ে যেত। আমার বাবা বলতেন, "ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।"
কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ততক্ষণে না ভেবেই নেমে পড়াতে আরো উপকার হয়েছে। সময় বেঁচেছে অনেকটা। কিন্তু যতক্ষণ সেই নরম নরম হাত, আমার হাতকে সেভাবে ধরে রেখেছিল, ততক্ষণ মনে হচ্ছিল; এই স্পর্শে থেকে আমি সারাজীবন কাটাতে পারবো। যদি কোনো উপায় হতো তামান্নার ছোঁয়া আবার পাবার! যদি কোনো উপায় হতো আবার তার কাছে যাওয়ার! শুধু আবার নয়, বারবার সেই নরম ত্বকের স্পর্শ পেতে চাই। যদি এমন কোনো উপায় হতো তার সঙ্গে জীবনটা কাটানোর।
এমন বড় স্বপ্ন দেখেই জীবনটার বারোটা বাজিয়ে রেখেছি। আর কত? আর কত এমন স্বপ্ন দেখতে হবে, যা কখনও পূরণ করা সম্ভব না?
আমার সবচেয়ে বড় ভয় ছিল, আমি কি সত্যি সত্যি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম! আমি কি সত্যি সত্যি তাকে ভালবেসেছিলাম? কি এভাবে একদিনের মধ্যেই কাউকে ভালবেসে ফেলা আদৌ সম্ভব?
এ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট সাহেব একবার কিছু একটা বলেছিলেন।
উনি আমাকে জিজ্ঞাস করেছিলেন, "প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মধ্যে বিশ্বাস করো?"
সেসময় আমি উনার প্রশ্ন শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ থেমে উত্তর দিলাম, "না, করি না।"
"কেন করো না?"
"কারণ আমি কখনও প্রথম দেখায় কারো প্রেমে পড়িনি।"
"অন্য কাউকেও এভাবে প্রেমে পড়তে দেখনি?"
"জি, দেখেছি। কিন্তু আমি সেটাকে ভালবাসা নয়, বরং ভাললাগা মনে করি।"
"কি ভাললাগা ভালবাসারই অংশ নয়?"
"তা আছে। কিন্তু শুধু প্রথম দেখাতেই একজন সরাসরি ভালবেসে ফেলে কীভাবে?"
"যদি মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে বলি, তাহলে বলতে হবে; একজনের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের মাধ্যমে সময় কাটানোর ফলে মানসিকভাবে প্রভাবিত হওয়া যায়। এই প্রভাব পরবর্তীতে আকর্ষণ সৃষ্টি করে এবং সেটাই সময় যেতে যেতে, একসময় ভালবাসায় পরিণত হয়।"
"এই আকর্ষণকে কি ভালবাসা বলা যাবে? এটা শুধু স্বাভাবিক আকর্ষণও তো হতে পারে। স্বাভাবিক আকর্ষণ এবং ভালবাসার মধ্যে পার্থক্য বুঝব কীভাবে?"
উনি এর উত্তরে কোনো ব্যাখ্যায় না গিয়ে, শুধু মুচকি হেসে বললেন, "যেদিন নিজের সাথে হবে, সেদিন সবই বুঝতে পারবে।"
আজ আমি সেই প্রশ্ন নিজেকে করছি। আশা করি, এটা ভালবাসা নয়। কারণ যাকে ভালবাসা হয়, তাকে পাবার উপায় না থাকলে কষ্টের শেষ নেই। এসব ভাবতে ভাবতে দুপুরের কাজ সম্পন্ন হলো।
সেদিন বিকেলের দিকে অ্যাডভোকেট সাহেব তামান্নাকে ডাকলেন অফিস রুমে। সেখানে তাকে বললেন, কিছুদিন থেকে, কেসের জন্য যথাযথ প্রয়োজনীয় সকল তথ্য দিয়ে সাহায্য করার পর বাড়ি ফিরতে। তামান্না এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। অতঃপর তার বাসায় ফোন করে, তার অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিল অ্যাডভোকেট সাহেবের। এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে, এক আশার আলো দেখা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এবার অ্যাডভোকেট সাহেব এই কেস হাতে নিয়েছেন বলে এই কেস একমাত্র তামান্না জিতবে। সেদিন ছিল মাস শেষের তারিখের চারদিন আগের তারিখ। অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, "এই শুনো, কিছুদিন পর গাড়ির ফিটনেস চেক করাতে পাঠাতে হবে। ড্রাইভারকে গিয়ে বলো, পাশের গ্যারাজ থেকে সব চেক করে আনতে।"
"জি।" বলেই, গিয়ে ড্রাইভারের কাছে সব বুঝিয়ে এলাম। ড্রাইভার ঠিক সেভাবেই গিয়ে গাড়ির সবকিছু পরীক্ষা করে আনল। তবে ড্রাইভার এসে বলছিল, পুরাতন ব্রেক নষ্ট হয়ে যাবার কারণে নাকি নতুন ব্রেক লাগাতে হবে। যার কারণে গাড়িটার ফিটনেস আপাতত একটু খারাপ অবস্থায় আছে। পরবর্তীতে নতুন ব্রেক লাগানোর জন্য টাকা নিয়ে যেতে বললেন অ্যাডভোকেট সাহেব। তখনকার সময়ে বিষয়টা বেশ সামান্য মনে হয়েছিল। কিন্তু পরের দিন দেখলাম একটা খামে করে চেক পাঠালেন ড্রাইভারের হাতে। ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যের ছিল। কারণ অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছে বাসায় সবসময়ই নগদ টাকা থাকে। উনি প্রতি কেসের জন্য প্রতিনিয়ত যেই টাকা পেয়ে থাকেন, সেটা প্রতিনিয়ত ব্যাংকে জমা রাখার সুযোগ পান না। হঠাৎ করে নগদ টাকার এতই সংকট পরে গেল যে এখন চেক ব্যবহার করতে হচ্ছে! এত অদ্ভুত ব্যাপারটা চোখে ধরা পড়া সত্ত্বেও চোখ বন্ধ করেই মেনে নিয়েছিলাম। কারণ আমার জন্য অ্যাডভোকেট সাহেবের কাজের পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। মেজাজ প্রায়ই খিটখিটে থাকতো। এমতাবস্থায় এমন সব প্রশ্ন জিজ্ঞাস করে, উনাকে বিরক্ত করতে চাচ্ছিলাম না। উনার কাজের চাপ কিছুটা কমানোর জন্য তামান্নাও উনার অফিসের বাদবাকি কাজে সহায়তা করে দিচ্ছিল।
সকালে উঠে উভয়ের জন্য চা রেঁধে, কাচ্চা বিস্কুটের সঙ্গে, নিজের হাতে তাদের আপ্যায়ন করার মধ্যে এক আলাদা স্বাদ ছিল। আমি নিজের জন্য এক কাপ চা না বানালেও, তামান্না আমায় কাছে ডেকে নিয়ে, তার নিজ হাত দিয়ে চায়ে ডোবানো বিস্কুট খাওয়াত।
আমি প্রথমে খাওয়ার রুচি না থাকার ভাণ করতাম, এরপর এক মুচকি হেসে ঝটপট মেনে যেতাম। আমার এই ঢং দেখে সে কিছুক্ষণ হাসতো, পরে অনেক আদরের সঙ্গে সেই চায়ে ভেজা বিস্কুট আমার মুখে তুলে দিত।
এমন আনন্দময় সময় কাটতে কাটতে, অবশেষে এলো আলাদা হয়ে যাবার সময়। তামান্নার বাড়িতে ফেরার দিন তো আর কোনো কিছুতেই মন বসছিল না। সেদিন সকালের নাশতা থেকে শুরু করে, সারাদিনে ঠিকমতো এক গ্লাস পানিও পান করিনি। তৃষ্ণার্ত ছিলাম, কিন্তু পানির জন্য নয়, তার দেখা পাবার জন্য। তামান্না সেদিন সকাল থেকে ছিল কোর্টে। সেদিন সকালের চাও খেয়ে যায়নি। আমি সারাটা দিন অপেক্ষায় ছিলাম। সে দুপুরের শেষের দিকে ফেরত আসার পর জানা গেল, কথা বলারও তেমন একটা সময় নেই। এমনকী তারা আসার পথে, গাড়ির টায়ার ফেটে যাওয়ার কারণে, গাড়ি থেকে নেমে, সিএনজি করে আসতে হলো। এই অতিরিক্ত দেরির কারণে এখন দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলারও তেমন সুযোগ নেই। তামান্না গোসল করতে গেল, অতঃপর গাড়ি গ্যারাজ থেকে নতুন চাকা লাগিয়ে ফেরত এলো। অ্যাডভোকেট সাহেব ডেকে বললেন, "তুমি চাইলে তার সঙ্গে যেতে পারো। এখনও তোমার সুযোগ রয়েছে। টাকার ব্যাগ নিয়ে, তার সঙ্গে বাড়িতে চলে গেলে, তুমি আমার দাসত্ব করার থেকে বাঁচতে পারো। আমি কাজে রাখার জন্য নতুন কাউকে নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করে নেব।" এরপর আমার বাম হাতে, নিজের ডান হাতের দ্বারা হাত বুলোতে বুলোতে আরো বললেন, "আমার কারণে তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে, বাবা। তুমি এই সুযোগটা হাতছাড়া না করে, তামান্নার সঙ্গে চলেই যাও।"
আমি উনার কথাগুলো শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। আমার বিবেকে সেই দাসত্বের উক্তিটি বেঁধে গেল। আমি এমন একটা লোককে এই অবস্থায় রেখে কিভাবে যেতে পারি? আমি উনাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে দিলাম, "আমি নিজেকে কখনও আপনার দাস ভাবিনি। কারণ আপনি আমার এবং আমার পরিবারের জন্য যা কিছু করেছেন, তা তো আমি জীবনেও পরিশোধ করতে পারবো না। আর পরিশোধের চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের মাঝে বিদ্যমান সম্পর্ক। আমি ঐ আঠারো কোটি টাকার প্রতি আর লোভ রাখি না। আর সেটার দ্বারা নিজের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার মতো ইচ্ছেও আমার মধ্যে আর নেই। আমি এবং আপনি এখন অনেকাংশে পরস্পরের পরিপূরক। তাই এমন কাউকে রেখে চলে যাওয়া শুধু অমানুষিক না, বরং অযৌক্তিক এক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।"
এগুলো বলে শেষ করলাম, আর তামান্না পরিপাটি হয়ে এসে পড়ল। সেই ঠিক সেই জামাটাই পড়েছিল, যেটা আমাদের প্রথম দেখায় পরিধান করে ছিল। তাকে এমন অবস্থায় দেখে আমি সেখানেই মুগ্ধ অবস্থায় তাকিয়ে রইলাম। আমার চোখ তার মাথার চুল থেকে শুরু করে, তার পায়ের নখ পর্যন্ত প্রত্যেকটি অঙ্গের আনাচেকানাচে দেখেই যাচ্ছিল। তাকে এক ঝলক দেখেই আমার সারাটা দিনের তৃষ্ণা মিটে গেল। তার কাছে গিয়ে, তার হাত থেকে তার ব্যাগ নিয়ে বললাম, "দেন, আমি নিয়ে নামি।"
"না। না। ওত ভারি না।" বলে ব্যাগ তার হাতে ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করছিল।
তখনই এক মুচকি হেসে বললাম, "এই শেষবারের মতো কিছু করতে চাই। দয়া করে এতটুকু করবার সুযোগ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবেন না।"
এতে সে একটা পাল্টা মুচকি হেসে বললো, "ঠিক আছে। চলেন।"
নিচে নামার পর ড্রাইভারকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। খুব সম্ভবত আশেপাশের কোনো টংয়ের দোকানে ধূমপান করতে ব্যস্ত ছিল। এই সময়টুকু আমি আর তামান্না সেখানে পুরোপুরি একা দাঁড়িয়ে ছিলাম।
ঠিক এমতাবস্থায় সে আমাকে জিজ্ঞাস করে বসল, "আপনি আমাকে পছন্দ করেন?"
লজ্জার কারণে গাল দুটো লাল হয়ে গেল। মুখখানা লুকানোর চেষ্টা করে, মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "না তো! হঠাৎ কি জিজ্ঞাস করছেন এসব?"
"হঠাৎ করে না। অনেক ভেবেই বলছি।"
"কি ভাবলেন এমন?"
"আপনি আমার দিকে যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন যখন আমরা গাড়িতে ছিলাম। ডিটেকটিভ সাহেব যখন বিদায়ের কথা উল্লেখ করলেন, আপনার চেহারার রং নেমে গিয়েছিল। দুঃখ আপনার চেহারায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।"
"আজব তো! এতে দুঃখ পাওয়াটা কি এতটাই অস্বাভাবিক কিছু? একসঙ্গে এভাবে সময় কাটানোর পর কি কারো দুঃখ পাওয়ার কথা না? এর কারণ কি শুধু প্রেম হতে পারে? বন্ধুত্ব একটা কারণ হতে পারে না?"
"বন্ধু যখন মনেই করেন, তাহলে এতটাও বোঝেন না যে বন্ধুরা সবই বোঝে, বন্ধুর মনে কি চলছে না চলছে?"
এ কথাগুলো শুনে, মুচকি হেসে বললাম, "এগুলো তো সবাই বলে। তবুও তো বন্ধুদের মাঝেই তো ভুল বোঝাবুঝি হয়। আপনার ধারণাও তারই অন্তর্ভুক্ত।"
"ভুল বোঝাবুঝি যাতে না হয়, সেজন্যই আপনাকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাস করা।"
"যাক্! আশা করি উত্তর পেয়ে গিয়েছেন।"
"না। মোটেও পাইনি। আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এতক্ষণ নিজের প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আমার প্রশ্ন যেমন সরাসরি করা হয়েছিল, তার উত্তরও ঠিক তেমনিই সরাসরি চাই।"
"প্রশ্নটা ভিত্তিহীন। বাদ দিন। অন্য কথা বলি।" এ ছিল প্রশ্নটা এড়িয়ে চলার আমার ব্যর্থ চেষ্টা। কিন্তু সে ছিল নাছোড়বান্দা। উত্তর চাই তো চাই, তাও আবার মনমতো।
"উত্তরে তো শুধু হ্যাঁ বা না বলবেন, এতে এতো কষ্ট হবার তো কথা না।"
আমি মাটির দিকে তাকিয়ে নিম্ন স্বরে জিজ্ঞাস করলাম, "কষ্ট তো উত্তর দেওয়াতেই। হ্যাঁ এবং না হলো বাংলা ভাষার সবচেয়ে ছোট দুটো শব্দ, কিন্তু এর ভার ভীষণ মাপের।" এ বলতে বলতে মুঠো কষতে লাগলাম। যতো দুঃখ, যতো কষ্ট, সব ঐ মুঠোয় চেপে দিচ্ছিলাম। এমনটা করে কষ্টটা না কমলেও অন্তত আরেক কষ্টের দ্বারা নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায়। যেভাবে পাথর কাটে পাথরকে, তেমনি এই সামান্য কষ্টের মাধ্যমে বড় কষ্টটা দমিয়ে ফেলতে চাচ্ছিলাম। ঠিক এমন মুহূর্তে সে নিজেই বলে উঠল, "আপনি আমাকে পছন্দ করেন বা না করেন, আমি এই কিছু সময়ের মধ্যেই আপনার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। বহুদিন ধরে বলার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সাহস জোটাতে পারিনি। আজ বিদায়ের সময় সাহস করে বলেই ফেললাম। এরপর বাকিটা আপনার ইচ্ছা।" বলে লজ্জায় মুখ লুকোতে লাগল।
আমি তখন হতবাক অবস্থায় জিজ্ঞাস করলাম, "আপনি নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে মজা করছেন, তাই না?"
"না। মোটেও না। আমি আমার সঙ্গে বাকিটা জীবন কাটাতে চাই। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব।"
"আমার মতো নীচু শ্রেণীর একজন কাজের লোকের মধ্যে এমন কি দেখলেন?"
"আপনার মধ্যে আমি সুখ খুঁজে পাই। সেদিন যখন কষ্টে আপনাকে জড়িয়ে রয়ে ছিলাম, তখন আপনে আমাকে খুব সযত্নে ধরে রেখেছিলেন। এমন যত্ন আমি আজ পর্যন্ত কারো কাছে পাইনি। আপনার মনের বিশুদ্ধতা; আপনার দেহের সঙ্গে আমার সংস্পর্শ বাবদ কিছু করার চেষ্টা না করার মধ্যেই জানতে পেরেছি। আর আপনি সেদিন যেভাবে আমার জীবন বাঁচালেন, তা না বললেই নাই।"
"এসব কি জীবনে চলার জন্য যথেষ্ট, বলেন? আপনি একজন শিক্ষিত মেয়ে। একজন অশিক্ষিতের সঙ্গে সংসার করা কি আপনাকে মানাবে?"
"আপনি নিজেকে অশিক্ষিত হিসেবে দাবি করে ফেললেন, কিন্তু আমার প্রতি আপনার আচরণে আমি শুধু সুশিক্ষার উদাহরণ দেখতে পেয়েছি।"
"তা কিভাবে?"
"শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যগুলোর একটি হচ্ছে নৈতিকতা। আমাকে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে অসংখ্য ছেলে আমার সঙ্গে ভালবাসার নাটক করেছে। তারা প্রথমে ভালবাসার বড় বড় দাবি করে। পরবর্তীতে তারা তাদের সঙ্গে শোবার জন্য নিজের বিছানায় আসার আহ্বান দেয়। আমি মানা করলে, তারা আজেবাজে ভাষায় গালিগালাজ করে, নিজের মিথ্যে ভালবাসার প্রমাণ দিয়ে দেয়। আপনি চাইলেই আমাকে যেকোনো সময় স্পর্শ করার চেষ্টা করতে পারতেন। কিন্তু এমনটা না করে, আপনি নিজের নৈতিক শিক্ষার প্রমাণ দিয়েছেন।"
"ওসব ঠিক আছে। কিন্তু..."
"কিন্তু কি?"
"আপনি এতো অল্প সময়ে কিভাবে আমাকে ভালবেসে বসলেন?"
"কেন? ভালবাসার কি কোনো নির্দিষ্ট সময় আছে নাকি? আমি ভালবেসে বসেছি। এর চেয়ে বেশি আমার আর কিছুই বলার বা বোঝাবার নেই।"
আমি স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে, এক মুচকি হেসে বললাম, "জি, এটাই জানার বাকি ছিল। কারণ..."
