কেদারায় ভ্রমণ (বাস্তবিক) - ৩.৩

কিন্তু এর মানে এই না, যে প্রশ্ন করবেই না ব্যাগের ভেতরের জিনিসপত্র নিয়ে। প্রশ্ন অবশ্যই করেছে, কিন্তু সাধারণ কোনো পুলিশ অফিসার নয়। প্রশ্ন করেছেন স্বয়ং তাদের সিনিয়র অফিসার।
আমাকে এবং সেই মেয়েটিকে আলাদা করে প্রশ্ন করা হলো। আমার কাছে এসে সেই সিনিয়র অফিসারটি নিজের পরিচয় দিলেন, "হ্যালো! আমি হলাম ডিটেকটিভ নিজামুল আহমেদ। আমাকে সবাই ডিটেকটিভ নিজাম বলেই চেনে।" উনার পরিচয় পাওয়ার পর কীভাবে কি বলা যেতে পারে, বুঝতে পারছিলাম না। তাই চিন্তার জগতে হারানো অবস্থায় প্রথম প্রথম কোনো জবাব দিতে পারিনি। উনি নিজের হাতে পরিধান করা গ্লাভস খুলতে খুলতে আমার পরিচয় জিজ্ঞাস করলেন।
আমি স্বাভাবিকের চেয়ে নিম্ন স্বরে উত্তর দিলাম, "জি, আমি রাফি।"
গ্লাভস খোলার পরে হাতে ছোট একটি নোট খাতা এবং পেনসিল নিয়ে জিজ্ঞাস করলেন, "পুরো নাম?"
"রাফি আল মাহমুদ।"
"বয়স, ঠিকানা, পিতার নাম, মাতার নাম; একাধারে বলতে থাকেন।"
আমি আমার সব তথ্য দেওয়ার পর উনি হাতে থেকে নোট খাতা এবং পেনসিল রেখে, আসল প্রশ্নে এলেন, "দেখুন, আপনাকে যা কিছু জিজ্ঞাস করতে যাচ্ছি, তা সত্য সত্য করে উত্তর দিবেন। এতে আমার সময়ও কম নষ্ট হবে এবং আপনার শাস্তিও কম নির্ধারিত হবে।"
আমি ঘাবড়ে ছটফট করে জিজ্ঞাস করে বসলাম, "শাস্তি কেন? আমি তো কোনো অপরাধ করিনি।"
"তো আমি কবে বললাম, আপনি করেছেন? আমি তো শুধু শাস্তির কথা বললাম।"
"অপরাধ না করে থাকলে শাস্তি দিবেন কেন?"
"আমি কবে বললাম, আপনাকে আমি শাস্তি দিব? শান্ত হন। রিল্যাক্স করুন।" হাতের পাশে রাখা অর্ধেক লিটার পানির বোতল হাতে নিয়ে, আমার সামনে রেখে বললেন, "এই নিন। পানি খেয়ে একটু ঠান্ডা হয়ে নিন।"
আমি ধীরে ধীরে পানি পান করতে করতে ভাবছিলাম; লোকটা বিশাল চালাক। এমন বন্ধুসুলভ আচরণ দেখে প্রভাবিত হওয়া চলবে না। এই মাত্র দুবার বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলো। ইনার সঙ্গে সাবধান হয়ে কথা না বললে, পেট থেকে সবকিছু বের করেই ছাড়বে।
আমি পানি পান করার শেষে বোতল হাত থেকে রেখে, উত্তর দেওয়ার প্রস্তুতি নিলাম।
উনি আমার চোখের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলেন, "গতকাল রাত ঘুম হয়নি কেন?"
আমার এখানে মিথ্যে বলার কোনো রাস্তা ছিল না, কিন্তু অর্ধেক সত্য বলে উত্তরগুলো শেষ করলাম, "ট্রেনে ছিলাম সারারাত। মালপত্র পাহারা দিতে গিয়ে রাত জাগতে হলো।"
"আপনি একাই ছিলেন?"
"না। ঐ মেয়েটিও ছিল সঙ্গে।"
"মেয়েটি আপনার কি হয়?"
"জি, কিছুই না। ট্রেনে দুজন একা একা সফর করছিলাম।"
"একজন অপরিচিতা নারীর সঙ্গে সারাটা রাত কি করছিলেন?
"মেয়েটা আমার সাহায্য চেয়ে বসল, তাই মানবতার খাতিরে তাকে সঙ্গে নিয়ে আসলাম।"
"এমন কি সাহায্য চেয়েছিল?"
"একটা ঠিকানার সম্বন্ধে জিজ্ঞাস করছিলেন। আমি সেই ঠিকানায় কাজ করি, তাই আমাকে অনুরোধ করছিল সেখানে নিয়ে চলতে।"
"ঠিক কোথায় এই ঠিকানাটা?"
"জি, ঢাকায়।"
আশ্চর্যের সঙ্গে চোখ বিকশিত করে জিজ্ঞাস করলেন, "ঢাকায়! তাহলে দুজন যশোরে এলেন কি করতে?"