"কারণ কি?"
"কারণ আমারও কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছিল, আমি আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি।"
একথা শুনে সে আনন্দে মেতে উঠল। আমার চোখে চোখ রেখে, আমার দু হাত একসঙ্গে ধরে, কাছে টেনে জিজ্ঞাস করল, "সত্যিই তো?"
আমি সরাসরি তার চোখে তাকিয়ে, মিষ্টি সুরে বললাম, "হ্যাঁ, সত্যি।"
এমন সুন্দর মুহূর্ত চলাকালীন সময়ে ড্রাইভার ফিরে এলো। এসে গাড়িতে বসেই বলা শুরু করল, "আরে ম্যাডাম, তাড়াতাড়ি চলেন, নাহলে দেরি হয়ে যাবে।"
"আচ্ছা, আসছি।" বলেই হাত ছেড়ে, গাড়িতে বসে পড়ল তামান্না।
সেই হাত ছাড়াটার যেই কষ্ট, তা সেই ভাল জানে যে কখনও তা অনুভব করেছে। গাড়ি যাওয়ার সময় পেছন থেকে তাকিয়ে রইলাম। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সেও গাড়ির কাঁচের ওপাশ থেকে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। আর এটাই ছিল তামান্নার সঙ্গে আমার জীবনের শেষ দেখা।
আমি বাসায় গিয়ে তাকে নিয়ে ভাবতে লাগলাম। হাতে ফোনটা নিয়ে, তার ফোন নাম্বার বের করে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। তার নামের বানানের প্রত্যেকটা অক্ষরে তার চেহারা দেখতে পেলাম। আমার মন খুশিতে এতটাই ডুবে গিয়েছিল, যে আমার তৃষ্ণার কথা আমি নিজেই ভুলে গিয়েছিলাম। শুধু তার নাম্বারের ওপর চোখ বুলিয়ে বুলিয়ে হেসেই যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে তার সঙ্গে ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে লাগলাম। কল্পনায় দেখি; আমাদের ছোটখাটো একটা বাসা। বাসায় শুধু আমরা এবং আমাদের দুই সন্তান। বাচ্চাদের ঘুমোনোর পর, তার সঙ্গে প্রতিটা রাত আড্ডা দেওয়া। প্রতিটা সকাল উঠে, বিছানায় তাকে পাশে পাওয়া। আমি বাজার নিয়ে আসার পর তার কাছে হিসাব দেওয়া। প্রতি বছর আমাদের বিয়ের বার্ষিকীতে দেশেবিদেশে ঘুরে ঘুরে হানিমুন পালন করা। বাসার ছাদে একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজা। তার সঙ্গে সুখদুঃখের সময় কাটাতে বৃদ্ধ বয়সে পা রাখা। পরস্পরের হাতে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে, মৃত্যুর অপেক্ষা করা। কিন্তু মৃত্যু সেসবের আগেই আমাদের দরজায় হাজির হলো।
এসব কল্পনার জগৎ থেকে বের হয়ে, পানি খেতে গেলাম রান্নাঘরে। পানির গ্লাস হাতে নেবার সঙ্গে অ্যাডভোকেট সাহেব উচ্চস্বরে ডাক দিয়ে উঠলেন।
তাদের রওনা দেওয়ার ঘণ্টাখানেক পর জানতে পেলাম হাড় কাঁপানো এক সংবাদ।
তামান্না যেই গাড়িতে ছিল, সেটা একটা ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। তামান্না এবং ড্রাইভার সহ আশেপাশের সাধারণ পথচারীও আহত হয়েছে। আমি এ সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে পড়লাম হাসপাতালে। তদন্ত চলছিল বলে, আমাকে অপারেশন থিয়েটারের ধারেকাছেও যেতে দেয়নি। আমি অসহায়তায় সেখানে বসেই কাঁদতে লাগলাম। অনেকক্ষণ পর ডাক্তার বের হয়ে বললো, গাড়ির ভেতরে যারা ছিল, তাদের কেউ বাঁচেনি।
সেই মুহূর্তে আমি গলা ফাটিয়ে এক চিৎকার দিলাম। আমার চিৎকারের গুঞ্জন গোটা হাসপাতালের সকলে শুনতে পেয়েছিল, কিন্তু আমি নিজে তা শুনতে পাচ্ছিলাম না। কারণ আমার কানে তখন শুধু তার মিষ্টি কন্ঠের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আর সেই কন্ঠের চিরনীরবতায় আমি স্বল্পকালের জন্য আমি বধির হয়ে পড়েছিলাম। শুধু তা নয়, বরং পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মন একটা মুহূর্তের জন্যও তা মানতে চাচ্ছিল না, আর আমার মস্তিষ্ক তা স্মরণ করানো বন্ধও করছিল না।
সেই হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে পড়ে রইলাম। দারোয়ানেরা আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল।
সেখানে মেঝেতে গড়াতে গড়াতে ছটফট করছিলাম। ডাক্তার সাহেব এসে, আমার অবস্থা দেখে বললেন, আমার চিকিৎসার দরকার আছে। আমার নিস্তেজ দেহটা তুলে, হাসপাতালের এক বিছানায় রাখা হলো। আমার দেহের ছটফট দেখে, আমাকে ইনজেকশন দিয়ে বেহুঁশ করে নেওয়া হয়। বেহুঁশ করার ইনজেকশন শরীরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে চোখে সবকিছু ঘোলাটে দেখতে লাগলাম। চোখ খোলার পর দেখি; সেই বিছানার পাশে বসে আছেন অ্যাডভোকেট সাহেব। আমি উঠতে নেব, এমতাবস্থায় দেখি, আমার হাতে স্যালাইনের টিউব লাগানো।
অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছে, ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে বললাম, "আমি না... অনেক ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নে দেখি; তামান্না নাকি আর... আমাদের... আমাদের মাঝে আর নেই...!" এরপর কান্নায় ভেঙে জিজ্ঞাস করলাম, "এটা শুধু স্বপ্নই ছিল না?"
অ্যাডভোকেট সাহেব নির্বাক আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কিছু না বলে, শুধু আমার কাঁধে হাতে বুলোচ্ছিলেন। আমি উনার এই প্রতিক্রিয়া দেখে মনে মনেই মরে গেলাম। আমার মধ্যে বেঁচে থাকার সকল ইচ্ছে সেখানে, সেই মুহূর্তে শেষ হয়ে গেল।
পরের দিন হাসপাতাল থেকে ফিরে আসলাম বাসায়। আসর আগে অনেক হাতেপায়ে ধরে অনুরোধ করলাম অন্তত তার মৃতদেহ একবার দেখার সুযোগের জন্য। কিন্তু পুলিশ তার মোটেও কোনো অনুমতি দিল না। আমি বাসায় এসে আগের মতই আবার কাজে লেগে পড়লাম। জগতের জন্য আমি বদলে গেলেও, জগৎ আমার জন্য একটা বিন্দুমাত্র বদলে যায়নি। আমাকে নিজের দায়িত্ব তো পালন করতেই হবে। যদিও অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে কিছুদিনের ছুটি নেওয়ার জন্য জোর করছিলেন, আমি তা মেনে নেইনি। আমি ভাবলাম; কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখলেই তাকে ভুলে যাওয়াটা আরো সহজ হয়ে পড়বে। কিন্তু শরীরের দ্বারা শরীর কাজ করাতে থাকলেই যে মন নিজের কাজ ভুলে যাবে, সেটা ছিল আমার এক ভ্রান্ত ধারণা। মনের কাজই হলো সেগুলো কথা বারবার স্মরণ করানো, যা মানুষ ভুলে যাবার চেষ্টায় রয়েছে। মনের এই কাজটা নিতান্তই স্বাভাবিক। কারণ মন হলো সেই অবুঝ শিশুর মতো, যাকে যত বেশিই মানা করা হোক, সে মানতে রাজি হয় না। অনেকের মন আবার বহুসময় পর কিছু শিখতে পায়। তখন মন সেই কথাগুলো আর চোখের সামনে তুলে ধরে না। আফসোস! আমার মন এতো ভদ্র নয়।
তাকে যতই বলি ভুলে যেতে, সে রেখে দিয়েছে সব নিজের মাঝে মাটি চেপে। বলার আর কিছুই নেই তাকে, সেও অসহায় হয়ে প্রেমে পেছনেই লেগে থাকে।
সময় আমার চলছে যতই খারাপ, আমার মনই আমার একমাত্র সঙ্গী হয়ে দাঁড়াক।
আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে শুধু একটাই কথা ভাবি, সবই কি শেষ হয়ে গিয়েছে নাকি রয়েছে আরো কিছু বাকি?
রাতে কিছু খাচ্ছিলাম না বলে অ্যাডভোকেট সাহেব জিজ্ঞাস করলেন, "কি ব্যাপার? খাবার রুচি নেই?"
"না, নেই।"
"তুমি খেলে যদি মেয়েটা ফিরে আসত, তাহলে আমি এখন তোমার সঙ্গেই না খেয়ে বসে থাকতাম। তোমার যেমন কষ্ট হচ্ছে, তেমনিই আমারও হচ্ছে। তা বলে কি এভাবে সবকিছু ছেড়ে বসে পড়লে চলবে?"
"দয়া করে আপনার কষ্টের সঙ্গে আমার কষ্ট তুলনা করবেন না। আমার মনের ভেতর এখন কি পরিমাণের কষ্ট হচ্ছে, তা আপনি আন্দাজ করতে পারবেন না।"
"আমরা দুজনই তার খুব আপন হয়ে গিয়েছিলাম। আমিও তার সঙ্গে যথেষ্ট সময় কাটিয়েছি। সে আমার মেয়ের মতো ছিল।"
"মতো! হুহ! কি ফালতু একটা শব্দ! আপনার মেয়ের মতো ছিল, এটার মানে আপনার আপন মেয়ে ছিল না। কোনো কিছু যদি অন্য কোনো কিছুর মতো হয়, তাহলে তো পার্থক্যটা সেখানেই হয়ে গেল। আপনার কাছে সে শুধু সে আপনার মেয়ের মতোই ছিল, কিন্তু আমার জন্য কোনো মতো ছিল না।" বলে চিৎকার করে উঠলাম। তারপর সেই উচ্চস্বরে আরো বললাম, "তাকে মনেপ্রাণে ভালবাসি আমি। সেই আমার, সে আমার প্রেমিকা ছিল। তাকে কি করে এতো সহজেই ভুলে যাই?"
অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে শান্ত করলেন। আমি সেই রাত উনার কাছে সমস্ত ঘটনা বললাম। কোনো কিছু গোপন রাখিনি। কারণ গোপন রাখার উদ্দেশ্যই আর ছিল না।
সপ্তাহখানেক যাওয়ার পর তদন্তের রিপোর্ট আসলো। রিপোর্টে জানা গেল, দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ব্রেক ফেইল হবার কারণে। এ ব্যাপারটা জেনে প্রথম প্রথম আমার এতো আশ্চর্যজনক লাগেনি। কিন্তু পরে মনে আসলো, গাড়িতে তো কিছুদিন আগেই নতুন ব্রেক লাগানো হয়েছিল। তখন আমি কিছুটা সন্দেহ করতে লাগলাম। বাজার আনার সময় আমি ফোন করলাম ডিটেকটিভ নিজামকে। উনাকে ফোনে সব বলার পর উনি এই মামলায় তদন্তের দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে নিলেন।
এদেশের পুলিশ সাধারণত এসব কাজে তেমন গুরুত্বপূর্ণ দেয় না। একটা সামান্য ব্রেক ফেইল হবার কথা জানাতেই এতো সময় লাগল। তাই তাদের উপর নির্ভর না করে, এমন কারো কাছে গেলাম যার কাজকে সে মনেপ্রাণে ভালবাসে এবং যে কোনোভাবেই সত্যকে খুঁজে বের করবে। ডিটেকটিভ নিজাম নিজের মতো তদন্ত চালিয়ে গেলেন এবং এদিকে দেখি অ্যাডভোকেট সাহেব তামান্নার বোনের কেস অন্য এক উকিলের হাতে দিয়ে দিলেন। কারণ জানতে চাইলে অজুহাত দিলেন, উনার কাছে কেসটা লড়ার কোনো ইচ্ছে নাই। কারণ এই কেসটার ব্যাপারে চিন্তা করলেই নাকি উনার তামান্নার কথা মনে পড়ে যায়।
প্রথম প্রথমে একথা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হলেও, সন্দেহ তখন হলো যখন জানতে পেলাম এই নতুন উকিল একেবারেই কাঁচা। লোকটা এই পেশায় আসার দুদিনও হয়নি। এমনকী এটাই ছিল তার প্রথম কেস। আমি অ্যাডভোকেট সাহেবকে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে উনি বলেন, লোকটা তার অধীনেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তার ওপর নাকি উনার যথাযথ বিশ্বাস আছে।
এমন সামান্য কিছু অজুহাত দেখে আমার সন্দেহের মাত্রা ধীরে ধীরে বেড়েই গেল। আমি প্রতিনিয়ত এ ব্যাপারে ডিটেকটিভ নিজামকে জানাতে থাকলাম।
একদিন উনি আমাকে বাজারে ডেকে একটা ছোট মাইক্রোফোন দিয়ে বললেন, "আপনি এটা কোনো এক সময় করে উনার ডেস্কের নিচে লাগিয়ে দিবেন। আমি আমার এক জুনিয়র অফিসারকে দায়িত্ব দিলাম এই বাসার নীচে দাড়িয়ে থেকে সবকিছু শুনতে। আর আপনাকেও একটা দায়িত্ব দিতে চাই। আপনার যেসব বিষয় নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে, সেসব নিয়ে উনার কাছে প্রশ্ন করেই যাবেন। সারাদিনে যখনই উনাকে সেই ডেস্কে বসা দেখবেন, তখনই গিয়ে এসব প্রশ্ন করে বিরক্ত করে ফেলবেন।"
ডিটেকটিভ নিজামের কথা অনুসারে আমি দিনের পর দিন অ্যাডভোকেট সাহেবকে এ নিয়ে বিরক্ত করতে লাগলাম। প্রত্যেক বার আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতেন, নাহলে একই অজুহাত দিয়ে কথা শেষ করে দিতেন।
বহুদিন গেল এমন। এর মাঝে এক রাতে, অন্ধকারে চোখ খোলা রেখে, উপরের দিকে তাকিয়ে তামান্নার সঙ্গে কথোপকথনের দৃশ্য কল্পনা করছিলাম।
কল্পনার মধ্যে তাকে আমি বলছি, "আপনার আমার ভালবাসা তো ব্যর্থ হয়ে গেল। এখন তো মানবেন, আপনার আর আমার মাঝে সম্পর্কটা কতো অবাস্তবিক ছিল? নাকি এখনও বলবেন, আমাকেই ভালবাসেন?"
"এখনও আপনাকেই ভালবাসি।"
"কিন্তু কেন? একটা সিংহাসনে বসার অধিকার রয়েছে শুধু একজন রাজার, অন্য কারো নয়। অন্য লোকদের জন্য রয়েছে কেদারা। সামান্য মানুষের জন্য সামান্য কেদারাই যথেষ্ট।"
"বাহ্! খুব সহজেই দেখি আমাকে একটা বস্তুর সঙ্গে তুলনা করে ফেললেন! এমন এক বস্তু যার অস্তিত্ব হলো অন্যের মর্যাদা বৃদ্ধি করা। তাছাড়া আর কিছুই না।"
"আপনাকে সিংহাসন বলে খারাপ কি বলেছি? এর দ্বারা আপনার যোগ্যতা বুঝিয়েছি।"
"যদি যোগ্যতার কথাই বলেন, তবে রানীর উদাহরণ বেশি মানাতো। কারণ একজন রানী একটা সিংহাসনের মতো একটা তুচ্ছ ব্যবহারের বস্তু হয় না। একজন রানীর মন জয় করতে হলে, একজন রাজাকে যথাযথ যোগ্য হতে হয়। তাছাড়া সবচেয়ে ব্যাপার হচ্ছে, একজন রানী তার ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে। অর্থাৎ সে তার পছন্দের মতো একজন স্বামী বেছে নিতে পারে যা একটা সিংহাসনের পক্ষে কখনওই সম্ভব না। কারণ একটা সিংহাসনে একজন অযোগ্য ব্যক্তি বসে গেলেও সে রাজা হতে পারে না, আর তার উপর বসার প্রকৃত যোগ্য প্রার্থী সে নিজে নিজে বেছে নিতে পারে না।" আমার নীরবতা দেখে আমায় জিজ্ঞাস করলো, "কি হলো, জনাব? আমার কথাগুলো শুনে দেখি মুখ থেকে আর কথা বেরচ্ছে না!"
"আপনি বলতে থাকুন। আমি শুনেই রাতটা কাটাবো। আপনার কণ্ঠ আমার কানে যতটা মূল্যবান, সারা বিশ্বের সব ধনসম্পত্তি তার তুলনায় তুচ্ছ।" বললাম এক মুচকি হেসে।
"শুধু আমি বলে যাবো, আর আপনি শুনেই যাবেন! এই অধিকার কি শুধুমাত্র আপনার একার? কি আমার এমন অধিকার নেই? কি আমার মন চায় না, আপনার বলা না বলা কথাগুলো শুনতে?"
এ শুনে আমার চোখে পাশ দিয়ে অশ্রুর ফোটা এক এক করে গড়াতে শুরু হলো, "যদি এতই মন চায়, তাহলে ছেড়ে গেলেন কেন?"
"আমি তো ইচ্ছা করে যাইনি।" বলে সে আমার কাছে এলো। নিজের গোলাপি ওড়না দিয়ে আমার অশ্রুগুলো মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তখনই কল্পনা আর বাস্তবতার মাঝে বিদ্যমান পার্থক্যটা আবার মনে এসে পড়ল। সে যতই চেষ্টা করুক সেই অশ্রুগুলো মোছার, আমার কল্পনায় সেই ক্ষমতা নেই তার দ্বারা এ কাজটুকু সম্পন্ন করার। আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে নিলাম। এমন বন্ধ চোখে যে কখন ঘুম এসে পড়ল, কিছুই বুঝতে পেলাম না।
সকালে চোখ খুলে দেখি; উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে। অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে একটা ডাকও দেননি। আমি ঝটপট উঠে, নাশতা তৈরি করতে গেলাম। অতঃপর চায়ের ট্রে নিয়ে গেলাম উনার অফিস রুমের দিকে। আমি হঠাৎ করে ঢুকে পড়ায়, অ্যাডভোকেট সাহেব চমকে গেলেন। উনি তখন ফোনে কথা বলছিলেন। চমকে যাওয়ার ধরণ দেখে বুঝতে পারছিলাম, আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু শুনে ফেলেছি কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়া আমার আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোনে, "আচ্ছা এখন রাখি।" বলে ফোন রেখে দিলেন।
আমি সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেলাম প্রশ্ন করে বিরক্ত করার। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে জিজ্ঞাস করলাম, "ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন?"
আমার থেকে চোখ এড়িয়ে উত্তর দিলেন, "আছে এক মক্কেল। তার কেস নিয়ে কিছু কথা বলতেই ফোন করেছিল।"
"ওঃ আচ্ছা! আপনার সেই ছাত্রকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন তো? কেস কিভাবে লড়তে হবে, কি কি দলিল লাগবে, সব বলেছেন তো?"
"অবশ্যই। তারও যথেষ্ট দায়িত্ববোধ রয়েছে। সে এই কেস নিয়ে কোনো অবহেলা করবে না।"
"আচ্ছা! ঐ মক্কেলের মামলা কি নিয়ে?"
"কার? যার সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলাম? সে তো বড়ই টেনশনে আছে। এই কেস হেরে গেলে, তার অনেক ক্ষতি হবে। তাই বারবার ফোন করে জিজ্ঞাস করতে থাকে, কাজ কেমন চলছে? কেস জিতবে তো? আরো কোনো দলিলপত্র লাগবে কি না? এসব টুকটাক ব্যাপার নিয়ে।"
"লোকটার কি আপনার ওপর আস্থা নেই?"
"আছে। অবশ্যই আছে। না থাকলে কি কেউ এতো বিশাল একটা কেসের দায়িত্ব দেয়?"
"আচ্ছা! আমি কিছু কিছু কথা শুনে ফেলেছি। উনার কেস কি কোনো হত্যাকাণ্ড নিয়ে?"
অ্যাডভোকেট সাহেবের চেহারায় আতঙ্কের ছাপ দেখা যাচ্ছিল। ভুরুকুঁচকে বললেন, "হ্যাঁ। মার্ডার কেস। একজন ক্রিমিনাল লয়ারের কাছে মার্ডার কেস নিয়ে আসাটা স্বাভাবিক।" এ বলে চায়ের কাপ হাতে তুললেন। চায়ের এক চুমুক নিয়ে আরো বললেন, "এসব কথা বাদ দাও। সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ! জীবনটা পুরোপুরি কাজের দাস হয়ে গিয়েছে। তবে তোমার এখন কি খবর, বাবা? ঘুম ঠিকমতো হয়েছে তো?"
"জি, হয়েছে। তবে স্বাভাবিকভাবে ঘুমোতে পারি না। অশ্রুর সাহায্য লাগে।" বলে একটা জোরপূর্বক হাসি দিলাম।
"তোমাকে আরো আগেই ঘুম থেকে ওঠাতাম। কিন্তু ভাবলাম; থাক্! তোমার জন্য বেশ অশান্তির সময় যাচ্ছে। অন্তত ঘুমে তো কিছুটা শান্তি পাবা। এ ভেবে আর ডাক দিলাম না।" চায়ের আরেক চুমুক নিয়ে বললেন, "তবে এবার বড় ক্ষিদে পাচ্ছে। একটা তাড়াতাড়ি করে নাশতা নিয়ে আসো তো।"
"জি, নিয়ে আসি। কিন্তু যাওয়ার আগে ছোট্ট একটা অনুরোধ।"
"কেমন অনুরোধ?"
"আমি মদ খেতে চাই। এই শহরে মদ কোথায় পাবো, একটু বলে দিতে পারবেন?"
রাগান্নিত স্বরে বললেন, "কি বলছো এসব? মাথা ঠিক আছে তো? মদ খেতে চাও এখন!" ডেস্কের উপর হাত দ্বারা একটা বারি দিয়ে আরো বললেন, "এসব কেন? ঐ মেয়েটার জন্য? সে কি কখনও চেয়েছিল যে তুমি মদ খাবে? সে কি তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে অনেক খুশি হতো? উত্তর দাও না কেন? বলো!"
আমি মাথা নত রেখে বললাম, "তাহলে আপনিই বলুন, আমি আর কি করব? তার মনে আসা তো কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। চোখের সামনে শুধু তার চেহারাটা ভাসে। শুনেছি, মদ খেলে নাকি কষ্ট ভোলা যায়! আমি এখন এ ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।"
"উপায় থাকতেও যদি উপায় না দেখো, তাহলে কিভাবে চলবে, বলো? তুমি যদি প্রকৃতপক্ষে তাকে ভালবেসে থাকো, তাহলে নিজেকে তার পছন্দের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করো। সে কখনই তোমাকে এমন মাতাল অবস্থায় দেখতে চাইবে না। তাই এসব করে নিজের জীবন এবং তার স্বপ্ন, দুটো একসঙ্গে নষ্ট করে দিও না।"
এ কথাগুলো উনি মন থেকে বলছিলেন তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। আমি উনার সঙ্গে যথেষ্ট সময় কাটানোর পর, এখন উনার সব নাটক বুঝি। তাই আমার প্রতি উনার যেই সহানুভূতি ছিল তা উনার চোখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম।
অতঃপর রান্নাঘরে গেলাম উনার নাশতা বানাতে।
নাশতা নিয়ে এসে দেখলাম, উনি মেঝে থেকে কিছু একটা তুলতে নীচে ঝুঁকে আছেন। আমাকে দেখে তা দ্রুত হাতে তুলে নিলেন। আমার কাছে মনে হলো, কিছু একটা হয়ত পড়ে গিয়েছিল। আমি শুধু নাশতা রেখে এসে পড়লাম। নাশতার শেষে উনি অফিস রুমের দিকে ফেরার পথে, ডাস্টবিনে কিছু একটা ফেলে গেলেন। আমি সেটা খেয়াল করলেও অতটা গুরুত্ব দেইনি।
সেদিন বিকেলে অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে অফিস রুমে ডাকলেন। বসতে বলাতে আমি চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। উনি আমার দিকে খুবই গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। অনেকক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর বললেন, "তোমাকে আজ কিছু কথা বলতে চাই। মনোযোগ সহকারে আমার কথাগুলো শুনো।"
"জি, বলুন।"
"বলার আগে একটা ওয়াদা করতে হবে।"
"জি, কেমন ওয়াদা?"
"যে তুমি আমার কথাগুলো শেষ হবার আগে সেই চেয়ার থেকে উঠবে না।"
"জি, ওয়াদা করলাম। এবার বলুন।"
"তুমি জানো তো, আমার একটা গোপন ক্যামেরা লাগানো আছে সেই ঘড়ির মধ্যে?"
"জি, জানি। একদম রান্নাঘরের পাশেই।"
"হ্যাঁ। তবে এসব জানার পরও কেন এমনটা করলা? কেন সেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েই যত সব আলাপ আলোচনা করলা?"
আমি তখন বুঝতে পেলাম, উনি কি কি বলতে নিচ্ছেন। তবে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে, শুধু তাকিয়ে রইলাম।
উনি আরো বললেন, "দেখো বাবা! তুমি আমার আপন সন্তানের মতো। আমি সেদিন অনেক দারুণ একটা মুডে ছিলাম। তার আগের রাত একজন কাছের লোকের সঙ্গে কাটিয়েছিলাম। খুব তাজা অনুভব করছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম; রাফি থাকলে ওর জন্যও কাউকে ডেকে আনতাম। এক ফোন করলেই মা একটা মেয়ে পাঠিয়ে দিত। তোমাকে আমি এতই আদর করি। তাও যে কেন এমন করলা!" এরপর কিছুক্ষণ থেমে এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আরো বললেন, "আজ সকালে হঠাৎ করে যখন মদ খাবার বায়না ধরেছিলে, তখন আমার কলিজায় বড় আঘাত লেগেছে। মনটা চাচ্ছিল, নিজের জীবন দিয়ে দেই। বেঁচে থেকে কি লাভ, বলো? যদি আমার সন্তানতুল্য একটা ছেলে এমন এমন কথা বলে, তাহলে খারাপ লাগবে না, বলো? তোমার বাবা কি কখনও এমনটা চাইবে তোমার জন্য? চাইবে না, তাই না? ঠিক সেভাবেই, আমিও তোমার ক্ষতি হতে দেখতে চাই না।" এতটুকু বলার পর, নিজের ডেস্কের ড্রয়ার খুলে, নিজের বন্দুক বরে করলেন। বন্দুকের মধ্যে একেক করে গুলি ভরে, ডান হাতে বন্দুক ধরে নিজের মাথায় ঠেকালেন।
আমি সঙ্গে সঙ্গে কেদারা হতে উঠতে নিলাম, তখন নিজের বাম হাত দ্বারা বসে থাকার ইশারা করলেন। আমি আবারও বসে পড়লাম।
অতঃপর আবার একাধারে বলতে লাগলেন, "মেয়েটা আমাদের মাঝে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে নিচ্ছিল। নিজের মিষ্টি মিষ্টি কথা, সুন্দর হাসি, ফর্সা ত্বক, যৌবনভরা দেহ; এসব দ্বারা তোমাকে প্রভাবিত করছিল। সে তোমাকে শুধু এক প্রেম জালে ফাঁসাতে চাচ্ছিল। তার কাজ শেষ হবার পর, তোমাকে ব্যবহার করে ফেলে দিত। মেয়েদের তো কাজই এটা! তুমি এটা কখন বুঝবে?"
এসব কথা শুনে আমার গায়ে ধরতে লাগল। কিন্তু হাত দুটো মুঠো চেপে সব হজম করতে হচ্ছিল। কারণ এই কথাগুলো উনার ডেস্কের নিচে লাগানো গোপন মাইক্রোফোন দ্বারা তো শোনা যাচ্ছিল। এর দ্বারা অ্যাডভোকেট সাহেব হাতেনাতে ধরা পড়বেন।
অ্যাডভোকেট সাহেব আমার দিকে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে তাকিয়ে থেকে, আবারও একাধারে বলতে থাকেন, "বাহ্! এতো ধৈর্য! আজ সকালে তো এতো ধৈর্য ছিল না। হঠাৎ করে কোথা থেকে আসল? যাক্! ধৈর্য ভাল জিনিস। আর এখন যেই কথাগুলো বলতে যাচ্ছি, সেগুলো শোনার জন্য তোমাকে কিছুক্ষণের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে ধৈর্যশীল ব্যক্তি হয়ে দেখাতে হবে। পারবে তো?"
"জি, পারবো।" বললাম বহুক্ষণ পর।
এ শুনে অ্যাডভোকেট সাহেব আরো উৎসহের সঙ্গে বলতে লাগলেন, "তুমি কি জানো, একটা গাড়িতে লাগানো নতুন ব্রেক কিভাবে এতো সহজেই ফেইল হয়ে গেল? কারণ আমার এক মক্কেল একটা গ্যারাজের মালিককে এই কাজের জন্য বিশ লক্ষ টাকা দিয়েছিল। সেদিন কোর্ট থেকে বের হবার আগে, তারই একজন লোক গিয়ে টায়ারে ছিদ্র করে দিয়েছিল। যখন গাড়িকে গ্যারাজে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ড্রাইভারের অজান্তে গাড়ির ব্রেক বদলে ফেলা হয়। বেচারা বিড়ি টানতে গিয়ে নিজের প্রাণ হারানোর ব্যবস্থা করে গেল। তবে এটা ওরও পুরোপুরি দোষ না। মাঝেমধ্যে বড় মাছ কাঁটায় ধরতে আগে টোপ হিসেবে নিজের তরফ থেকে একটা ছোট মাছের লোভ দেখাতে হয়। এতে মাছ সন্দেহও করে না, আর সহজে ফেঁসেও যায়। তবে এখন নতুন ড্রাইভার নিয়োগ দেওয়াটাও আরেক যন্ত্রণা!" এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরো বললেন, "যা-ই হোক! তোমার মনে এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন এমনটা করতে হলো। আর এমন প্রশ্ন জাগ্রত হওয়াটা পুরোপুরি স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে একটা ব্যাপার বুঝতে হবে। মেয়েটা বহু দিক দিয়েই আমার জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারত। আমার একটা রহস্য জেনে গেলেই আমার জন্য মহাবিপদ। তাও আবার তোমাকে ব্যবহার করে এসব জানার চেষ্টা করছিল যা আমার মোটেও সহ্য হয়নি। কারণ আমি চাইনি, আমাদের মাঝে কোনো মেয়ে আসুক। তবে তোমার এই সন্দেহজনক আচরণ দেখে, আমি তোমাকেও আর দেখতে পারছিলাম না। তাই সেদিন তার সঙ্গে যাবার জন্য এতো জোর করছিলাম। ঐ মেয়েটার পেছনে পেছনে যেতে যেতে একসময় কবরে পৌছে যেতা।" বলে ভয়ানক হাসি হাসতে লাগলেন।
আমার সহ্য হচ্ছিল না বলে উনার দিকে চোখ বড় করে তাকালাম। আমার এই প্রতিক্রিয়া দেখে উনি অতি ভদ্রভাবে হুমকি দিলেন, "এই... খবরদার! যদি একটা জ্যান্ত মানুষের শরীর থেকে তার প্রাণ বের করে ফেলতে পারি, সেই তুলনায় তোমার চোখ বের করা কোনো ব্যাপারই না।"
উনার রাজকীয় কন্ঠ শুনলেই নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়। আমি যতই সাহসিকতা দেখানোর চেষ্টা করি না কেন, উনার কন্ঠের কাছেই আমার সকল বীরত্ব বিফল।
আমি খুব কষ্টে, নিজেকে আশ্বাস দিয়ে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণাধীন আনলাম। চোখ নামিয়ে আবারও মাথা নত রেখে বসে রইলাম।
অ্যাডভোকেট সাহেব তখন বলতে লাগলেন, "তোমার মৃত্যুর সঙ্গেই সব শেষ হয়ে যেত না কিন্তু। আমার সঙ্গে বিরোধিতার বদলা তোমার পরিবার থেকেও নিতাম। তোমার মরে যাবার পর তোমার বাবাকে একটা মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিতাম। কিন্তু তুমি এমনটা হতে দিলে না। যাক্! এখন একটা মজার ব্যাপার বলি তোমাকে। লেনদেনের জন্য যে চেক পাঠিয়েছিলাম, ঐ চেকের কথা মনে আছে? সেই চেকটা আসলে আমার ব্যাংক একাউন্টের না। সেই চেকটা আমার মক্কেল আমার কাছে দিয়ে গিয়েছিল। সেটা ছিল একটা ব্ল্যাংক চেক। আমি একদিক দিয়ে উনাকে ফোন করে বললাম, আমার জন্য আরেকটা ব্ল্যাংক চেক তৈরি করতে, আরেকদিক দিয়ে গ্যারাজের মালিকের সঙ্গে চুক্তি করলাম, বিশ লক্ষ টাকার। এমন করাতে আমারও কোনো ক্ষতি হলো না, আবার আমার পথের বাঁধাও সরে গেল। ওঃ হ্যাঁ, আরেকটা কথা তো বলতে ভুলেই গেলাম। আমার যেই ছাত্রের হাতে কেসটা দিয়েছি, সে লড়ার জন্য নয়, বরং হারার জন্য টাকা নিচ্ছে। তবে টাকা আমি না, আমার সেই মক্কেল দিবে। আর আমি সেই ব্ল্যাংক চেকের টাকা সরাসরি উত্তোলন করবো না। তার জন্য একটা সুইস ব্যাংক একাউন্ট আছে। মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে এই কালো ধনসম্পত্তি সাদায় পরিণত করে নিব।"
আমার দিকে কিছুক্ষণ নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাস, "সব তো বলেই দিলাম। এখনও রাগ উঠছে না? এই তোমার যৌবন? যৌবনকালে তো আমাদের রক্ত অল্পতেই গরম হয়ে যেত। তোমার শরীরের মধ্যে কি আদতে একজন পুরুষের রক্ত আছে? মনে তো হয় না। থাকলে কি কেউ এতক্ষণ চুপচাপ বসে এত কিছু শোনার ধৈর্য রাখতে পারে? ওঃ হ্যাঁ! তুমি তো ঐ মাইক্রোফোনের আশায় বসে আছো, তাই না?"
এ শুনে আমি হতবাক হয়ে উনার দিকে তাকালাম।
আমার প্রতিক্রিয়া দেখে উনি সঙ্গে সঙ্গে হেসে দিলেন।
এরপর বললেন, "কি? শক্ খেলে নাকি? হ্যাঁ, আমি জেনে গিয়েছি। কিছুক্ষণ আগে ডাস্টবিনের যে ময়লা ফেলে এসেছো, তার সঙ্গে ঐ মাইক্রোফোনও হাত থেকে গেল। আজ সকালে রাগের মাথায় টেবিলে বারি দেওয়াটা আমার জন্য উপকারী বের হয়েছে। ছোটকাল থেকে শুনে এসেছি, রাগ নাকি অনেক খারাপ। আজ জানতে পেলাম, এর ভাল দিকও রয়েছে। তবে এসব তোমারই অবদান। তোমার আবেগ তোমাকে পরাজিত করে দিল। তুমি এতো কষ্ট করে এসব ষড়যন্ত্র করলা, আর তাও আমি সব ধরেই ফেললাম। যাক্! এবার অবশ্যই তোমার হিংস্রতা বের হয়ে আসার কথা। কারণ এখন ধৈর্য ধরেও কোনো লাভ নেই। তুমি আমাকে কিছু করলেও পরশুদিন ঐ মেয়েটার পরিবার কেস হারবে, আর না করলেও কেস হারবে। তাই চুপচাপ বসে না থেকে অন্ততপক্ষে কয়েকটা গালি দাও।"
উনি নিজের বন্দুক হাত থেকে রেখে দিলেন টেবিলের উপর, আর আমাকে কেদারা থেকে ওঠার অনুমতি দিলেন।
অনেক চিন্তা করার পর কেদারা থেকে উঠে, মাথা নত রেখে, রুম থেকে বের হতে লাগলাম। উনি আমার আচরণে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাস করলেন, "কি ব্যাপার? মারবে না আমাকে?"