"জি, আমরা প্রথমে যশোরের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু উনার অনুরোধের জন্য আবার ঢাকার দিকে ফিরে যেতে নিয়েছিলাম।"
"আপনি কেন যশোর যাচ্ছিলেন?"
"আমার বাড়ি যশোরেই। কাজ থেকে বিরত পেয়ে এলাম।"
"যাক্! অনেকক্ষণ ধরে আপনার সম্বন্ধে যা জানার ছিল, তা জানা গেল। এবার উনার সম্বন্ধে কিছু প্রশ্ন করবো। আর কিছু জিজ্ঞাস করার আগেই বলে দেই, আমি কিন্তু এতক্ষণ মেয়েটাকে কাছ থেকে ভাল করে জেরা করেছি। উনার সম্বন্ধে যেহেতু এবার আপনাকে জিজ্ঞাস করতে যাচ্ছি, তাহলে মনে রাখবেন এখানে মিথ্যে বলার কোনো উপায় নেই। কারণ উনার সঙ্গে আপনার উত্তরে সামান্য অমিল পেলেও আমি সন্দেহ করতে বাধ্য হবো। তো মনে রাখবেন, কোনো রকমের উনিশবিশ যাতে না হয়।"
"জি, বুঝতে পেরেছি।"
"শাবাশ! চলুন আসি প্রথম প্রশ্নে। মেয়েটির সেই ঢাকার ঠিকানায় কি কাজ ছিল?"
"একজন উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছিল একটা মামলায়।"
"মেয়েটি কি কারণে নিজের কাজটা বাকি রেখে, যশোর যাচ্ছিল?"
"তার বাড়িও যশোরে। সে ঢাকা শহর ততটা চেনে না। তাই বাড়িতে এসেছিল এমন কাউকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে যে ঢাকা ভাল করে চেনে।"
"এর জন্য উনার ফেরত যাওয়ার কি দরকার ছিল? ফোন করে কাউকে ডেকে নিতেও তো পারতেন।"
"জি, হতে পারে উনার ফোনে কোনো সমস্যা দিয়েছিল বা নাম্বার হারিয়ে ফেলেছিল।"
"হতে পারে কেন? আপনি কি সঠিক কারণটা জানেন না?"
"না। এ ব্যাপারে তার সঙ্গে কোনো বিস্তারিত আলোচনা হয়নি।"
"এতো সাধারণ একটা প্রশ্ন না করেই একজন অপরিচিতা নারীর সঙ্গে, হুট করে যশোরে এসেও ফিরে যেতে নিয়েছিলেন! বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার তো!"
"একজন হাত জোর করে, কান্নাকাটি করে, এতো অনুরোধ করছিল। আমি মানা করতে পারিনি।"
"কান্নাকাটি কিসের জন্য?"
"মেয়েটার বোন কিছুদিন আগে ধর্ষণ এবং হত্যার শিকার হয়েছিল। তার এই বেদনাদায়ক কাহিনি বলতে গিয়ে কেঁদে দিয়েছিল।"
"এই হত্যার জন্য কে দায়ি, এ নিয়ে কোনো কথা হয়েছে?"
"না। আমারই জানার আগ্রহ ছিল না। মানুষরূপি জানোয়ারদের সম্বন্ধে কোনো কিছু জানার আমার কোনো ধরনের আগ্রহ নেই।"
এক বড় শ্বাস ছেড়ে বললেন, "এই পৃথিবীর বুক থেকে এদেরকে বিলুপ্ত করার জন্য যদি আমার নিজের জীবনের কোরবানি দিতে হতো, তবে সেটাও মুহূর্তের মধ্যে করে ফেলতাম। কিন্তু এদের প্রত্যেককে ধরে ধরে ধ্বংস করতে হবে। আর তার জন্য আমার বেঁচে থাকাটা বেশ জরুরি।" এরপর আরেকটি বড় শ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞাস করলেন, "আচ্ছা, এবার শেষ প্রশ্ন; এই ব্যাগের ভেতর এমন কি আছে, যার জন্য আপনি নিজের প্রাণের কথাও চিন্তা করে এভাবে, ব্যাগ উদ্ধার করতে এতো বিপদের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে বসলেন?"
এই প্রশ্নের উত্তর সত্যি করে দেয়া কঠিন কিছু ছিল না। আর আমি ভাল করেই জানতাম, সেই মেয়েটার কাছ থেকে উনি এই ব্যাগের সম্বন্ধে কোনো তথ্য পায়নি। তাই আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কিছু সত্য বলে ফেললাম।
আমি খুব কৌশল করে উত্তর দিলাম, "এই ব্যাগের তুলনার আমার প্রাণ কিছুই না। কারণ এই ব্যাগে তার টাকা আছে, যার বাসায় আমি কাজ করি। কিছু অত্যন্ত জরুরি কাজের জন্য এই টাকাটা আমাকে ধার দিয়েছিলেন। আমি আমার জীবন দিয়েও এই আঠারো কোটি টাকার ঋণটুকু শোধ করতে পারবো না। একথা জেনেই আমি নিজের জীবনের পরোয়া না করে এমনটা করেছি।"
টাকার পরিমাণ শুনে উনি থতমত খেয়ে গেলেন। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞাস করলেন, "আঠারো কোটি টাকা! এমন কি কাজ ছিল যার জন্য এতো টাকা ধার নিতে লাগল?"
আমি তখন নিজের দিক দিয়ে একটু চালাকি খাটিয়ে বললাম, "আপনি বলেছেন ওটাই শেষ প্রশ্ন। বাড়তি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি আগ্রহী নই।" বলেই এক জোরপূর্বক মুচকি হাসি দিলাম।
আমার এই কার্য দেখে, উনি চমকে তাকিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে হেসে দিলেন।
উনার হাসিতে এবার আর সেই বিভ্রান্তির আভাস ছিল না। এই হাসিটা সরাসরি মনের ভেতর থেকে এসেছিল।
হাসির শেষে উনি নিজের পকেট থেকে আরেক জোড়া গ্লাভস বের করে, হাতে পরতে লাগলেন। উনার হাতের ঠিক পাশেই টেবিলে উনার কালো গ্লাভস রাখা ছিল। কালো জোড়া ছিল চামড়ার, এবং এই মুহূর্তে সাদা রাবার গ্লাভস পড়ছিলেন। আমি দেখে, অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "হাতের পাশে চামড়ার গ্লাভস থাকতে, রাবারের গ্লাভস পড়ছেন কেন?"
এক মুচকি হাসির সঙ্গে উত্তর দিলেন, "আমি পেটানোর সময় রাবারের গ্লাভস পড়ে নেই আর সেটা পরে পুড়িয়ে ফেলি যাতে পরবর্তীতে ডিপার্টমেন্টে দেখানোর কোনো প্রয়োজন না হয়।"
আমি পেটানোর কথা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল, মেয়েটার সঙ্গে আমার কোনো এক কথার মিল খুঁজে পায়নি, তাই আমাকে পেটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভয়ের চোটে গলা একেবারেই শুকিয়ে গিয়েছিল এবং মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঘাম ঝড়ছিল। আমার এই অবস্থা লক্ষ করতে পেরে, আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, "কোনো সমস্যা?"
আমি ভয়ে বললাম, "জি!"
"আপনার খারাপ লাগছে নাকি?" বলে, হাতের উল্টো পিঠ আমার কপালে রেখে তাপমাত্রা দেখলেন।
"জি, কাকে পেটানোর কথা বলছেন?"
"যাদের কিছুক্ষণ আগে গ্রেফতার করলাম। থানায় বন্দি করবার আগে একটু মনের ক্ষোভ মেটাবো।"
উনার এই কথা শুনে আমি স্বস্তি পেলাম।
চেহারায় আবার একটা মুচকি হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "আমার দেয়া তথ্যের সঙ্গে মেয়েটার দেয়া তথ্যের কোনো মিল-অমিল আছে কি না, সে ব্যাপারে যে কিছু বললেন না! সব ঠিক আছে তো?"
"এখানে মিল-অমিলের কোনো প্রশ্নই উঠে না। কারণ আমি মেয়েটাকে এখনও কোনো প্রশ্ন করিনি।"
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "আমি এইমাত্র না বললেন, আমার আগেই তাকে জেরা করেছেন?"
"হ্যাঁ, বলেছি। আমি সত্য বের করার জন্য এমন ছোটখাটো মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকি। এটা আমার কাজ করার ধরণ।"
"সত্য বের করার জন্য যদি মিথ্যের আশ্রয়ই নিতে হয়, তাহলে কি এখানে সত্যের মানহানি করা হলো না?"