"না। আমি কাছে গেলে আপনি গুলি করে মেরে ফেলবেন, এটা আমার জানা আছে। তাই ভাবলাম, আপনার হাতে প্রাণ হারানোর চাইতে ভাল হবে নিজের প্রাণ নিজেই নিয়ে নেওয়া।"
"বাহ্! এতক্ষণ যেটাকে ধৈর্য ভাবছিলাম, সেটা তো কাপুরুষতা বের হলো! আত্মহত্যা কাদের কাজ, জানো? আত্মহত্যা তারা করে যারা মৃত্যুর কাছে জীবনের বাজি হেরে যায়।"
"আমি কি এখন তার চেয়ে কিছু কম?"
"যদি লড়াই থেকে এতই ভয় পাও, তাহলে মাঠে নামো কোন সাহসে?"
"সত্যি বলতে গেলে, ভয়ের কিছু নেই। আমি আপনার উস্কানি দ্বারা প্রভাবিত হবার আর আগ্রহ রাখি না। যদি মৃত্যুই হয়ে থাকে পরিণতি, তাহলে সেটার সুযোগ আপনার হাতে দিব না।" বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।
অতঃপর যেমনেই ছুড়ি নিয়ে গলা কেটে ফেলার উদ্দেশ্যে রান্নাঘরে প্রবেশ করলাম, তখনই পেছন থেকে অ্যাডভোকেট সাহেব ডাক দিলেন। আমি পিছনে ঘুরে, তাকিয়ে দেখলাম, উনি আমার দিকে খালি হাতে এগোচ্ছেন। আমার কাছে এসে বললেন, "তুমি জানো, আমি কেন হত্যা করি? যাতে আমার নিজের প্রতি একটা ঘৃণা জন্মায়। কারণ যখনও আমি কারো প্রাণ নিয়ে নেই, তখন নিজের বিবেকের চোখে আমি ছোট হয়ে পড়ি। তখন নিজেকে মনে দেওয়াই যে আমি যাকে হত্যা করেছি, সে এখন বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে কোনোদিন একটা বড়সড় পাপকাজ করে ফেলতে পারত। তার আগেই আমি তাকে মেরে ফেলাতে, এখন তার এই সুযোগ আর নেই। আমি নিজেই বিচার করে ফেলেছি। শুধুমাত্র আমিই এর সম্বন্ধে জানব এবং নিজেকে এর জন্য দায়ি করে, নিজের মনের ভেতর নিজেরই বিচার করবো। তখন আমি আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসি। নিজের জন্য আমি যেই শাস্তি নির্ধারণ করেছি, সেটা ছিল জনসম্মুখে আত্মহত্যা। একদিন সবার সামনে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলব, আর নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা প্রকাশ করে ফেলব। আজ আমাকে কেউ এতটাই ঘৃণা করে বসেছে যে সে নিজেই আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। তুমি আমাকে এতটাই ঘৃণা করো যে আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী তোমার মৃত্যু এড়াতে, তুমি নিজেই নিজের মৃত্যু ঘটাতে নিচ্ছ। অর্থাৎ আজ আমি তোমার মধ্যে সেই ঘৃণা দেখতে পেলাম যা আমি নিজের মধ্যে জমা করছিলাম। তাই আজ আমি তোমার কাছে নিজের প্রাণ আত্মসমর্পণ করতে চাই। আমাকে যেভাবে খুশি শাস্তি দাও।" উনি একাধারে বলেই গেলেন চোখে অশ্রু নিয়ে।
আমি উনার কথাগুলো শুনে প্রথমে একটু উত্তেজিত হয়ে গেলাম। পরে ভাবলাম; উনাকে নিজ হাতে শাস্তি দিয়ে দিলে, উনার শেষ ইচ্ছে পূরণ হয়ে যাবে। সারা দুনিয়া মনে করবে; একটা চাকর তার মালিককে নির্বিচারে হত্যা করেছে। তামান্না এসব কখনওই চাইবে না। সে আইনের উপর আস্থা রাখে। তাই এমন একজনের প্রকৃত বিচার আমার হাতে নয়, আইনের হাতেই হতে হবে। এসব ভাবার পর সিদ্ধান্ত নিলাম, উনাকে গ্রেপ্তার করানোর। আমার রুমে গিয়ে ফোন দিলাম ডিটেকটিভ নিজামকে। ফোন করে বললাম, অ্যাডভোকেট সাহেবকে গ্রেপ্তার করানোর জন্য বাসায় আসতে।
অতঃপর ডিটেকটিভ নিজাম বাসায় পুলিশ নিয়ে এলেন। অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের অপরাধ মেনে, ওদের সঙ্গে থানায় গেলেন।
থানায় গিয়ে উনার রিপোর্ট তৈরির জন্য উনাকে প্রশ্ন করার সময় উনি জিজ্ঞাস করলেন, "একবারে প্রথম থেকে বলি?"
থানায় সকলে হয়রান হয়ে তাকিয়ে রইল, যখন উনি নিজের ১৯৭টা খুনের স্বীকারোক্তি দিলেন। শেষের খুন ছিল তামান্নার। তার হত্যার স্বীকারোক্তি দেয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। থানার মধ্যে কারোও বিশ্বাস হচ্ছিল না, এমন একজন লোক যে নিজে নিজে দাঁড়াতেও পারে না, সে এতগুলো হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ি। সব রিপোর্ট তৈরি হবার পর, উনাকে কারাগারে বন্দি করা হলো। শেষবারের মতো আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। উনার এই কথাটা রাখার উদ্দেশ্যে দেখা করলাম।
আমাকে দেখে, চোখে অশ্রু নিয়ে এবং মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, "আজ আমি সব হারিয়ে ফেলেছি। তোমার সামনে যে আছে এখন, সেই ব্যক্তিটা আর সেই ব্যক্তি না, যাকে নিয়ে সকলে গর্ব করতো। আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত সেই সাব্বির ক্বারি এখন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তবে আজ সত্য বলে নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার দিন আমার জন্য বিশেষ করে জনসম্মুখে ফাঁসির জন্য আদালতের কাছে নিবেদন করবো, তাও চেহারা প্রকাশ্য অবস্থায় রেখে। আমি অবশেষে এই অন্যায়ের জীবন থেকে রেহাই পেতে চলছি। এর জন্য তোমাকে শেষবারের মতো একবার সাধুবাদ জানতে চাই।"
"কিন্তু আপনি তো একাই অপরাধী নন। খুন তো আমিও করেছি। শাস্তি আমারও হওয়া উচিত।"
"তোমার মন কি বলে এ ব্যাপারে?"
"আমার মন তো বলে; এখন বেঁচে থাকার তো যত উদ্দেশ্য ছিল, সবই শেষ। সারাজীবন নিজেকে দোষারোপ করে ভেতরে ভেতরে মরার চাইতে ভাল, আমিও নিজের অপরাধগুলো মেনে, শাস্তি ভোগ করে নেই। কি বলেন, করে ফেলি?" এ বলে নীরবে কিছুক্ষণ উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
উনি আমার কথাগুলো শুনে শুধু একটা মুচকি হেসে, হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালেন।
অতঃপর আমিও গিয়ে ট্রেনের মধ্যে করা হত্যাগুলোর স্বীকারোক্তি দিলাম। আমাকেও সেই জেল কক্ষেই রাখা হলো যেটার মধ্যে অ্যাডভোকেট সাহেব ছিলেন। সারাটা সময় উনার সঙ্গেই গল্প করতে করতে কাটালাম।
অবশেষে এসে পড়ল মৃত্যুদণ্ডের তারিখ। অ্যাডভোকেট সাহেবের অবদানে জনসম্মুখে ফাঁসিতে লটকানোর সুযোগ পেলাম। দুজনের জীবনকাহিনী সেদিন সেখানেই শেষ হলো। তবে আমাদের উভয়ের মুখে হাসি এবং বুকে শান্তি বিদ্যমান ছিল।
এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে অবশেষে ফোন খুঁজে পেলাম। ফোন নিয়ে এসে উনার হাতে দেওয়াতে; নিজে ব্যস্ত ডিটেকটিভ নিজামের ফোন নাম্বার নোট করতে, আর আমাকে ব্যস্ত করে দিলেন সবার জন্য নুডলস রান্না করে আনতে। রান্নাঘরে গিয়ে দেখি নুডলস তৈরির যথাযথ সামগ্রী নেই, তাই বাজার থেকে সব কিনে নিয়ে এলাম। আমাকে বাজার নিয়ে বাসায় প্রবেশ করতে দেখে, তামান্না পেছন থেকে এসে, আমার ডান হাত থেকে সামগ্রী নিয়ে, আমার সঙ্গে রান্নাঘরে চলে এলো। অনেক মানা করছিলাম তার সাহায্যের জন্য, তবুও নাছোড়বান্দা মেয়েটা আমার সাহায্য করবেই।
আমি নুডলস তৈরির জন্য চুলোয় পানি চড়িয়ে, পানি গরম হওয়া পর্যন্ত সবজি কাটতে লাগলাম। পাশ দিয়ে তামান্না এসে, আরেকটা ছুরি নিয়ে, আমার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সবজি কাটতে লাগল। আমি অনেক অনুরোধ করছিলাম, আমার সাহায্য না করতে, তবুও মেয়েটা তো সেই নাছোড়বান্দা।
চুলোর পাশে দাঁড়িয়ে, এভাবে সবজি কাটতে কাটতে আমাদের দুজনেরই ঘাম ছুটে গেল। শুধু চুলোর তাপের দোষ দিলে চলবে না। আবহাওয়ার অবস্থাও বেশ উত্তপ্ত ছিল। পানি যথেষ্ট গরম হওয়ায় সবজির টুকরোগুলো পানিতে ঢেলে দিলাম। এই ফাঁকে তামান্না এক গ্লাস পানি পান করল। সে সময়ে আমার হাত ব্যস্ত ছিল ছুরি দিয়ে পেঁয়াজ কাটাতে, কিন্তু আমার চোখ ছিল তামান্নার উপর। তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে ছিলাম না। মুখ সামনের দিকে রেখে, চোখের ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। পানি খাওয়ার জন্য যেভাবে পিঠ বেঁকিয়ে, উপরের দিকে তাকিয়ে, চোখ বন্ধ রেখে প্রত্যেকটা ঢোক গিলছিল, তার উপর থেকে চোখ সরানো বড় একটা কঠিন কাজ হয়ে গিয়েছিল। তার ঠোঁটের সঙ্গে গ্লাসের স্পর্শ দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। প্রতি ঢোক গেলার সময় গলার কম্পন আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। পানি পান করার শেষে এক ফোঁটা পানি তার ঠোঁট থেকে শুরু করে, ঘাড়ের পথ ধরে, অতি ধীরগতিতে, পিছলিয়ে নেমেই চলছিল। সেই ফোঁটার ধীরগতি দেখে আমার হৃৎপিণ্ডের গতি আকাশ ছুঁয়ে ফেলছিল। এমতাবস্থায় তামান্না সেই ফোঁটা বুকে পৌছানোর আগেই নিজের ওড়না দিয়ে মুছে ফেলল, আর এক হিসেবে আমাকে একটা হার্ট স্ট্রোক থেকেও বাঁচিয়ে দিল। কিন্তু স্ট্রোক করা হতে বেঁচে গেলে কি হবে? আসল কান্ড তো ঘটেই গেল! এই অতুলনীয় দৃশ্য দেখতে গিয়ে, আমার খেয়াল উঠে পড়েছিল ছুরি এবং পেঁয়াজ থেকে। ছুরি লেগে হাত কেটে গেল। কাটা স্থান থেকে রক্ত বের হচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে; তামান্না সঙ্গে সঙ্গে আমার হাতটা ধরে, কাটা ঘায়ে মুখ দিয়ে দিল। তার ঠোঁটের স্পর্শ আমার হাতে। আহ্! কি দারুণ একটা অতুলনীয় অনুভূতি। এমন অনুভূতির জন্য কি না করতে পারি! তবে মুহূর্তটা ছিল অতি ক্ষণস্থায়ী। নিজের মুখ থেকে বের করে, বেসিনের পানি ছেড়ে, আমার হাত পানির নিচে রেখে, আমার জন্য বরফ আনতে গেল। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, বড়সড় কোনো ঘটনা ঘটে গিয়েছে। উনার চেহারায় এমন অস্থিরতা দেখে, উনার চোখে এমন দরদ দেখে, উনার কন্ঠে এমন অসহায়তা শুনে, মনে হচ্ছিল যেন ব্যথা আমার নয় বরং তার নিজের হাতে পেয়েছে।
আমার প্রাথমিক চিকিৎসা করার সময়েও তাকে বলছিলাম, এমন করার কোনো প্রয়োজন নেই।
তাকে জিজ্ঞাস করলাম, "আপনি আমাদের অতিথি। অতিথিদের দিয়ে কি কাজ করানো চলে, বলেন?"
কিন্তু আমার এই প্রশ্নের উত্তর সে খুবই মিষ্টি সুরে দিল, "আপনি মনে ভুলে যাচ্ছেন, আপনিও এখানে একজন অতিথি যে আমারই সঙ্গে এসেছে। আপনি চিরকালের জন্য এখান থেকে চলে গিয়েছিলেন। একমাত্র আমার অনুরোধেই আপনার এখানে ফিরে আসা। তাই এই মুহূর্তে যদি আমি অতিথি হয়ে থাকি, তাহলে আপনিও একজন অতিথি।" বলে হেসে দিল।
আমি তখন সুযোগ করে বললাম, "আচ্ছা, আপনি অ্যাডভোকেট সাহেবের সঙ্গে ট্রেনের গুন্ডাদের প্রসঙ্গে কিছু বলবেন না।"
"কেন? বললে কি হবে? উনিই তো তাদেরকে পাঠিয়েছিলেন। তাহলে উনার কাছ থেকে গোপন রেখে কি লাভ?"
"কথা লাভের চেয়ে বেশি লোকসানের। একটু বোঝার চেষ্টা করুন। অ্যাডভোকেট সাহেব তো আপনাকে চিনতে পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। আর আপনিও উনার কাছে শুধু একটা কেস নিয়ে কথা বলতে এসেছেন। এখানে ডিটেকটিভ নিজাম এসবের মাঝে একজন সাক্ষী হয়ে রয়েছে। আমরা অ্যাডভোকেট সাহেবকে ধরা খাওয়ানোর চেষ্টা করলে, নিজেও ধরা খেয়ে যাবো। সেজন্যই বলছি, এ প্রসঙ্গে কথা ওঠানোর দরকারই নেই।"
"হুম... কথা ঠিক বলেছেন। তবে উনি আপনাকে এ প্রসঙ্গে কিছু জিজ্ঞাস করে থাকলে কি বলবেন?"
"বলে দিব, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সাক্ষাৎ হয়নি।"
"আর যদি জিজ্ঞাস করে, আমাকে কোথায় পেলেন?"
"বলে দিব, ইত্তেফাকের কারণে দুজন একই ট্রেনের, একই কম্পার্টমেন্টে বসে ছিলাম। সময় কাটাতে গিয়ে হালকা-পাতলা কথোপকথন হলো। তারপর আমার পরিচয় জানায় আপনি আমাকে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করে বসলেন।"
"ইত্তেফাকের কথা কি এতো সহজেই মেনে নিবে?"
"উনার কাছে আর কোনো উপায় নেই। কারণ ইত্তেফাকের মতো জিনিস রয়েছে বলেই এই শব্দটা ব্যবহার করতে পারবো।"
"ঠিক আছে। তাহলে উনার সামনে ট্রেনে ঘটা কোনো ঘটনা তুলবো না।" এ বলে তামান্না আশ্বাস দিয়ে থাকলেও, আমি মনে মনে জানতাম অ্যাডভোকেট সাহেবের মাথায় শুধু এই একটা বিষয়ই ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলই নিজেদের মাঝে বিষয়টি গোপন রাখা।
অতঃপর নুডলস তৈরি হয়ে গেল আপ্যায়নের জন্য। আমি এবং তামান্না একসঙ্গে, ট্রেতে করে নুডলস নিয়ে গেলাম সবার জন্য। ডিটেকটিভ নিজাম আমার হাতের ঘা দেখে জানতে চাইলেন কি করে কাটলো। সবজি কাটতে গিয়ে এই অবস্থা শুনে অ্যাডভোকেট সাহেব এক ঝাড়ি দিয়ে বললেন, "আরে বাবা, তুমি কানা নাকি? সবজি কাটার সময় মনোযোগ কথায় থাকা উচিত, বুঝ না?" ঝাড়ির শেষে কাছে ডেকে, ঘাটা দেখে কিছুক্ষণ আফসোস করলেন। করলেন বলতে কি, আফসোস করার ভাণ করলেন। দুনিয়ার যে কেউ এ দৃশ্য দেখে মনে করবে; ঠিক একটা বাবা যেভাবে সন্তানকে কষ্টে দেখে সইতে পারে না, ঠিক সেভাবেই উনার কলিজাটাও আমার জন্য ফেটে পড়ছে। কিন্তু আমি জানতাম এটা নিতান্তই একটা নাটক। সবার সামনে নিজের একটা সুন্দর চিত্র আঁকার এক সুবর্ণ সুযোগ। তাছাড়া আর কিছুই না।
এই নাটকের শেষে আরো কিছু গল্প হলো। গল্পে গল্পে জানতে পেলাম; পুরান ঢাকার শ্রেষ্ঠ গর্ব মোট তিনজন। তার মধ্যে দুজন এখন একই ঘরে বসে গল্প করছেন। অ্যাডভোকেট সাব্বির ক্বারি এবং ডিটেকটিভ নিজামুল; এই দুটো নাম শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বে খ্যাতনামা। এমন প্রখ্যাত দুজন কিংবদন্তির মাঝে বসে ছিল আমার মতো অশিক্ষিত একজন চাকর।
প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো গল্প করার পর, বিকেল হবার কিছুক্ষণ আগেই ডিটেকটিভ নিজাম বিদায় নিলেন। বিদায় নেওয়ার সময় স্বয়ং আমি উনাকে ছেড়ে এলাম। ডিটেকটিভ নিজাম গাড়ি ওঠার সময় আমাকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বললেন।
উনি প্রথম জিজ্ঞাস করলেন, "আপনি কি তাকে পছন্দ করেন?"
আমি অবাক হয়ে তার উত্তরে বললাম, "জি, বুঝতে পারলাম না!"
"তামান্নাকে পছন্দ করেন আপনি?"
"হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?"
"আপনার চোখে স্পষ্ট দেখা দেয়।"
"এমন কি দেখলেন?"
"সেটা আপনি ভাল করেই জানেন। তবে একটা কথা আপনাকে জানিয়ে দিই।"
"কি?"
"মেয়েটাও আপনাকে পছন্দ করে।"
আমি লজ্জায় হেসে জিজ্ঞাস করলাম, "কি বলেন এসব? তার মতো সুন্দর, শিক্ষিত এবং গুণাগুণ সমৃদ্ধ মেয়ে সব ছেড়ে আমার মতো একজনকে পছন্দ করবে কেন?"
উনি এ কথার সামান্য হেসে বললেন, "শুনেন! একটা নাগিনের জন্য যতই নাগ থাকুক না কেন, একজন সাপেরা তার বিন বাজিয়ে ঠিকই বশ করে ফেলতে পারে। হতে পারে মেয়েটার জীবনেও আপনি এমন কোনো ধরনেরই প্রভাব ফেলতে পেরেছেন।"
"হ্যাঁ। বলতে গেলে তো সবই হতে পারে। ঠিক তেমনিই, যেমনি এ প্রসঙ্গে আপনার ধারণা ভুলও হতে পারে।"
এ শুনে শেষবারের মতো একটা মুচকি হেসে বিদায় নিলেন ডিটেকটিভ নিজাম। উনার গাড়িটা এভাবে যেতে দেখে মনে কিছুটা কষ্ট পাচ্ছিলাম। এমন একটা লোকের সঙ্গে আর কখনও দেখা হয় না হয়। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। এরপরও একবার আমাদের দেখা হয়েছিল। কিন্তু আমি কখনও স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারিনি, শেষ পর্যন্ত এমন একটা কারণে উনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে।
সেদিনের রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে, রাতের খাওয়া শেষের কিছুক্ষণ পর, অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে কিছু কথা বললেন। তামান্না তখন ঘুমোতে চলে গিয়েছিল, কারণ তার শরীর বেশি ক্লান্ত লাগছিল।
"এই রাফি, একটু শুনে যাও তো।" বলে ডাকলেন আমাকে।
"জি!" বলে উনার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
"মেয়েটার সঙ্গে দেখা হবার ঘটনাটা একটু তোমার মুখে শুনতে চাই।"
আমি তামান্নাকে যা কিছু বলতে বলে রেখেছিলাম, ঠিক সেটাই উনাকে বলে দিলাম। কিন্তু ঠিক এমন সময়ে এমন কিছু হলো, যা আমি কখনও কল্পনাও করতে পারিনি।
অ্যাডভোকেট সাহেব নিজ থেকেই গুন্ডা পাঠানোর প্রসঙ্গ তুললেন।
আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, "মেয়েটার পেছনে কিছু লোক ছিল নাকি?"
চমকে যাওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, "না তো! কেন?"
"যে লোকটা তার বোনকে হত্যা করেছে, সে আমার মক্কেল। সে আমাকে বলেছিল যে সে একটা মাতাল পতিতাকে হত্যা করে ফেলেছিল মদের নেশায়। এটা নাকি তার শত্রুদের ষড়যন্ত্র। তাই তার শত্রুরা নাকি এমন নকল একটা মামলা দিয়ে তার ধনসম্পত্তি হাতাতে চায়। তাই আমার কাছ থেকে আমার লোকদের নাম্বার চেয়েছিল, তাদের মাধ্যমে এই মেয়েকে খুঁজে বের করে, তার কাছে থাকা নকল প্রমাণগুলো মেটাতে। আমিও আমার লোকদের বলে রেখেছিলাম; আমার মক্কেল যেভাবে যা করতে বলে, সেটা সেভাবেই করতে। তাই জিজ্ঞাস করলাম, তার পেছনে সেই লোকদের পাঠিয়েছিল কি না। এমন কিছু দেখেছ কি?"
আমি উনার কথা শুনে পুরোপুরি হতবাক হয়ে গেলাম। পায়ের নিচ থেকে জমিন সরে গিয়েছিল আমার। আমি তখন একটু কৌশল করে জিজ্ঞাস করলাম, "আপনি যে এভাবে লোকটার কথায় এসে নিজের লোকের নাম্বার দিয়ে দিলেন, সে যদি তাদের মাধ্যমে তামান্নার ক্ষতি করে বসত?"
আমার প্রশ্ন শুনে ভুরুকুঁচকে জিজ্ঞাস করলেন, "এর অর্থ তার পেছনে লোক ছিল, তাই না?"
আমার প্রতি ধীরে ধীরে উনার মনে সন্দেহ জন্মাচ্ছিল। এই সন্দেহ এড়াতে বললাম, "হ্যাঁ, ছিল। সে অনেক কষ্টে তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে এলো। তবে আমি তাদের কাউকে দেখিনি।"
"না দেখে থাকলে, তাকে বিশ্বাস করতে গেলে কেন? এমনও তো হতে পারত যে সে মিথ্যে বলে, তোমাকে ব্যবহার করতে চাচ্ছে।" বলে এক ঝাড়ি দিলেন।
"কিন্তু আপনিই তো মাত্র এর সততা যাচাই করলেন। তাহলে তো সব ঠিকই আছে। তাছাড়া তামান্নার কাছে যথাযথ প্রমাণাদি রয়েছে।"
"সেগুলো যে আসল, সেটা কীভাবে বুঝলে?"
"আসল না হলে কি কেউ এতো কষ্ট করে তার জন্য নিজের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়?"
"হায়রে! এই যুক্তিতে কাজ করলে তো বলতে হবে; একটা চোরও যখন জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে, চুরি করে পালায়, তখন সে নিজের জিনিসপত্র নিয়েই পালায়। কি, ঠিক বললাম না?" বলে হেসে দিলেন।
এর পাল্টা জবাব কি দেয়া যায়; তা ভাবতে না ভাবতেই, উনি আরো বললেন, "আচ্ছা, যেটাই হোক! মেয়েটার প্রমাণাদি আমার দেখা হয়েছে, আর আমি বুঝতে পেরেছি, তার সকল প্রমাণ সত্য। আমি আমার সেই মক্কেলকে মানা করে দিয়ে, এই মেয়েটার কেস লড়ব, ঠিক আছে?"
একথা শুনে মুখে এক বিশাল মুচকি হাসি ফুটল। নিজের কানে শোনা কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি বেশি কিছু না বলে, শুধু তার এই সিদ্ধান্তের প্রতি সাধুবাদ জানিয়ে গেলাম।
তবে কথা শেষ হবার পর, যখন আমি রুম থেকে বের হচ্ছিলাম, তখন আমাকে উনি জিজ্ঞাস করলেন, "আচ্ছা, আমার লোকদের ফোন আজ সকাল থেকে বন্ধ আসছে। এ সম্বন্ধে কোন ধারণা আছে তোমার?"
আমি না-সূচক মাথা নেড়ে, নিজের মতো চলে গেলাম।
তার পরের সকালে নাশতা করার পর, অ্যাডভোকেট সাহেব বসে ছিলেন অফিসে, আর আমি কাপড় ধুয়ে, শুখাতে দিতে ছাদে গেলাম। এমতাবস্থায় তামান্না আমার পেছনে পেছনে ছাদে এসে পড়ল। ছাদে এসে আমাকে জিজ্ঞাস করলো, "গতকাল রাতে চিল্লানোর শব্দ শুনতে পেলাম। সবকিছু ঠিক আছে তো?"
"জি, ঠিক আছে। তার উপরে একটা সুসংবাদ আছে।"
"কেমন সুসংবাদ?"
"অ্যাডভোকেট সাহেব আপনার পক্ষে লড়তে রাজি আছেন।"
"হঠাৎ কীভাবে রাজি হলেন? উনি তো আমাকে মারতে গুন্ডা পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন। এতো সহজেই মেনে গেলেন! বিশ্বাস হচ্ছে না।"
"উনি আমাকে যা বলেছিলেন, আমি তা-ই বলছি। তবে শত চেষ্টার পরও গুন্ডাদের প্রসঙ্গে কিছু কথা বলতেই হলো। কিন্তু আমি উনাকে বলেছি; আপনার পেছনে কিছু লোক লেগে ছিল। আপনি তাদের থেকে পালিয়ে এসেছিলেন।"
"আচ্ছা, তাহলে এ ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাস করলে, আমি কি এটাই বলবো, নাকি আরেকটু কিছু বাড়িয়ে বলবো?"
"আমার মনে হয় না, উনি আপনাকে এ ব্যাপারে জেরা করতে যাবেন। কারণ তারা উনার লোক ছিল, একথা শুধু আমিই জানি। আপনাকে এমন কিছু জিজ্ঞাস করলে, আপনি উনার উপর সন্দেহ করতে পারেন। তাই আশা করি, আপনাকে ওদের ব্যাপারে কি জিজ্ঞাস করবেন না।"
"আর যদি কোনো কারণবশত জিজ্ঞাস করে বসেন?"
"তাহলে বেশি কিছু না; শুধু কেন জিজ্ঞাস করে, একবার সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন কিছুক্ষণের জন্য। এমন করলে উনি আর বেশি কিছু জিজ্ঞাস করবেন না।"
"আপনি সিওর তো?"
"জি, আমি এই গত কয়েকমাস ধরে, উনার বাসায় কাজ করে, উনার সম্বন্ধে ভাল করে জানতে পেরেছি। উনার চালাকির সম্বন্ধে আমার ভাল ধারণা আছে। আপনার টেনশন নেওয়ার কোনো বিষয় নেই।"
"আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি এতো দূর পর্যন্ত আসতে পেরেছি শুধুমাত্র আপনার সহযোগিতার কারণে।" এ বলার সঙ্গে সঙ্গে সে আমার হাত ধরে বসল, অতঃপর আরো বললো, "আমার পাশে থাকার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আশা করি কোনো একদিন আমিও আপনার পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবো।"
তার চোখের কোণ থেকে অশ্রুর ফোঁটা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। আশেপাশের ছাদের লোকেরা আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারা হয়ত মনে করছিল, আমরা দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা। তাই হাত সরিয়ে নিয়ে, চুপচাপ ছাদ থেকে নেমে পড়লাম। মেয়েটাকে কিছু না বলে, এভাবে নামা উচিত হয়নি। তবে আশেপাশের লোকে কি না কি ভাববে, তাই দ্রুত করে নেমে এলাম। তখন খেয়াল এলো; কীভাবে ট্রেনের মধ্যে তামান্নার উপর মেজাজ চড়ছিল, যখন সে আমাকে জিজ্ঞাস করেছিল, লোকে কি ভাববে। কিন্তু নিজের বেলায় আমি তত কিছু ভাবিনি। মনে এলো, তাই করে ফেললাম। দোষ কি আমার, নাকি আমার মনের? সেই মুহুর্তে যদি এ নিয়ে ভাবতে যেতাম, তাহলে সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। আর শেষমেশ যদি মনে হতো, এভাবে আসলেই হাত ধরে সবার সামনে দাঁড়ানো ঠিক হবে না, তাহলে তো নেমে পড়ারও অনেক দেরি হয়ে যেত। আমার বাবা বলতেন, "ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।"
কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ততক্ষণে না ভেবেই নেমে পড়াতে আরো উপকার হয়েছে। সময় বেঁচেছে অনেকটা। কিন্তু যতক্ষণ সেই নরম নরম হাত, আমার হাতকে সেভাবে ধরে রেখেছিল, ততক্ষণ মনে হচ্ছিল; এই স্পর্শে থেকে আমি সারাজীবন কাটাতে পারবো। যদি কোনো উপায় হতো তামান্নার ছোঁয়া আবার পাবার! যদি কোনো উপায় হতো আবার তার কাছে যাওয়ার! শুধু আবার নয়, বারবার সেই নরম ত্বকের স্পর্শ পেতে চাই। যদি এমন কোনো উপায় হতো তার সঙ্গে জীবনটা কাটানোর।
এমন বড় স্বপ্ন দেখেই জীবনটার বারোটা বাজিয়ে রেখেছি। আর কত? আর কত এমন স্বপ্ন দেখতে হবে, যা কখনও পূরণ করা সম্ভব না?
আমার সবচেয়ে বড় ভয় ছিল, আমি কি সত্যি সত্যি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম! আমি কি সত্যি সত্যি তাকে ভালবেসেছিলাম? কি এভাবে একদিনের মধ্যেই কাউকে ভালবেসে ফেলা আদৌ সম্ভব?
এ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট সাহেব একবার কিছু একটা বলেছিলেন।
উনি আমাকে জিজ্ঞাস করেছিলেন, "প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মধ্যে বিশ্বাস করো?"
সেসময় আমি উনার প্রশ্ন শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ থেমে উত্তর দিলাম, "না, করি না।"
"কেন করো না?"
"কারণ আমি কখনও প্রথম দেখায় কারো প্রেমে পড়িনি।"
"অন্য কাউকেও এভাবে প্রেমে পড়তে দেখনি?"
"জি, দেখেছি। কিন্তু আমি সেটাকে ভালবাসা নয়, বরং ভাললাগা মনে করি।"
"কি ভাললাগা ভালবাসারই অংশ নয়?"
"তা আছে। কিন্তু শুধু প্রথম দেখাতেই একজন সরাসরি ভালবেসে ফেলে কীভাবে?"
"যদি মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে বলি, তাহলে বলতে হবে; একজনের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের মাধ্যমে সময় কাটানোর ফলে মানসিকভাবে প্রভাবিত হওয়া যায়। এই প্রভাব পরবর্তীতে আকর্ষণ সৃষ্টি করে এবং সেটাই সময় যেতে যেতে, একসময় ভালবাসায় পরিণত হয়।"
"এই আকর্ষণকে কি ভালবাসা বলা যাবে? এটা শুধু স্বাভাবিক আকর্ষণও তো হতে পারে। স্বাভাবিক আকর্ষণ এবং ভালবাসার মধ্যে পার্থক্য বুঝব কীভাবে?"
উনি এর উত্তরে কোনো ব্যাখ্যায় না গিয়ে, শুধু মুচকি হেসে বললেন, "যেদিন নিজের সাথে হবে, সেদিন সবই বুঝতে পারবে।"
আজ আমি সেই প্রশ্ন নিজেকে করছি। আশা করি, এটা ভালবাসা নয়। কারণ যাকে ভালবাসা হয়, তাকে পাবার উপায় না থাকলে কষ্টের শেষ নেই। এসব ভাবতে ভাবতে দুপুরের কাজ সম্পন্ন হলো।
সেদিন বিকেলের দিকে অ্যাডভোকেট সাহেব তামান্নাকে ডাকলেন অফিস রুমে। সেখানে তাকে বললেন, কিছুদিন থেকে, কেসের জন্য যথাযথ প্রয়োজনীয় সকল তথ্য দিয়ে সাহায্য করার পর বাড়ি ফিরতে। তামান্না এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। অতঃপর তার বাসায় ফোন করে, তার অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিল অ্যাডভোকেট সাহেবের। এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে, এক আশার আলো দেখা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এবার অ্যাডভোকেট সাহেব এই কেস হাতে নিয়েছেন বলে এই কেস একমাত্র তামান্না জিতবে। সেদিন ছিল মাস শেষের তারিখের চারদিন আগের তারিখ। অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, "এই শুনো, কিছুদিন পর গাড়ির ফিটনেস চেক করাতে পাঠাতে হবে। ড্রাইভারকে গিয়ে বলো, পাশের গ্যারাজ থেকে সব চেক করে আনতে।"
"জি।" বলেই, গিয়ে ড্রাইভারের কাছে সব বুঝিয়ে এলাম। ড্রাইভার ঠিক সেভাবেই গিয়ে গাড়ির সবকিছু পরীক্ষা করে আনল। তবে ড্রাইভার এসে বলছিল, পুরাতন ব্রেক নষ্ট হয়ে যাবার কারণে নাকি নতুন ব্রেক লাগাতে হবে। যার কারণে গাড়িটার ফিটনেস আপাতত একটু খারাপ অবস্থায় আছে। পরবর্তীতে নতুন ব্রেক লাগানোর জন্য টাকা নিয়ে যেতে বললেন অ্যাডভোকেট সাহেব। তখনকার সময়ে বিষয়টা বেশ সামান্য মনে হয়েছিল। কিন্তু পরের দিন দেখলাম একটা খামে করে চেক পাঠালেন ড্রাইভারের হাতে। ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যের ছিল। কারণ অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছে বাসায় সবসময়ই নগদ টাকা থাকে। উনি প্রতি কেসের জন্য প্রতিনিয়ত যেই টাকা পেয়ে থাকেন, সেটা প্রতিনিয়ত ব্যাংকে জমা রাখার সুযোগ পান না। হঠাৎ করে নগদ টাকার এতই সংকট পরে গেল যে এখন চেক ব্যবহার করতে হচ্ছে! এত অদ্ভুত ব্যাপারটা চোখে ধরা পড়া সত্ত্বেও চোখ বন্ধ করেই মেনে নিয়েছিলাম। কারণ আমার জন্য অ্যাডভোকেট সাহেবের কাজের পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। মেজাজ প্রায়ই খিটখিটে থাকতো। এমতাবস্থায় এমন সব প্রশ্ন জিজ্ঞাস করে, উনাকে বিরক্ত করতে চাচ্ছিলাম না। উনার কাজের চাপ কিছুটা কমানোর জন্য তামান্নাও উনার অফিসের বাদবাকি কাজে সহায়তা করে দিচ্ছিল।
সকালে উঠে উভয়ের জন্য চা রেঁধে, কাচ্চা বিস্কুটের সঙ্গে, নিজের হাতে তাদের আপ্যায়ন করার মধ্যে এক আলাদা স্বাদ ছিল। আমি নিজের জন্য এক কাপ চা না বানালেও, তামান্না আমায় কাছে ডেকে নিয়ে, তার নিজ হাত দিয়ে চায়ে ডোবানো বিস্কুট খাওয়াত।
আমি প্রথমে খাওয়ার রুচি না থাকার ভাণ করতাম, এরপর এক মুচকি হেসে ঝটপট মেনে যেতাম। আমার এই ঢং দেখে সে কিছুক্ষণ হাসতো, পরে অনেক আদরের সঙ্গে সেই চায়ে ভেজা বিস্কুট আমার মুখে তুলে দিত।
এমন আনন্দময় সময় কাটতে কাটতে, অবশেষে এলো আলাদা হয়ে যাবার সময়। তামান্নার বাড়িতে ফেরার দিন তো আর কোনো কিছুতেই মন বসছিল না। সেদিন সকালের নাশতা থেকে শুরু করে, সারাদিনে ঠিকমতো এক গ্লাস পানিও পান করিনি। তৃষ্ণার্ত ছিলাম, কিন্তু পানির জন্য নয়, তার দেখা পাবার জন্য। তামান্না সেদিন সকাল থেকে ছিল কোর্টে। সেদিন সকালের চাও খেয়ে যায়নি। আমি সারাটা দিন অপেক্ষায় ছিলাম। সে দুপুরের শেষের দিকে ফেরত আসার পর জানা গেল, কথা বলারও তেমন একটা সময় নেই। এমনকী তারা আসার পথে, গাড়ির টায়ার ফেটে যাওয়ার কারণে, গাড়ি থেকে নেমে, সিএনজি করে আসতে হলো। এই অতিরিক্ত দেরির কারণে এখন দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলারও তেমন সুযোগ নেই। তামান্না গোসল করতে গেল, অতঃপর গাড়ি গ্যারাজ থেকে নতুন চাকা লাগিয়ে ফেরত এলো। অ্যাডভোকেট সাহেব ডেকে বললেন, "তুমি চাইলে তার সঙ্গে যেতে পারো। এখনও তোমার সুযোগ রয়েছে। টাকার ব্যাগ নিয়ে, তার সঙ্গে বাড়িতে চলে গেলে, তুমি আমার দাসত্ব করার থেকে বাঁচতে পারো। আমি কাজে রাখার জন্য নতুন কাউকে নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করে নেব।" এরপর আমার বাম হাতে, নিজের ডান হাতের দ্বারা হাত বুলোতে বুলোতে আরো বললেন, "আমার কারণে তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে, বাবা। তুমি এই সুযোগটা হাতছাড়া না করে, তামান্নার সঙ্গে চলেই যাও।"
আমি উনার কথাগুলো শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। আমার বিবেকে সেই দাসত্বের উক্তিটি বেঁধে গেল। আমি এমন একটা লোককে এই অবস্থায় রেখে কিভাবে যেতে পারি? আমি উনাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে দিলাম, "আমি নিজেকে কখনও আপনার দাস ভাবিনি। কারণ আপনি আমার এবং আমার পরিবারের জন্য যা কিছু করেছেন, তা তো আমি জীবনেও পরিশোধ করতে পারবো না। আর পরিশোধের চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের মাঝে বিদ্যমান সম্পর্ক। আমি ঐ আঠারো কোটি টাকার প্রতি আর লোভ রাখি না। আর সেটার দ্বারা নিজের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার মতো ইচ্ছেও আমার মধ্যে আর নেই। আমি এবং আপনি এখন অনেকাংশে পরস্পরের পরিপূরক। তাই এমন কাউকে রেখে চলে যাওয়া শুধু অমানুষিক না, বরং অযৌক্তিক এক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।"
এগুলো বলে শেষ করলাম, আর তামান্না পরিপাটি হয়ে এসে পড়ল। সেই ঠিক সেই জামাটাই পড়েছিল, যেটা আমাদের প্রথম দেখায় পরিধান করে ছিল। তাকে এমন অবস্থায় দেখে আমি সেখানেই মুগ্ধ অবস্থায় তাকিয়ে রইলাম। আমার চোখ তার মাথার চুল থেকে শুরু করে, তার পায়ের নখ পর্যন্ত প্রত্যেকটি অঙ্গের আনাচেকানাচে দেখেই যাচ্ছিল। তাকে এক ঝলক দেখেই আমার সারাটা দিনের তৃষ্ণা মিটে গেল। তার কাছে গিয়ে, তার হাত থেকে তার ব্যাগ নিয়ে বললাম, "দেন, আমি নিয়ে নামি।"
"না। না। ওত ভারি না।" বলে ব্যাগ তার হাতে ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করছিল।
তখনই এক মুচকি হেসে বললাম, "এই শেষবারের মতো কিছু করতে চাই। দয়া করে এতটুকু করবার সুযোগ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবেন না।"
এতে সে একটা পাল্টা মুচকি হেসে বললো, "ঠিক আছে। চলেন।"
নিচে নামার পর ড্রাইভারকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। খুব সম্ভবত আশেপাশের কোনো টংয়ের দোকানে ধূমপান করতে ব্যস্ত ছিল। এই সময়টুকু আমি আর তামান্না সেখানে পুরোপুরি একা দাঁড়িয়ে ছিলাম।
ঠিক এমতাবস্থায় সে আমাকে জিজ্ঞাস করে বসল, "আপনি আমাকে পছন্দ করেন?"