"আপনি এমন মনে করতে পারেন, কারণ আপনার কাছে সত্য এবং মিথ্যে পরস্পর শত্রু। কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো।"
"আমাকে বোঝাতে পারবেন? আমি বুঝতে পারিনি আপনার কথাটা।"
"জি, অবশ্যই। একদিক দিয়ে ভাবতে গেলে, ব্যাপারটা খুবই সোজা। কিন্তু আরেকদিক দিয়ে ভাবতে গেলে, এর গভীরতার কোনো শেষ নেই।" এটা বলে উনি নিজের কেদারায় ঢেলান দিয়ে, আরো বললেন, "সত্যের যেই মানের কথা আপনি বলছেন, তা একমাত্র মিথ্যের জন্যই বিদ্যমান রয়েছে। মিথ্যে ছাড়া সত্যের কোনো অস্তিত্ব নেই। খুনি বলতে কিছু না থাকলে, খুনিকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিশেরও কোনো অস্তিত্ব থাকতো না। উভয়েই পরস্পরের পরিপূরক। তাই আমার কাছে মিথ্যা সত্যের কোনো শত্রু নয়, বরং বন্ধু। এমন বন্ধু যে সত্যের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে। আমার কাছে কিছু কিছু সত্য কিছু কিছু মিথ্যার চেয়েও নিকৃষ্ট। আবার কিছু কিছু মিথ্যা কিছু কিছু সত্যের চেয়েও পবিত্র। জীবন এক এমন মিথ্যে যা আমাদের সকলকে মুগ্ধ করতে পারে। মৃত্যু এক এমন সত্য যা আমাদের সকলকে আতঙ্কিত করে রাখে। এই আতঙ্ক হলো এমন এক সত্য যা আমার কাছে নিকৃষ্ট। আর জীবনের এই মুগ্ধতা হলো এমন এক মিথ্যে যা আমার কাছে চিরপবিত্র। তাই সবসময় সত্য এবং মিথ্যের মাঝে শত্রুতা খুঁজতে নেই। এদের মাঝের সম্পর্কের গভীরতা জানা অতি আবশ্যক।"
"এখানে আমার এক প্রশ্ন আছে।"
"জি, বলুন।"
"আপনি বললেন, মৃত্যুর আতঙ্কের কথা। কিন্তু সেই আতঙ্ক তো মৃত্যু কাছে আসাতেই অনুভব করা যায়। এখানে প্রকৃত সত্য তো মৃত্যু। আর জীবনের মুগ্ধতা তো সকলে পায় না। অনেকেই আছে যারা জীবনের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে ফেলে। তাহলে এখানেও প্রকৃত মিথ্যা জীবন; মুগ্ধতা নয়।"
"যারা জীবনের যন্ত্রণা সহ্য না করতে পেরে নিজের জীবন শেষ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তারাও এককালে এই মুগ্ধতার স্বাদ পেয়েছিল বলেই আবার সেই স্বাদ পেতে চায়, সেই স্বাদ পেতে তর্পায়। তাই গরিবদের মধ্যে এই আত্মহত্যার প্রথা বিদ্যমান নেই। কারণ তারা কোনো একসময় এই মুগ্ধতার স্বাদ পাবে, এই আশাতেই বেঁচে থাকে। আর এখন আসি মৃত্যুর আতঙ্কের প্রসঙ্গে। মৃত্যুর আতঙ্ক তাদের মাঝে পাওয়া যায় না যারা বুঝতে পেরেছে, এই আতঙ্ক পুরোপুরি অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন। কেননা মৃত্যুর স্বাদ তো সবাইকে পেতে হবে। জীবিত থাকার মানেই মরণশীল অস্তিত্ব। যার জীবন আছে, তাকে একসময় মরতে হবেই। যে শুরু হয়েছে, তাকে একসময় শেষ হতে হবেই। আর যখন প্রশ্ন আসে এমন কিছুর যা নিজের জীবনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তখন জীবনের মূল্য তুচ্ছ হয়ে পড়ে। ঠিক সেভাবেই যেভাবে সারা জীবনের কষ্টের অর্জন করা টাকা নিজের স্বপ্ন পূরণের পেছনে ব্যয় করে দেওয়া হয়।" এই বিস্তারিত আলোচনার পর উনি কেদারা হতে দাড়িয়ে জিজ্ঞাস করলেন, "এবার বুঝতে পেরেছেন তো?"
"জি, বুঝতে পেরেছি। ধন্যবাদ।"
"শো দেখবেন?"
"কেমন শো?"
"সন্ত্রাসীদের পেটানোর শো।"
"কোথায় পেটাবেন?"
"ঐ কারখানার ভেতরেই পেটাবো। আপনি আসুন এবং আপনার সঙ্গীকেও সাথে করে নিয়ে আসুন।"
অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "সঙ্গী বলতে?"
"আরে জীবনসঙ্গী বুঝাইনি। আপনার ভ্রমণসঙ্গী।"
"ওঃ আচ্ছা। নিয়ে আসি।"
"আচ্ছা, আমি গিয়ে ওদের রেডি করে নিই।"
ঠিক তখনই মনে পড়ল, আমরা দুজন সকালের নাস্তা এখনও করিনি। মনে আসার সাথে সাথে উনাকে জানালাম। উনি নিজের জুনিয়র অফিসারদের বলে আমাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করলেন, তাও আবার কারখানার ভেতরেই, যাতে আমরা নাস্তার পাশাপাশি উনার পেটানোর শোও দেখতে পারি।