লজ্জার কারণে গাল দুটো লাল হয়ে গেল। মুখখানা লুকানোর চেষ্টা করে, মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "না তো! হঠাৎ কি জিজ্ঞাস করছেন এসব?"
"হঠাৎ করে না। অনেক ভেবেই বলছি।"
"কি ভাবলেন এমন?"
"আপনি আমার দিকে যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন যখন আমরা গাড়িতে ছিলাম। ডিটেকটিভ সাহেব যখন বিদায়ের কথা উল্লেখ করলেন, আপনার চেহারার রং নেমে গিয়েছিল। দুঃখ আপনার চেহারায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।"
"আজব তো! এতে দুঃখ পাওয়াটা কি এতটাই অস্বাভাবিক কিছু? একসঙ্গে এভাবে সময় কাটানোর পর কি কারো দুঃখ পাওয়ার কথা না? এর কারণ কি শুধু প্রেম হতে পারে? বন্ধুত্ব একটা কারণ হতে পারে না?"
"বন্ধু যখন মনেই করেন, তাহলে এতটাও বোঝেন না যে বন্ধুরা সবই বোঝে, বন্ধুর মনে কি চলছে না চলছে?"
এ কথাগুলো শুনে, মুচকি হেসে বললাম, "এগুলো তো সবাই বলে। তবুও তো বন্ধুদের মাঝেই তো ভুল বোঝাবুঝি হয়। আপনার ধারণাও তারই অন্তর্ভুক্ত।"
"ভুল বোঝাবুঝি যাতে না হয়, সেজন্যই আপনাকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাস করা।"
"যাক্! আশা করি উত্তর পেয়ে গিয়েছেন।"
"না। মোটেও পাইনি। আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এতক্ষণ নিজের প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আমার প্রশ্ন যেমন সরাসরি করা হয়েছিল, তার উত্তরও ঠিক তেমনিই সরাসরি চাই।"
"প্রশ্নটা ভিত্তিহীন। বাদ দিন। অন্য কথা বলি।" এ ছিল প্রশ্নটা এড়িয়ে চলার আমার ব্যর্থ চেষ্টা। কিন্তু সে ছিল নাছোড়বান্দা। উত্তর চাই তো চাই, তাও আবার মনমতো।
"উত্তরে তো শুধু হ্যাঁ বা না বলবেন, এতে এতো কষ্ট হবার তো কথা না।"
আমি মাটির দিকে তাকিয়ে নিম্ন স্বরে জিজ্ঞাস করলাম, "কষ্ট তো উত্তর দেওয়াতেই। হ্যাঁ এবং না হলো বাংলা ভাষার সবচেয়ে ছোট দুটো শব্দ, কিন্তু এর ভার ভীষণ মাপের।" এ বলতে বলতে মুঠো কষতে লাগলাম। যতো দুঃখ, যতো কষ্ট, সব ঐ মুঠোয় চেপে দিচ্ছিলাম। এমনটা করে কষ্টটা না কমলেও অন্তত আরেক কষ্টের দ্বারা নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায়। যেভাবে পাথর কাটে পাথরকে, তেমনি এই সামান্য কষ্টের মাধ্যমে বড় কষ্টটা দমিয়ে ফেলতে চাচ্ছিলাম। ঠিক এমন মুহূর্তে সে নিজেই বলে উঠল, "আপনি আমাকে পছন্দ করেন বা না করেন, আমি এই কিছু সময়ের মধ্যেই আপনার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। বহুদিন ধরে বলার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সাহস জোটাতে পারিনি। আজ বিদায়ের সময় সাহস করে বলেই ফেললাম। এরপর বাকিটা আপনার ইচ্ছা।" বলে লজ্জায় মুখ লুকোতে লাগল।
আমি তখন হতবাক অবস্থায় জিজ্ঞাস করলাম, "আপনি নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে মজা করছেন, তাই না?"
"না। মোটেও না। আমি আমার সঙ্গে বাকিটা জীবন কাটাতে চাই। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব।"
"আমার মতো নীচু শ্রেণীর একজন কাজের লোকের মধ্যে এমন কি দেখলেন?"
"আপনার মধ্যে আমি সুখ খুঁজে পাই। সেদিন যখন কষ্টে আপনাকে জড়িয়ে রয়ে ছিলাম, তখন আপনে আমাকে খুব সযত্নে ধরে রেখেছিলেন। এমন যত্ন আমি আজ পর্যন্ত কারো কাছে পাইনি। আপনার মনের বিশুদ্ধতা; আপনার দেহের সঙ্গে আমার সংস্পর্শ বাবদ কিছু করার চেষ্টা না করার মধ্যেই জানতে পেরেছি। আর আপনি সেদিন যেভাবে আমার জীবন বাঁচালেন, তা না বললেই নাই।"
"এসব কি জীবনে চলার জন্য যথেষ্ট, বলেন? আপনি একজন শিক্ষিত মেয়ে। একজন অশিক্ষিতের সঙ্গে সংসার করা কি আপনাকে মানাবে?"
"আপনি নিজেকে অশিক্ষিত হিসেবে দাবি করে ফেললেন, কিন্তু আমার প্রতি আপনার আচরণে আমি শুধু সুশিক্ষার উদাহরণ দেখতে পেয়েছি।"
"তা কিভাবে?"
"শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যগুলোর একটি হচ্ছে নৈতিকতা। আমাকে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে অসংখ্য ছেলে আমার সঙ্গে ভালবাসার নাটক করেছে। তারা প্রথমে ভালবাসার বড় বড় দাবি করে। পরবর্তীতে তারা তাদের সঙ্গে শোবার জন্য নিজের বিছানায় আসার আহ্বান দেয়। আমি মানা করলে, তারা আজেবাজে ভাষায় গালিগালাজ করে, নিজের মিথ্যে ভালবাসার প্রমাণ দিয়ে দেয়। আপনি চাইলেই আমাকে যেকোনো সময় স্পর্শ করার চেষ্টা করতে পারতেন। কিন্তু এমনটা না করে, আপনি নিজের নৈতিক শিক্ষার প্রমাণ দিয়েছেন।"
"ওসব ঠিক আছে। কিন্তু..."
"কিন্তু কি?"
"আপনি এতো অল্প সময়ে কিভাবে আমাকে ভালবেসে বসলেন?"
"কেন? ভালবাসার কি কোনো নির্দিষ্ট সময় আছে নাকি? আমি ভালবেসে বসেছি। এর চেয়ে বেশি আমার আর কিছুই বলার বা বোঝাবার নেই।"
আমি স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে, এক মুচকি হেসে বললাম, "জি, এটাই জানার বাকি ছিল। কারণ..."
"কারণ কি?"
"কারণ আমারও কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছিল, আমি আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি।"
একথা শুনে সে আনন্দে মেতে উঠল। আমার চোখে চোখ রেখে, আমার দু হাত একসঙ্গে ধরে, কাছে টেনে জিজ্ঞাস করল, "সত্যিই তো?"
আমি সরাসরি তার চোখে তাকিয়ে, মিষ্টি সুরে বললাম, "হ্যাঁ, সত্যি।"
এমন সুন্দর মুহূর্ত চলাকালীন সময়ে ড্রাইভার ফিরে এলো। এসে গাড়িতে বসেই বলা শুরু করল, "আরে ম্যাডাম, তাড়াতাড়ি চলেন, নাহলে দেরি হয়ে যাবে।"
"আচ্ছা, আসছি।" বলেই হাত ছেড়ে, গাড়িতে বসে পড়ল তামান্না।
সেই হাত ছাড়াটার যেই কষ্ট, তা সেই ভাল জানে যে কখনও তা অনুভব করেছে। গাড়ি যাওয়ার সময় পেছন থেকে তাকিয়ে রইলাম। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সেও গাড়ির কাঁচের ওপাশ থেকে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। আর এটাই ছিল তামান্নার সঙ্গে আমার জীবনের শেষ দেখা।
আমি বাসায় গিয়ে তাকে নিয়ে ভাবতে লাগলাম। হাতে ফোনটা নিয়ে, তার ফোন নাম্বার বের করে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। তার নামের বানানের প্রত্যেকটা অক্ষরে তার চেহারা দেখতে পেলাম। আমার মন খুশিতে এতটাই ডুবে গিয়েছিল, যে আমার তৃষ্ণার কথা আমি নিজেই ভুলে গিয়েছিলাম। শুধু তার নাম্বারের ওপর চোখ বুলিয়ে বুলিয়ে হেসেই যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে তার সঙ্গে ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে লাগলাম। কল্পনায় দেখি; আমাদের ছোটখাটো একটা বাসা। বাসায় শুধু আমরা এবং আমাদের দুই সন্তান। বাচ্চাদের ঘুমোনোর পর, তার সঙ্গে প্রতিটা রাত আড্ডা দেওয়া। প্রতিটা সকাল উঠে, বিছানায় তাকে পাশে পাওয়া। আমি বাজার নিয়ে আসার পর তার কাছে হিসাব দেওয়া। প্রতি বছর আমাদের বিয়ের বার্ষিকীতে দেশেবিদেশে ঘুরে ঘুরে হানিমুন পালন করা। বাসার ছাদে একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজা। তার সঙ্গে সুখদুঃখের সময় কাটাতে বৃদ্ধ বয়সে পা রাখা। পরস্পরের হাতে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে, মৃত্যুর অপেক্ষা করা। কিন্তু মৃত্যু সেসবের আগেই আমাদের দরজায় হাজির হলো।
এসব কল্পনার জগৎ থেকে বের হয়ে, পানি খেতে গেলাম রান্নাঘরে। পানির গ্লাস হাতে নেবার সঙ্গে অ্যাডভোকেট সাহেব উচ্চস্বরে ডাক দিয়ে উঠলেন।
তাদের রওনা দেওয়ার ঘণ্টাখানেক পর জানতে পেলাম হাড় কাঁপানো এক সংবাদ।
তামান্না যেই গাড়িতে ছিল, সেটা একটা ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। তামান্না এবং ড্রাইভার সহ আশেপাশের সাধারণ পথচারীও আহত হয়েছে। আমি এ সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে পড়লাম হাসপাতালে। তদন্ত চলছিল বলে, আমাকে অপারেশন থিয়েটারের ধারেকাছেও যেতে দেয়নি। আমি অসহায়তায় সেখানে বসেই কাঁদতে লাগলাম। অনেকক্ষণ পর ডাক্তার বের হয়ে বললো, গাড়ির ভেতরে যারা ছিল, তাদের কেউ বাঁচেনি।
সেই মুহূর্তে আমি গলা ফাটিয়ে এক চিৎকার দিলাম। আমার চিৎকারের গুঞ্জন গোটা হাসপাতালের সকলে শুনতে পেয়েছিল, কিন্তু আমি নিজে তা শুনতে পাচ্ছিলাম না। কারণ আমার কানে তখন শুধু তার মিষ্টি কন্ঠের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আর সেই কন্ঠের চিরনীরবতায় আমি স্বল্পকালের জন্য আমি বধির হয়ে পড়েছিলাম। শুধু তা নয়, বরং পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মন একটা মুহূর্তের জন্যও তা মানতে চাচ্ছিল না, আর আমার মস্তিষ্ক তা স্মরণ করানো বন্ধও করছিল না।
সেই হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে পড়ে রইলাম। দারোয়ানেরা আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল।
সেখানে মেঝেতে গড়াতে গড়াতে ছটফট করছিলাম। ডাক্তার সাহেব এসে, আমার অবস্থা দেখে বললেন, আমার চিকিৎসার দরকার আছে। আমার নিস্তেজ দেহটা তুলে, হাসপাতালের এক বিছানায় রাখা হলো। আমার দেহের ছটফট দেখে, আমাকে ইনজেকশন দিয়ে বেহুঁশ করে নেওয়া হয়। বেহুঁশ করার ইনজেকশন শরীরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে চোখে সবকিছু ঘোলাটে দেখতে লাগলাম। চোখ খোলার পর দেখি; সেই বিছানার পাশে বসে আছেন অ্যাডভোকেট সাহেব। আমি উঠতে নেব, এমতাবস্থায় দেখি, আমার হাতে স্যালাইনের টিউব লাগানো।
অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছে, ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে বললাম, "আমি না... অনেক ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নে দেখি; তামান্না নাকি আর... আমাদের... আমাদের মাঝে আর নেই...!" এরপর কান্নায় ভেঙে জিজ্ঞাস করলাম, "এটা শুধু স্বপ্নই ছিল না?"
অ্যাডভোকেট সাহেব নির্বাক আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কিছু না বলে, শুধু আমার কাঁধে হাতে বুলোচ্ছিলেন। আমি উনার এই প্রতিক্রিয়া দেখে মনে মনেই মরে গেলাম। আমার মধ্যে বেঁচে থাকার সকল ইচ্ছে সেখানে, সেই মুহূর্তে শেষ হয়ে গেল।
পরের দিন হাসপাতাল থেকে ফিরে আসলাম বাসায়। আসর আগে অনেক হাতেপায়ে ধরে অনুরোধ করলাম অন্তত তার মৃতদেহ একবার দেখার সুযোগের জন্য। কিন্তু পুলিশ তার মোটেও কোনো অনুমতি দিল না। আমি বাসায় এসে আগের মতই আবার কাজে লেগে পড়লাম। জগতের জন্য আমি বদলে গেলেও, জগৎ আমার জন্য একটা বিন্দুমাত্র বদলে যায়নি। আমাকে নিজের দায়িত্ব তো পালন করতেই হবে। যদিও অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে কিছুদিনের ছুটি নেওয়ার জন্য জোর করছিলেন, আমি তা মেনে নেইনি। আমি ভাবলাম; কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখলেই তাকে ভুলে যাওয়াটা আরো সহজ হয়ে পড়বে। কিন্তু শরীরের দ্বারা শরীর কাজ করাতে থাকলেই যে মন নিজের কাজ ভুলে যাবে, সেটা ছিল আমার এক ভ্রান্ত ধারণা। মনের কাজই হলো সেগুলো কথা বারবার স্মরণ করানো, যা মানুষ ভুলে যাবার চেষ্টায় রয়েছে। মনের এই কাজটা নিতান্তই স্বাভাবিক। কারণ মন হলো সেই অবুঝ শিশুর মতো, যাকে যত বেশিই মানা করা হোক, সে মানতে রাজি হয় না। অনেকের মন আবার বহুসময় পর কিছু শিখতে পায়। তখন মন সেই কথাগুলো আর চোখের সামনে তুলে ধরে না। আফসোস! আমার মন এতো ভদ্র নয়।
তাকে যতই বলি ভুলে যেতে, সে রেখে দিয়েছে সব নিজের মাঝে মাটি চেপে। বলার আর কিছুই নেই তাকে, সেও অসহায় হয়ে প্রেমে পেছনেই লেগে থাকে।
সময় আমার চলছে যতই খারাপ, আমার মনই আমার একমাত্র সঙ্গী হয়ে দাঁড়াক।
আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে শুধু একটাই কথা ভাবি, সবই কি শেষ হয়ে গিয়েছে নাকি রয়েছে আরো কিছু বাকি?