কারখানার ভেতরে; আমাদের সামনে ঐ সন্ত্রাসীদের মধ্যে একেকজনকে ভেতরে নিয়ে আনা হলো। প্রত্যেককে পেটানোর আগেই, তাদের শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্ত বের করা হচ্ছিল এবং একটা গোলাপি রঙের ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছিল। ইনজেকশন দেওয়ার পর তারা কিছুটা নেশাগ্রস্ত মাদকাসক্তদের মতো আচরণ করতে লাগল। যাকে প্রথমে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল, তাকে মাঝখানে এনে রাখা হলো এবং হাতকড়ি খুলে দেওয়া হলো। ডিটেকটিভ নিজাম এবার পেটানোর জন্য প্রস্তুত। চারিদিকে পুলিশ ঘেরাও দিয়ে দাড়িয়ে রয়েছে। ডিটেকটিভ নিজাম ডক্টরদের মতো পোশাক পড়েছিলেন। দেখে বোঝা যাচ্ছিল, রক্তের ছিটে যাতে কাপড়ে না লাগে, তার জন্য পড়েছিলেন এমন পোশাক। উনি প্রথম হাত দিয়েই কিছুক্ষণ পিটালেন। এরপর একটা রড এনে, সেটা দিয়ে পেটানো শুরু করলেন। খুবই বেধড়ক পেটাচ্ছিলেন সেই সন্ত্রাসীটাকে। কিন্তু লোকটাকে দেখে মনেই হচ্ছিল না, তার কোনো ব্যথা লাগছে। আমি দেখে পুরোপুরিই অবাক। এতো জোরে জোরে মারছে, তাও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পারছিলাম না। লোকটার শরীরের কটা হাড় ভেঙে পড়ার শব্দও শুনতে পেলাম কয়েকবার। কিন্তু মুখ থেকে একটাও চিৎকার বের হলো না।
ঐ লোকটাকে পেটানোর পর, তাকে পাশে সরিয়ে এবার তার এক সাথিকে আনলো। তারও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পারছিলাম না। এভাবে একের পর এক সবাইকে পেটালো। কিন্তু কেউ একটা শব্দও করলো না। এই দৃশ্য দেখে আমরা এতটাই তাজ্জব হয়ে গেলাম যে আমরা ভুলেই গেলাম, আমাদের সামনে প্লেটে নাস্তা রাখা আছে। আমাদের উভয়ের কোনো হুঁশ ছিল না। আমাদের পাশে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ পুলিশ অফিসার ডেকে মনে করিয়ে দিলেন, আমাদের খাবার ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। তখন গিয়ে দুজন তাড়াতাড়ি করে, খেয়ে উঠলাম।
মেয়েটার সঙ্গে এ নিয়ে কোনো কথা হয়নি, তবে বুঝতে পারছিলাম, তার মাথায়ও এই একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। আর তা অস্বাভাবিক কিছু না। কারণ এটা কোনো সামান্য দৃশ্য ছিল না। এর পেছনে নিশ্চয়ই বড়সড় একটা রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। আমার প্রথম সন্দেহ গেল সেই ইনজেকশনের উপর। তবে যেই পরিস্থিতি দেখছিলাম, কাউকে কিছু জিজ্ঞাস করার কোনো সুযোগ ছিল না। আমরা নাস্তার পরে সেই কারখানার মধ্যেই বসে রইলাম। অতঃপর যখন শো শেষ হলো, তখন ডিটেকটিভ নিজাম আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞাস করলেন উনার শোয়ের প্রতি আমাদের অনুভূতি কেমন ছিল। আমরা বেশকিছু একটা বলতে পারিনি। উনার প্রশ্নই ছিল এমন যা কেউই প্রাথমিক অভিজ্ঞতায় উত্তর দিতে পারবে না। এটা উনিও ভাল করে জানতেন। তাই কিছুক্ষণ আমাদের নীরবতা দেখেই ধারণা করে ফেললেন।
অতঃপর আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, "আপনারা দুজন ঢাকাতেই যাচ্ছেন, তাই না?"
"জি।" বলে দুজন একসঙ্গে উত্তর দিলাম।
উনি নিজের কাছে দাঁড়ানো একজন অফিসারকে বললেন, "এই শুনো, ফোন করে বলে দাও ফ্লাইটের জন্য আরো দুইটা সিট বুক করে ফেলতে। আর হ্যাঁ! সিট দুটো যেন পাশাপাশি হয়।"
অফিসারটা "জি, স্যার।" বলে কারখানা হতে সোজাসুজি বেড়িয়ে গেল।
আমরা বুঝতে পেলাম, আমাদেরও সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। এ সংবাদ পেয়ে স্বস্তিও ছিল আর আতঙ্কও ছিল। স্বস্তি ছিল কারণ আমাদের চলাচলের ভাড়াটুকু বেঁচে গেল। আর আতঙ্ক ছিল কারণ আমাদের সঙ্গে অ্যাডভোকেট সাহেবের বাসা পর্যন্ত যাওয়ার। উনি যদি অ্যাডভোকেট সাহেবকে এ সম্বন্ধে আলাদা করে জেরা করে, তাহলে তো নিশ্চয়ই ধরা খেয়ে যাবো। কারণ আমি যেই উত্তরটা দিয়েছিলাম ব্যাগের টাকার সম্পর্কে, সেই উত্তরটা তো আর উনার সঙ্গে মিলবে না। তাছাড়া আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, মেয়েটিকে শুধু অ্যাডভোকেট সাহেবের ঠিকানা চিনিয়ে দিয়ে এসে পড়ব। সেই বাসায় ফেরত যাওয়ার কোনো উদ্দেশ্য নেই আমার।
এতো বাধা বিপত্তি এড়াতে এড়াতে এখানে এসে পড়লাম বড় বিপদে। এই বিপদ থেকে বাঁচার কোনো উপায় দেখছিলাম না। তাই এখন শুধু একটাই করণীয় রয়ে গিয়েছিল এবং তা ছিল উনার সঙ্গে সেই বাসায় আবার ফিরে যাওয়া।
অতঃপর সন্ত্রাসীদের আলাদা এক জিপে করে নিয়ে গেল এবং আমরা দুজন গেলাম ডিটেকটিভ নিজামের সঙ্গে উনার গাড়িতে। উনার গাড়ি ছিল বেশ চমৎকার দেখতে। এমন গাড়ি আমি আমার সারাটা জীবনে দেখিনি। গাড়িটি ছিল সম্পূর্ণ কালো রঙের। সামনের অংশ বেশ লম্বা ছিল। গাড়িটি ছিল জেগোয়ার কম্পানির। গাড়ির পেছনের অংশ দেখতে অনেকটা রেসিংয়ের গাড়ির মতো ছিল। তাছাড়া গাড়ির সমস্ত গায়ের আকৃতি ছিল অনেকটা বাদুড়ের মতো। আর নাম্বার প্লেটের উপর লেখা ছিল ব্যাটমোবিল।
আমরা গাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখি আগের থেকেই আরেকজন বসে আছে। লোকটা দেখতে বিদেশিদের মতো লাগছিল। পরিচয়ে জানা গেল লোকটা একজন প্রবাসী বাংলাদেশী যে ছোট থেকে ইংল্যান্ডে বড় হয়েছে। লোকটা দুয়েকটা শব্দ ছাড়া বাংলা মোটেই বোঝে না। একথা প্রমাণ করতে আমাদের সামনেই তাকে হাসিমুখে কয়টা গালি দিলেন, কিন্তু তা শুনে লোকটা না ক্ষেপে, একটা হাসি দিল। দৃশ্যটা দেখে আমরা কেউই হাসি থামিয়ে রাখতে পারলাম না। অতঃপর গাড়ি চলা শুরু হলো। এই সুযোগ নিয়ে ডিটেকটিভ নিজামকে কয়টা প্রশ্ন করলাম।
আমি প্রথমে জিজ্ঞাস করলাম সেই প্রযুক্তির ব্যাপারে যেগুলোর দ্বারা ঐ সন্ত্রাসীদের উপর বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। ডিটেকটিভ নিজাম জানালেন; সেটা ছিল মিলিটারি দ্বারা ব্যবহৃত আনম্যান্ড কমব্যাট এরিয়াল ভেহিকল। আর উনার তখন উনার হাতে যেই যন্ত্রটা দেখতে পারছিলাম, সেটা দিয়ে উনি ঐ ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এগুলো অতি উন্নতমানের ড্রোন যা যুদ্ধের সময় শত্রুকে দূর থেকে আক্রমণ করতে সাহায্য করে। ডিটেকটিভ নিজাম যেই ভার্সানটা ব্যবহার করছিলেন, সেটা ছিল নতুন একটা মডেল যা কালোবাজার ব্যতীত কোথাও পাওয়া যায় না। এই ড্রোনের বিশিষ্টতা হচ্ছে, এটা সোলার পাওয়ার্ড। অর্থাৎ সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে এবং সেই বৈদ্যুতিক শক্তি দ্বারা নিজেকে সক্রিয় রাখতে পারে। এই ড্রোনের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা আছে যেখান থেকে অতি ছোট আকারের বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এই বোমাগুলো মূলত অসহনীয় মানের ধোঁয়া ছাড়ে যার গন্ধের কারণে কেউ টিকে থাকতে এবং এই বিস্ফারনে বিশাল এক শব্দ হয় শত্রুদের কান কিছুক্ষণের জন্য অসহায় করে ফেলার জন্য। উনি আমাদের আরো বললেন, এই ড্রোন কালোবাজার থেকে উনার কাছে এনেছে আমাদের সামনে বসা সেই প্রবাসী বাংলাদেশী ভাইটা।
একথাগুলো শুনে মেয়েটা জিজ্ঞাস করে বসল, "আইনের রক্ষক হয়ে, কালোবাজারের মতো বেআইনি বাজার থেকে অস্ত্র কিনতে আপনার বিবেকে একবারও বাজেনি?"