রাতে কিছু খাচ্ছিলাম না বলে অ্যাডভোকেট সাহেব জিজ্ঞাস করলেন, "কি ব্যাপার? খাবার রুচি নেই?"
"না, নেই।"
"তুমি খেলে যদি মেয়েটা ফিরে আসত, তাহলে আমি এখন তোমার সঙ্গেই না খেয়ে বসে থাকতাম। তোমার যেমন কষ্ট হচ্ছে, তেমনিই আমারও হচ্ছে। তা বলে কি এভাবে সবকিছু ছেড়ে বসে পড়লে চলবে?"
"দয়া করে আপনার কষ্টের সঙ্গে আমার কষ্ট তুলনা করবেন না। আমার মনের ভেতর এখন কি পরিমাণের কষ্ট হচ্ছে, তা আপনি আন্দাজ করতে পারবেন না।"
"আমরা দুজনই তার খুব আপন হয়ে গিয়েছিলাম। আমিও তার সঙ্গে যথেষ্ট সময় কাটিয়েছি। সে আমার মেয়ের মতো ছিল।"
"মতো! হুহ! কি ফালতু একটা শব্দ! আপনার মেয়ের মতো ছিল, এটার মানে আপনার আপন মেয়ে ছিল না। কোনো কিছু যদি অন্য কোনো কিছুর মতো হয়, তাহলে তো পার্থক্যটা সেখানেই হয়ে গেল। আপনার কাছে সে শুধু সে আপনার মেয়ের মতোই ছিল, কিন্তু আমার জন্য কোনো মতো ছিল না।" বলে চিৎকার করে উঠলাম। তারপর সেই উচ্চস্বরে আরো বললাম, "তাকে মনেপ্রাণে ভালবাসি আমি। সেই আমার, সে আমার প্রেমিকা ছিল। তাকে কি করে এতো সহজেই ভুলে যাই?"
অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে শান্ত করলেন। আমি সেই রাত উনার কাছে সমস্ত ঘটনা বললাম। কোনো কিছু গোপন রাখিনি। কারণ গোপন রাখার উদ্দেশ্যই আর ছিল না।
সপ্তাহখানেক যাওয়ার পর তদন্তের রিপোর্ট আসলো। রিপোর্টে জানা গেল, দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ব্রেক ফেইল হবার কারণে। এ ব্যাপারটা জেনে প্রথম প্রথম আমার এতো আশ্চর্যজনক লাগেনি। কিন্তু পরে মনে আসলো, গাড়িতে তো কিছুদিন আগেই নতুন ব্রেক লাগানো হয়েছিল। তখন আমি কিছুটা সন্দেহ করতে লাগলাম। বাজার আনার সময় আমি ফোন করলাম ডিটেকটিভ নিজামকে। উনাকে ফোনে সব বলার পর উনি এই মামলায় তদন্তের দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে নিলেন।
এদেশের পুলিশ সাধারণত এসব কাজে তেমন গুরুত্বপূর্ণ দেয় না। একটা সামান্য ব্রেক ফেইল হবার কথা জানাতেই এতো সময় লাগল। তাই তাদের উপর নির্ভর না করে, এমন কারো কাছে গেলাম যার কাজকে সে মনেপ্রাণে ভালবাসে এবং যে কোনোভাবেই সত্যকে খুঁজে বের করবে। ডিটেকটিভ নিজাম নিজের মতো তদন্ত চালিয়ে গেলেন এবং এদিকে দেখি অ্যাডভোকেট সাহেব তামান্নার বোনের কেস অন্য এক উকিলের হাতে দিয়ে দিলেন। কারণ জানতে চাইলে অজুহাত দিলেন, উনার কাছে কেসটা লড়ার কোনো ইচ্ছে নাই। কারণ এই কেসটার ব্যাপারে চিন্তা করলেই নাকি উনার তামান্নার কথা মনে পড়ে যায়।
প্রথম প্রথমে একথা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হলেও, সন্দেহ তখন হলো যখন জানতে পেলাম এই নতুন উকিল একেবারেই কাঁচা। লোকটা এই পেশায় আসার দুদিনও হয়নি। এমনকী এটাই ছিল তার প্রথম কেস। আমি অ্যাডভোকেট সাহেবকে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে উনি বলেন, লোকটা তার অধীনেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তার ওপর নাকি উনার যথাযথ বিশ্বাস আছে।
এমন সামান্য কিছু অজুহাত দেখে আমার সন্দেহের মাত্রা ধীরে ধীরে বেড়েই গেল। আমি প্রতিনিয়ত এ ব্যাপারে ডিটেকটিভ নিজামকে জানাতে থাকলাম।
একদিন উনি আমাকে বাজারে ডেকে একটা ছোট মাইক্রোফোন দিয়ে বললেন, "আপনি এটা কোনো এক সময় করে উনার ডেস্কের নিচে লাগিয়ে দিবেন। আমি আমার এক জুনিয়র অফিসারকে দায়িত্ব দিলাম এই বাসার নীচে দাড়িয়ে থেকে সবকিছু শুনতে। আর আপনাকেও একটা দায়িত্ব দিতে চাই। আপনার যেসব বিষয় নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে, সেসব নিয়ে উনার কাছে প্রশ্ন করেই যাবেন। সারাদিনে যখনই উনাকে সেই ডেস্কে বসা দেখবেন, তখনই গিয়ে এসব প্রশ্ন করে বিরক্ত করে ফেলবেন।"
ডিটেকটিভ নিজামের কথা অনুসারে আমি দিনের পর দিন অ্যাডভোকেট সাহেবকে এ নিয়ে বিরক্ত করতে লাগলাম। প্রত্যেক বার আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতেন, নাহলে একই অজুহাত দিয়ে কথা শেষ করে দিতেন।
বহুদিন গেল এমন। এর মাঝে এক রাতে, অন্ধকারে চোখ খোলা রেখে, উপরের দিকে তাকিয়ে তামান্নার সঙ্গে কথোপকথনের দৃশ্য কল্পনা করছিলাম।
কল্পনার মধ্যে তাকে আমি বলছি, "আপনার আমার ভালবাসা তো ব্যর্থ হয়ে গেল। এখন তো মানবেন, আপনার আর আমার মাঝে সম্পর্কটা কতো অবাস্তবিক ছিল? নাকি এখনও বলবেন, আমাকেই ভালবাসেন?"
"এখনও আপনাকেই ভালবাসি।"
"কিন্তু কেন? একটা সিংহাসনে বসার অধিকার রয়েছে শুধু একজন রাজার, অন্য কারো নয়। অন্য লোকদের জন্য রয়েছে কেদারা। সামান্য মানুষের জন্য সামান্য কেদারাই যথেষ্ট।"
"বাহ্! খুব সহজেই দেখি আমাকে একটা বস্তুর সঙ্গে তুলনা করে ফেললেন! এমন এক বস্তু যার অস্তিত্ব হলো অন্যের মর্যাদা বৃদ্ধি করা। তাছাড়া আর কিছুই না।"
"আপনাকে সিংহাসন বলে খারাপ কি বলেছি? এর দ্বারা আপনার যোগ্যতা বুঝিয়েছি।"
"যদি যোগ্যতার কথাই বলেন, তবে রানীর উদাহরণ বেশি মানাতো। কারণ একজন রানী একটা সিংহাসনের মতো একটা তুচ্ছ ব্যবহারের বস্তু হয় না। একজন রানীর মন জয় করতে হলে, একজন রাজাকে যথাযথ যোগ্য হতে হয়। তাছাড়া সবচেয়ে ব্যাপার হচ্ছে, একজন রানী তার ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে। অর্থাৎ সে তার পছন্দের মতো একজন স্বামী বেছে নিতে পারে যা একটা সিংহাসনের পক্ষে কখনওই সম্ভব না। কারণ একটা সিংহাসনে একজন অযোগ্য ব্যক্তি বসে গেলেও সে রাজা হতে পারে না, আর তার উপর বসার প্রকৃত যোগ্য প্রার্থী সে নিজে নিজে বেছে নিতে পারে না।" আমার নীরবতা দেখে আমায় জিজ্ঞাস করলো, "কি হলো, জনাব? আমার কথাগুলো শুনে দেখি মুখ থেকে আর কথা বেরচ্ছে না!"
"আপনি বলতে থাকুন। আমি শুনেই রাতটা কাটাবো। আপনার কণ্ঠ আমার কানে যতটা মূল্যবান, সারা বিশ্বের সব ধনসম্পত্তি তার তুলনায় তুচ্ছ।" বললাম এক মুচকি হেসে।
"শুধু আমি বলে যাবো, আর আপনি শুনেই যাবেন! এই অধিকার কি শুধুমাত্র আপনার একার? কি আমার এমন অধিকার নেই? কি আমার মন চায় না, আপনার বলা না বলা কথাগুলো শুনতে?"
এ শুনে আমার চোখে পাশ দিয়ে অশ্রুর ফোটা এক এক করে গড়াতে শুরু হলো, "যদি এতই মন চায়, তাহলে ছেড়ে গেলেন কেন?"
"আমি তো ইচ্ছা করে যাইনি।" বলে সে আমার কাছে এলো। নিজের গোলাপি ওড়না দিয়ে আমার অশ্রুগুলো মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তখনই কল্পনা আর বাস্তবতার মাঝে বিদ্যমান পার্থক্যটা আবার মনে এসে পড়ল। সে যতই চেষ্টা করুক সেই অশ্রুগুলো মোছার, আমার কল্পনায় সেই ক্ষমতা নেই তার দ্বারা এ কাজটুকু সম্পন্ন করার। আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে নিলাম। এমন বন্ধ চোখে যে কখন ঘুম এসে পড়ল, কিছুই বুঝতে পেলাম না।
সকালে চোখ খুলে দেখি; উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে। অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে একটা ডাকও দেননি। আমি ঝটপট উঠে, নাশতা তৈরি করতে গেলাম। অতঃপর চায়ের ট্রে নিয়ে গেলাম উনার অফিস রুমের দিকে। আমি হঠাৎ করে ঢুকে পড়ায়, অ্যাডভোকেট সাহেব চমকে গেলেন। উনি তখন ফোনে কথা বলছিলেন। চমকে যাওয়ার ধরণ দেখে বুঝতে পারছিলাম, আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু শুনে ফেলেছি কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়া আমার আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোনে, "আচ্ছা এখন রাখি।" বলে ফোন রেখে দিলেন।
আমি সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেলাম প্রশ্ন করে বিরক্ত করার। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে জিজ্ঞাস করলাম, "ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন?"
আমার থেকে চোখ এড়িয়ে উত্তর দিলেন, "আছে এক মক্কেল। তার কেস নিয়ে কিছু কথা বলতেই ফোন করেছিল।"
"ওঃ আচ্ছা! আপনার সেই ছাত্রকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন তো? কেস কিভাবে লড়তে হবে, কি কি দলিল লাগবে, সব বলেছেন তো?"
"অবশ্যই। তারও যথেষ্ট দায়িত্ববোধ রয়েছে। সে এই কেস নিয়ে কোনো অবহেলা করবে না।"
"আচ্ছা! ঐ মক্কেলের মামলা কি নিয়ে?"
"কার? যার সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলাম? সে তো বড়ই টেনশনে আছে। এই কেস হেরে গেলে, তার অনেক ক্ষতি হবে। তাই বারবার ফোন করে জিজ্ঞাস করতে থাকে, কাজ কেমন চলছে? কেস জিতবে তো? আরো কোনো দলিলপত্র লাগবে কি না? এসব টুকটাক ব্যাপার নিয়ে।"
"লোকটার কি আপনার ওপর আস্থা নেই?"
"আছে। অবশ্যই আছে। না থাকলে কি কেউ এতো বিশাল একটা কেসের দায়িত্ব দেয়?"
"আচ্ছা! আমি কিছু কিছু কথা শুনে ফেলেছি। উনার কেস কি কোনো হত্যাকাণ্ড নিয়ে?"
অ্যাডভোকেট সাহেবের চেহারায় আতঙ্কের ছাপ দেখা যাচ্ছিল। ভুরুকুঁচকে বললেন, "হ্যাঁ। মার্ডার কেস। একজন ক্রিমিনাল লয়ারের কাছে মার্ডার কেস নিয়ে আসাটা স্বাভাবিক।" এ বলে চায়ের কাপ হাতে তুললেন। চায়ের এক চুমুক নিয়ে আরো বললেন, "এসব কথা বাদ দাও। সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ! জীবনটা পুরোপুরি কাজের দাস হয়ে গিয়েছে। তবে তোমার এখন কি খবর, বাবা? ঘুম ঠিকমতো হয়েছে তো?"
"জি, হয়েছে। তবে স্বাভাবিকভাবে ঘুমোতে পারি না। অশ্রুর সাহায্য লাগে।" বলে একটা জোরপূর্বক হাসি দিলাম।
"তোমাকে আরো আগেই ঘুম থেকে ওঠাতাম। কিন্তু ভাবলাম; থাক্! তোমার জন্য বেশ অশান্তির সময় যাচ্ছে। অন্তত ঘুমে তো কিছুটা শান্তি পাবা। এ ভেবে আর ডাক দিলাম না।" চায়ের আরেক চুমুক নিয়ে বললেন, "তবে এবার বড় ক্ষিদে পাচ্ছে। একটা তাড়াতাড়ি করে নাশতা নিয়ে আসো তো।"
"জি, নিয়ে আসি। কিন্তু যাওয়ার আগে ছোট্ট একটা অনুরোধ।"
"কেমন অনুরোধ?"
"আমি মদ খেতে চাই। এই শহরে মদ কোথায় পাবো, একটু বলে দিতে পারবেন?"
রাগান্নিত স্বরে বললেন, "কি বলছো এসব? মাথা ঠিক আছে তো? মদ খেতে চাও এখন!" ডেস্কের উপর হাত দ্বারা একটা বারি দিয়ে আরো বললেন, "এসব কেন? ঐ মেয়েটার জন্য? সে কি কখনও চেয়েছিল যে তুমি মদ খাবে? সে কি তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে অনেক খুশি হতো? উত্তর দাও না কেন? বলো!"
আমি মাথা নত রেখে বললাম, "তাহলে আপনিই বলুন, আমি আর কি করব? তার মনে আসা তো কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। চোখের সামনে শুধু তার চেহারাটা ভাসে। শুনেছি, মদ খেলে নাকি কষ্ট ভোলা যায়! আমি এখন এ ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।"
"উপায় থাকতেও যদি উপায় না দেখো, তাহলে কিভাবে চলবে, বলো? তুমি যদি প্রকৃতপক্ষে তাকে ভালবেসে থাকো, তাহলে নিজেকে তার পছন্দের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করো। সে কখনই তোমাকে এমন মাতাল অবস্থায় দেখতে চাইবে না। তাই এসব করে নিজের জীবন এবং তার স্বপ্ন, দুটো একসঙ্গে নষ্ট করে দিও না।"
এ কথাগুলো উনি মন থেকে বলছিলেন তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। আমি উনার সঙ্গে যথেষ্ট সময় কাটানোর পর, এখন উনার সব নাটক বুঝি। তাই আমার প্রতি উনার যেই সহানুভূতি ছিল তা উনার চোখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম।
অতঃপর রান্নাঘরে গেলাম উনার নাশতা বানাতে।
নাশতা নিয়ে এসে দেখলাম, উনি মেঝে থেকে কিছু একটা তুলতে নীচে ঝুঁকে আছেন। আমাকে দেখে তা দ্রুত হাতে তুলে নিলেন। আমার কাছে মনে হলো, কিছু একটা হয়ত পড়ে গিয়েছিল। আমি শুধু নাশতা রেখে এসে পড়লাম। নাশতার শেষে উনি অফিস রুমের দিকে ফেরার পথে, ডাস্টবিনে কিছু একটা ফেলে গেলেন। আমি সেটা খেয়াল করলেও অতটা গুরুত্ব দেইনি।
সেদিন বিকেলে অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে অফিস রুমে ডাকলেন। বসতে বলাতে আমি চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। উনি আমার দিকে খুবই গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। অনেকক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর বললেন, "তোমাকে আজ কিছু কথা বলতে চাই। মনোযোগ সহকারে আমার কথাগুলো শুনো।"
"জি, বলুন।"
"বলার আগে একটা ওয়াদা করতে হবে।"
"জি, কেমন ওয়াদা?"
"যে তুমি আমার কথাগুলো শেষ হবার আগে সেই চেয়ার থেকে উঠবে না।"
"জি, ওয়াদা করলাম। এবার বলুন।"
"তুমি জানো তো, আমার একটা গোপন ক্যামেরা লাগানো আছে সেই ঘড়ির মধ্যে?"
"জি, জানি। একদম রান্নাঘরের পাশেই।"
"হ্যাঁ। তবে এসব জানার পরও কেন এমনটা করলা? কেন সেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েই যত সব আলাপ আলোচনা করলা?"
আমি তখন বুঝতে পেলাম, উনি কি কি বলতে নিচ্ছেন। তবে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে, শুধু তাকিয়ে রইলাম।
উনি আরো বললেন, "দেখো বাবা! তুমি আমার আপন সন্তানের মতো। আমি সেদিন অনেক দারুণ একটা মুডে ছিলাম। তার আগের রাত একজন কাছের লোকের সঙ্গে কাটিয়েছিলাম। খুব তাজা অনুভব করছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম; রাফি থাকলে ওর জন্যও কাউকে ডেকে আনতাম। এক ফোন করলেই মা একটা মেয়ে পাঠিয়ে দিত। তোমাকে আমি এতই আদর করি। তাও যে কেন এমন করলা!" এরপর কিছুক্ষণ থেমে এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আরো বললেন, "আজ সকালে হঠাৎ করে যখন মদ খাবার বায়না ধরেছিলে, তখন আমার কলিজায় বড় আঘাত লেগেছে। মনটা চাচ্ছিল, নিজের জীবন দিয়ে দেই। বেঁচে থেকে কি লাভ, বলো? যদি আমার সন্তানতুল্য একটা ছেলে এমন এমন কথা বলে, তাহলে খারাপ লাগবে না, বলো? তোমার বাবা কি কখনও এমনটা চাইবে তোমার জন্য? চাইবে না, তাই না? ঠিক সেভাবেই, আমিও তোমার ক্ষতি হতে দেখতে চাই না।" এতটুকু বলার পর, নিজের ডেস্কের ড্রয়ার খুলে, নিজের বন্দুক বরে করলেন। বন্দুকের মধ্যে একেক করে গুলি ভরে, ডান হাতে বন্দুক ধরে নিজের মাথায় ঠেকালেন।
আমি সঙ্গে সঙ্গে কেদারা হতে উঠতে নিলাম, তখন নিজের বাম হাত দ্বারা বসে থাকার ইশারা করলেন। আমি আবারও বসে পড়লাম।
অতঃপর আবার একাধারে বলতে লাগলেন, "মেয়েটা আমাদের মাঝে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে নিচ্ছিল। নিজের মিষ্টি মিষ্টি কথা, সুন্দর হাসি, ফর্সা ত্বক, যৌবনভরা দেহ; এসব দ্বারা তোমাকে প্রভাবিত করছিল। সে তোমাকে শুধু এক প্রেম জালে ফাঁসাতে চাচ্ছিল। তার কাজ শেষ হবার পর, তোমাকে ব্যবহার করে ফেলে দিত। মেয়েদের তো কাজই এটা! তুমি এটা কখন বুঝবে?"
এসব কথা শুনে আমার গায়ে ধরতে লাগল। কিন্তু হাত দুটো মুঠো চেপে সব হজম করতে হচ্ছিল। কারণ এই কথাগুলো উনার ডেস্কের নিচে লাগানো গোপন মাইক্রোফোন দ্বারা তো শোনা যাচ্ছিল। এর দ্বারা অ্যাডভোকেট সাহেব হাতেনাতে ধরা পড়বেন।
অ্যাডভোকেট সাহেব আমার দিকে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে তাকিয়ে থেকে, আবারও একাধারে বলতে থাকেন, "বাহ্! এতো ধৈর্য! আজ সকালে তো এতো ধৈর্য ছিল না। হঠাৎ করে কোথা থেকে আসল? যাক্! ধৈর্য ভাল জিনিস। আর এখন যেই কথাগুলো বলতে যাচ্ছি, সেগুলো শোনার জন্য তোমাকে কিছুক্ষণের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে ধৈর্যশীল ব্যক্তি হয়ে দেখাতে হবে। পারবে তো?"
"জি, পারবো।" বললাম বহুক্ষণ পর।
এ শুনে অ্যাডভোকেট সাহেব আরো উৎসহের সঙ্গে বলতে লাগলেন, "তুমি কি জানো, একটা গাড়িতে লাগানো নতুন ব্রেক কিভাবে এতো সহজেই ফেইল হয়ে গেল? কারণ আমার এক মক্কেল একটা গ্যারাজের মালিককে এই কাজের জন্য বিশ লক্ষ টাকা দিয়েছিল। সেদিন কোর্ট থেকে বের হবার আগে, তারই একজন লোক গিয়ে টায়ারে ছিদ্র করে দিয়েছিল। যখন গাড়িকে গ্যারাজে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ড্রাইভারের অজান্তে গাড়ির ব্রেক বদলে ফেলা হয়। বেচারা বিড়ি টানতে গিয়ে নিজের প্রাণ হারানোর ব্যবস্থা করে গেল। তবে এটা ওরও পুরোপুরি দোষ না। মাঝেমধ্যে বড় মাছ কাঁটায় ধরতে আগে টোপ হিসেবে নিজের তরফ থেকে একটা ছোট মাছের লোভ দেখাতে হয়। এতে মাছ সন্দেহও করে না, আর সহজে ফেঁসেও যায়। তবে এখন নতুন ড্রাইভার নিয়োগ দেওয়াটাও আরেক যন্ত্রণা!" এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরো বললেন, "যা-ই হোক! তোমার মনে এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন এমনটা করতে হলো। আর এমন প্রশ্ন জাগ্রত হওয়াটা পুরোপুরি স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে একটা ব্যাপার বুঝতে হবে। মেয়েটা বহু দিক দিয়েই আমার জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারত। আমার একটা রহস্য জেনে গেলেই আমার জন্য মহাবিপদ। তাও আবার তোমাকে ব্যবহার করে এসব জানার চেষ্টা করছিল যা আমার মোটেও সহ্য হয়নি। কারণ আমি চাইনি, আমাদের মাঝে কোনো মেয়ে আসুক। তবে তোমার এই সন্দেহজনক আচরণ দেখে, আমি তোমাকেও আর দেখতে পারছিলাম না। তাই সেদিন তার সঙ্গে যাবার জন্য এতো জোর করছিলাম। ঐ মেয়েটার পেছনে পেছনে যেতে যেতে একসময় কবরে পৌছে যেতা।" বলে ভয়ানক হাসি হাসতে লাগলেন।
আমার সহ্য হচ্ছিল না বলে উনার দিকে চোখ বড় করে তাকালাম। আমার এই প্রতিক্রিয়া দেখে উনি অতি ভদ্রভাবে হুমকি দিলেন, "এই... খবরদার! যদি একটা জ্যান্ত মানুষের শরীর থেকে তার প্রাণ বের করে ফেলতে পারি, সেই তুলনায় তোমার চোখ বের করা কোনো ব্যাপারই না।"
উনার রাজকীয় কন্ঠ শুনলেই নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়। আমি যতই সাহসিকতা দেখানোর চেষ্টা করি না কেন, উনার কন্ঠের কাছেই আমার সকল বীরত্ব বিফল।
আমি খুব কষ্টে, নিজেকে আশ্বাস দিয়ে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণাধীন আনলাম। চোখ নামিয়ে আবারও মাথা নত রেখে বসে রইলাম।
অ্যাডভোকেট সাহেব তখন বলতে লাগলেন, "তোমার মৃত্যুর সঙ্গেই সব শেষ হয়ে যেত না কিন্তু। আমার সঙ্গে বিরোধিতার বদলা তোমার পরিবার থেকেও নিতাম। তোমার মরে যাবার পর তোমার বাবাকে একটা মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিতাম। কিন্তু তুমি এমনটা হতে দিলে না। যাক্! এখন একটা মজার ব্যাপার বলি তোমাকে। লেনদেনের জন্য যে চেক পাঠিয়েছিলাম, ঐ চেকের কথা মনে আছে? সেই চেকটা আসলে আমার ব্যাংক একাউন্টের না। সেই চেকটা আমার মক্কেল আমার কাছে দিয়ে গিয়েছিল। সেটা ছিল একটা ব্ল্যাংক চেক। আমি একদিক দিয়ে উনাকে ফোন করে বললাম, আমার জন্য আরেকটা ব্ল্যাংক চেক তৈরি করতে, আরেকদিক দিয়ে গ্যারাজের মালিকের সঙ্গে চুক্তি করলাম, বিশ লক্ষ টাকার। এমন করাতে আমারও কোনো ক্ষতি হলো না, আবার আমার পথের বাঁধাও সরে গেল। ওঃ হ্যাঁ, আরেকটা কথা তো বলতে ভুলেই গেলাম। আমার যেই ছাত্রের হাতে কেসটা দিয়েছি, সে লড়ার জন্য নয়, বরং হারার জন্য টাকা নিচ্ছে। তবে টাকা আমি না, আমার সেই মক্কেল দিবে। আর আমি সেই ব্ল্যাংক চেকের টাকা সরাসরি উত্তোলন করবো না। তার জন্য একটা সুইস ব্যাংক একাউন্ট আছে। মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে এই কালো ধনসম্পত্তি সাদায় পরিণত করে নিব।"
আমার দিকে কিছুক্ষণ নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাস, "সব তো বলেই দিলাম। এখনও রাগ উঠছে না? এই তোমার যৌবন? যৌবনকালে তো আমাদের রক্ত অল্পতেই গরম হয়ে যেত। তোমার শরীরের মধ্যে কি আদতে একজন পুরুষের রক্ত আছে? মনে তো হয় না। থাকলে কি কেউ এতক্ষণ চুপচাপ বসে এত কিছু শোনার ধৈর্য রাখতে পারে? ওঃ হ্যাঁ! তুমি তো ঐ মাইক্রোফোনের আশায় বসে আছো, তাই না?"
এ শুনে আমি হতবাক হয়ে উনার দিকে তাকালাম।
আমার প্রতিক্রিয়া দেখে উনি সঙ্গে সঙ্গে হেসে দিলেন।
এরপর বললেন, "কি? শক্ খেলে নাকি? হ্যাঁ, আমি জেনে গিয়েছি। কিছুক্ষণ আগে ডাস্টবিনের যে ময়লা ফেলে এসেছো, তার সঙ্গে ঐ মাইক্রোফোনও হাত থেকে গেল। আজ সকালে রাগের মাথায় টেবিলে বারি দেওয়াটা আমার জন্য উপকারী বের হয়েছে। ছোটকাল থেকে শুনে এসেছি, রাগ নাকি অনেক খারাপ। আজ জানতে পেলাম, এর ভাল দিকও রয়েছে। তবে এসব তোমারই অবদান। তোমার আবেগ তোমাকে পরাজিত করে দিল। তুমি এতো কষ্ট করে এসব ষড়যন্ত্র করলা, আর তাও আমি সব ধরেই ফেললাম। যাক্! এবার অবশ্যই তোমার হিংস্রতা বের হয়ে আসার কথা। কারণ এখন ধৈর্য ধরেও কোনো লাভ নেই। তুমি আমাকে কিছু করলেও পরশুদিন ঐ মেয়েটার পরিবার কেস হারবে, আর না করলেও কেস হারবে। তাই চুপচাপ বসে না থেকে অন্ততপক্ষে কয়েকটা গালি দাও।"
উনি নিজের বন্দুক হাত থেকে রেখে দিলেন টেবিলের উপর, আর আমাকে কেদারা থেকে ওঠার অনুমতি দিলেন।
অনেক চিন্তা করার পর কেদারা থেকে উঠে, মাথা নত রেখে, রুম থেকে বের হতে লাগলাম। উনি আমার আচরণে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাস করলেন, "কি ব্যাপার? মারবে না আমাকে?"
"না। আমি কাছে গেলে আপনি গুলি করে মেরে ফেলবেন, এটা আমার জানা আছে। তাই ভাবলাম, আপনার হাতে প্রাণ হারানোর চাইতে ভাল হবে নিজের প্রাণ নিজেই নিয়ে নেওয়া।"
"বাহ্! এতক্ষণ যেটাকে ধৈর্য ভাবছিলাম, সেটা তো কাপুরুষতা বের হলো! আত্মহত্যা কাদের কাজ, জানো? আত্মহত্যা তারা করে যারা মৃত্যুর কাছে জীবনের বাজি হেরে যায়।"
"আমি কি এখন তার চেয়ে কিছু কম?"
"যদি লড়াই থেকে এতই ভয় পাও, তাহলে মাঠে নামো কোন সাহসে?"
"সত্যি বলতে গেলে, ভয়ের কিছু নেই। আমি আপনার উস্কানি দ্বারা প্রভাবিত হবার আর আগ্রহ রাখি না। যদি মৃত্যুই হয়ে থাকে পরিণতি, তাহলে সেটার সুযোগ আপনার হাতে দিব না।" বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।
অতঃপর যেমনেই ছুড়ি নিয়ে গলা কেটে ফেলার উদ্দেশ্যে রান্নাঘরে প্রবেশ করলাম, তখনই পেছন থেকে অ্যাডভোকেট সাহেব ডাক দিলেন। আমি পিছনে ঘুরে, তাকিয়ে দেখলাম, উনি আমার দিকে খালি হাতে এগোচ্ছেন। আমার কাছে এসে বললেন, "তুমি জানো, আমি কেন হত্যা করি? যাতে আমার নিজের প্রতি একটা ঘৃণা জন্মায়। কারণ যখনও আমি কারো প্রাণ নিয়ে নেই, তখন নিজের বিবেকের চোখে আমি ছোট হয়ে পড়ি। তখন নিজেকে মনে দেওয়াই যে আমি যাকে হত্যা করেছি, সে এখন বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে কোনোদিন একটা বড়সড় পাপকাজ করে ফেলতে পারত। তার আগেই আমি তাকে মেরে ফেলাতে, এখন তার এই সুযোগ আর নেই। আমি নিজেই বিচার করে ফেলেছি। শুধুমাত্র আমিই এর সম্বন্ধে জানব এবং নিজেকে এর জন্য দায়ি করে, নিজের মনের ভেতর নিজেরই বিচার করবো। তখন আমি আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসি। নিজের জন্য আমি যেই শাস্তি নির্ধারণ করেছি, সেটা ছিল জনসম্মুখে আত্মহত্যা। একদিন সবার সামনে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলব, আর নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা প্রকাশ করে ফেলব। আজ আমাকে কেউ এতটাই ঘৃণা করে বসেছে যে সে নিজেই আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। তুমি আমাকে এতটাই ঘৃণা করো যে আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী তোমার মৃত্যু এড়াতে, তুমি নিজেই নিজের মৃত্যু ঘটাতে নিচ্ছ। অর্থাৎ আজ আমি তোমার মধ্যে সেই ঘৃণা দেখতে পেলাম যা আমি নিজের মধ্যে জমা করছিলাম। তাই আজ আমি তোমার কাছে নিজের প্রাণ আত্মসমর্পণ করতে চাই। আমাকে যেভাবে খুশি শাস্তি দাও।" উনি একাধারে বলেই গেলেন চোখে অশ্রু নিয়ে।
আমি উনার কথাগুলো শুনে প্রথমে একটু উত্তেজিত হয়ে গেলাম। পরে ভাবলাম; উনাকে নিজ হাতে শাস্তি দিয়ে দিলে, উনার শেষ ইচ্ছে পূরণ হয়ে যাবে। সারা দুনিয়া মনে করবে; একটা চাকর তার মালিককে নির্বিচারে হত্যা করেছে। তামান্না এসব কখনওই চাইবে না। সে আইনের উপর আস্থা রাখে। তাই এমন একজনের প্রকৃত বিচার আমার হাতে নয়, আইনের হাতেই হতে হবে। এসব ভাবার পর সিদ্ধান্ত নিলাম, উনাকে গ্রেপ্তার করানোর। আমার রুমে গিয়ে ফোন দিলাম ডিটেকটিভ নিজামকে। ফোন করে বললাম, অ্যাডভোকেট সাহেবকে গ্রেপ্তার করানোর জন্য বাসায় আসতে।
অতঃপর ডিটেকটিভ নিজাম বাসায় পুলিশ নিয়ে এলেন। অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের অপরাধ মেনে, ওদের সঙ্গে থানায় গেলেন।
থানায় গিয়ে উনার রিপোর্ট তৈরির জন্য উনাকে প্রশ্ন করার সময় উনি জিজ্ঞাস করলেন, "একবারে প্রথম থেকে বলি?"
থানায় সকলে হয়রান হয়ে তাকিয়ে রইল, যখন উনি নিজের ১৯৭টা খুনের স্বীকারোক্তি দিলেন। শেষের খুন ছিল তামান্নার। তার হত্যার স্বীকারোক্তি দেয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। থানার মধ্যে কারোও বিশ্বাস হচ্ছিল না, এমন একজন লোক যে নিজে নিজে দাঁড়াতেও পারে না, সে এতগুলো হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ি। সব রিপোর্ট তৈরি হবার পর, উনাকে কারাগারে বন্দি করা হলো। শেষবারের মতো আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। উনার এই কথাটা রাখার উদ্দেশ্যে দেখা করলাম।
আমাকে দেখে, চোখে অশ্রু নিয়ে এবং মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, "আজ আমি সব হারিয়ে ফেলেছি। তোমার সামনে যে আছে এখন, সেই ব্যক্তিটা আর সেই ব্যক্তি না, যাকে নিয়ে সকলে গর্ব করতো। আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত সেই সাব্বির ক্বারি এখন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তবে আজ সত্য বলে নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার দিন আমার জন্য বিশেষ করে জনসম্মুখে ফাঁসির জন্য আদালতের কাছে নিবেদন করবো, তাও চেহারা প্রকাশ্য অবস্থায় রেখে। আমি অবশেষে এই অন্যায়ের জীবন থেকে রেহাই পেতে চলছি। এর জন্য তোমাকে শেষবারের মতো একবার সাধুবাদ জানতে চাই।"
"কিন্তু আপনি তো একাই অপরাধী নন। খুন তো আমিও করেছি। শাস্তি আমারও হওয়া উচিত।"
"তোমার মন কি বলে এ ব্যাপারে?"
"আমার মন তো বলে; এখন বেঁচে থাকার তো যত উদ্দেশ্য ছিল, সবই শেষ। সারাজীবন নিজেকে দোষারোপ করে ভেতরে ভেতরে মরার চাইতে ভাল, আমিও নিজের অপরাধগুলো মেনে, শাস্তি ভোগ করে নেই। কি বলেন, করে ফেলি?" এ বলে নীরবে কিছুক্ষণ উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
উনি আমার কথাগুলো শুনে শুধু একটা মুচকি হেসে, হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালেন।
অতঃপর আমিও গিয়ে ট্রেনের মধ্যে করা হত্যাগুলোর স্বীকারোক্তি দিলাম। আমাকেও সেই জেল কক্ষেই রাখা হলো যেটার মধ্যে অ্যাডভোকেট সাহেব ছিলেন। সারাটা সময় উনার সঙ্গেই গল্প করতে করতে কাটালাম।
অবশেষে এসে পড়ল মৃত্যুদণ্ডের তারিখ। অ্যাডভোকেট সাহেবের অবদানে জনসম্মুখে ফাঁসিতে লটকানোর সুযোগ পেলাম। দুজনের জীবনকাহিনী সেদিন সেখানেই শেষ হলো। তবে আমাদের উভয়ের মুখে হাসি এবং বুকে শান্তি বিদ্যমান ছিল।
Comments
Post a Comment