উনি মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, "কালোবাজারকে যতই খারাপ ভাবেন না কেন, এটা কিন্তু দিন শেষে একটা বাজার। এখানে ক্রেতারা সেই জিনিসই কিনে থাকে যা সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ বাজারে বিক্রি করার উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। কিন্তু একজন ক্রেতা সেটা কেন কিনতে চায় এবং তা দ্বারা কোনো ক্ষতি হতে পারে কি না, এসব ব্যাপার বিবেচনা করেই তা মূলত বাজার থেকে সরানো হয়। এখন এই ড্রোনটা আমি যদি সময়মতো না কিনে নিতাম, তাহলে এটা এমন কারো হাতে পড়তে পারতো, যে এর সাহায্যে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য রাখে। ঠিক যেমন সাধারণ জনগণের কাছে বন্দুক থাকলে তারা নিজেদের মধ্যে খুনাখুনি করে রক্তের ঝড় বয়ে দিবে, কিন্তু পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর কাছে বন্দুক থাকা সমাজের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং কল্যাণীয়। আশা করি, আমার কথা পুরোপুরি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।"
"জি। বুঝতে পেরেছি।"
ডিটেকটিভ নিজামের এই বক্তব্য শুনে আমার আবার অ্যাডভোকেট সাহেবের কথা মনে পড়ে গেল। সেই দিন মনে এসে পড়ল, যেদিন প্রথম উনাকে হত্যা করতে দেখেছিলাম। সেই মর্মান্তিক দৃশ্য মনে করার সঙ্গে সঙ্গে আমার মেরুদণ্ড কেঁপে উঠল। কিন্তু মজার ব্যাপারটা হলো; আমি নিজেও গতরাতে কয়েকজনের হত্যা করেছি। যদিও একজনের জীবন বাঁচানোর জন্য এসব করা, তবুও হত্যা তো হত্যাই। আমার এই শারীরিক প্রতিক্রিয়া খেয়াল করতে পেরে ডিটেকটিভ নিজাম জিজ্ঞাস করলেন আমার শরীর ঠিক আছে কি না। আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে চুপচাপ বসে রইলাম।
অতঃপর ডিটেকটিভ নিজামকে জিজ্ঞাস করলাম, সেই সন্ত্রাসীদের পেটানোর প্রসঙ্গে। উনি তখন সেই রহস্যময় ইনজেকশনের উপর আমার সন্দেহকে সঠিক প্রমাণ করলেন। উনি ব্যাখ্যা দিলেন; প্রথমে এক ব্যাগ করে রক্ত নেওয়া হলো যাতে শরীরের রক্তচলাচল ধীরগতিতে হয়। তারপর ইনজেকশন দেওয়াতে শরীরের সেই স্পর্শকাতর অংশগুলো কিছু সময়ের জন্য অচল হয়ে যায়, যারা আঘাত পাওয়ায় শরীরে ব্যথা অনুভব হয়। তার মানে এ না যে তারা কখনও সেই মারের ব্যথা অনুভব করতে পারবেই না। কিন্তু তা অনুভব করতে প্রায় ছয়-আট ঘণ্টা সময় লাগবে। কারণ এটা তার শরীরের উপরেও নির্ভর করে, যাকে ইনজেকশনটা দেওয়া হয়েছে।
ডিটেকটিভ নিজাম ভীষণ বড় একটা হাসি দিয়ে বললেন, "হারামজাদারা থানার মধ্যে গিয়ে চুপচাপ পড়ে থাকবে। কয়েক ঘন্টা গেলেই এমন চিৎকার দিবে যে আশেপাশের সবাই মনে করবে; এরা গর্ভবতী মা যাদের এখন ডেলিভারি হতে যাচ্ছে।"
এমন আনন্দে হাসছিলেন লোকটা, তাও আবার অন্য একজনের কষ্টের কথা চিন্তা করে। হাসতে হাসতে আরো বললেন, "ওদের অনেক হাড়ও ভেঙে, মাংসের মাঝে চুরমার হয়ে রয়েছে। হাড়ের সেই গুঁড়োগুলো তাদের চামড়া আর মাংসের মাঝে বিঁধতে থাকবে। তাদের মাংস পচতে থাকবে। তাদের অবস্থা আরো অধিক মাত্রায় করুণ হতে থাকবে। আর শেষমেশ তাদের মাংসপেশী নিস্তেজ হয়ে পড়বে। তারা আর কখনও নড়তে পারবে না। আর কখনও সমাজে আতঙ্ক ছড়াতে পারবে না।" এভাবে একাধারে বলতে থাকেন।
অতঃপর মেয়েটা উনাকে প্রশ্ন করলো, "আপনি একথা ভেবে যে এতো আনন্দ বোধ করছেন, আপনার বিবেক এটা সমর্থন করে?"
"কেন করবে না?"
"আপনি যেভাবে তাদের ড্রাগস দিয়ে, নিস্তেজ করে, জানোয়ারদের মতো পিটিয়েছেন, তা কি আইনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত?"
"না। পুরোপুরি আইনের বহির্ভূত। কিন্তু কারণ আছে এমন কাজ করার পেছনে।"
"জানতে পারি?"
"জি, অবশ্যই। আমার কারণ হচ্ছে এর মাধ্যমে তাদেরকে সেই শাস্তি দেয়া যা সাধারণ একটা ফাঁসি কখনও দিতে পারবে না। কারণ আইন খুবই ফালতু একটা জিনিস। আইনের চোখ সবাই সমান, তাই সবার জন্য শাস্তিও সমান। কিন্তু সবাই কি আসলেই সমান? আপনিই বলুন।"
"হ্যাঁ, অবশ্যই। আমরা সবাই মায়ের গর্ভে জন্ম নেই। আমরা খাবার খাই শক্তি জোগাড় করতে। আমরা জ্ঞান অর্জনের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করি। এক সময় আসে যখন বেঁচে থাকার জন্য কাজ করে টাকা কামাই করি। আর সময় আসলে মারা যাই। সকলের জন্য তো একই প্রক্রিয়া। আপনি কি তা অস্বীকার করছেন?"
"আপনি তো জীবনচক্রের সঙ্গে একজন মানুষের মানকে ঘুলিয়ে ফেললেন। মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই ভিন্ন প্রকৃতির। কারো সঙ্গে কারো ৯৯.৯৯ শতাংশও যদি মিল পাওয়া যায়, তাও ০.০১ শতাংশ অমিল থাকবেই। সকলের চিন্তাধারা ভিন্ন। সকলের জীবনধারা ভিন্ন। আর ভিন্নতার কারণেই আইনও সকলের জন্য ভিন্ন হওয়া উচিত। কারণ একজনকে মৃত্যু দেয়ার অর্থ হলো রেহাই দেয়া, কিন্তু তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে ফেললেই প্রকৃত শাস্তি দেয়া হবে।"
"আর এই শাস্তি নির্ধারণ করার আপনি কে? আপনি তো নিজেই বেআইনি ড্রাগস এবং কালোবাজার হতে পাচার করা অস্ত্র ব্যবহার করেন। আপনি আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এ সকল অবৈধ কাজ করে বেড়াচ্ছেন। আপনি ধরা পড়লে আপনার শাস্তিও কি সমান হওয়া উচিত, নাকি আপনার জন্য ভিন্ন শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত?"
"বাহ্! সুন্দর তো। আপনি নিজের চোখে দেখলেন; আমি এতগুলো পুলিশ অফিসারদের সামনে পুরো অপারেশনটা করে আসলাম। তাও আপনি ধরে নিলেন, আমি আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এগুলো করছি! আপনার কি মনে হয়, ওদের মধ্যে কেউ কিছু বলতে পারত না?"
"তারা আপনার জুনিয়র অফিসার ছিল। আপনি চাইলেই তাদের চাকরি কেড়ে ফেলতে পারেন।"
"এতো সহজ না গো। আমার সিনিয়র অফিসাররা এগুলোর সম্বন্ধে সব জানে। তাদের কোনো আপত্তি নেই। কারণ তারা ভাল করে জানে; ডিটেকটিভ নিজাম নিজের জীবনের চেয়েও বেশি নিজের কাজকে ভালবাসে, আর মৃত্যুর চেয়ে বেশি ঘৃণা করে সন্ত্রাসীদের।"
"আপনার বিবেক কি বলে? শুধু তাদের আপত্তি না থাকার কারণে কি সবকিছু বৈধ হয়ে যায়?"
"আমি আমার বিবেকের কথা অনুযায়ী চলি না। কারণ আমি ভাল করে জানি, আমার বিবেক যা বলে তা ভুলও হবার সম্ভাবনা রয়েছে।"
"খুবই সুন্দর যুক্তি উপস্থাপন করলেন। সাধারণত এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর কারো কাছে থাকে না। কারণ সবার কাছেই সবচেয়ে বড় আদালত হচ্ছে তাদের বিবেক।"
"আপনার কথাগুলো শুনে আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, আপনি একজন আইনের ছাত্রী।"
"জি। আমি একজন অ্যাডভোকেট ইন ট্রেনিং।"
মেয়েটার এই উক্তিটি শোনার পর আমি অনেকটা হতবাক হয়ে গেলাম। এই নিয়ে কিছু ঘন্টার ব্যবধানে, আমি একজন পেশাগত অ্যাডভোকেটের সঙ্গ ছেড়ে এলাম আর এসে পড়লাম আরেকজন অ্যাডভোকেটের কাছে যে কিছু সময় পর এই পেশায় নিযুক্ত হবে। একথা ভাবতে গিয়ে চেহারায় হঠাৎ করে একটা মুচকি হাসি ফুটে গেল। ডিটেকটিভ নিজাম তা খেয়াল করতে পেরে, আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, "কি ব্যাপার? মজার কিছু মনে পড়েছে নাকি, হ্যা?"
আমি লজ্জায় মুখ চাপিয়ে বললাম, "না, তেমন কিছু না।"
"আচ্ছা। আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যে এয়ারপোর্ট পৌছে যাবো এবং তার কিছুক্ষণ পর ঢাকায়। এ নিয়ে আপনাদের অনুভূতি কেমন?"
"জি?" আশ্চর্যজনক কন্ঠে দুজন জিজ্ঞাস করলাম।
"আরে! এতক্ষণ এতো স্মরণীয় মুহূর্ত কাটালেন একে অপরের সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর ঢাকায় যাওয়ার পর, আপনাদের কাজ হয়ে গেলে আবার আলাদা হয়ে যাবেন। এ নিয়ে আপনাদের অনুভূতি জানতে চাচ্ছিলাম।"
আমি মাথা নত করে, মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম, "আমার অনুভূতি জেনে কিই বা হবে? আমি তো এখনও উনার নামও জানতে পারলাম না। মুহূর্তগুলো যতই স্মরণীয় হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত দুজনেই নিজ নিজ জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। তখন স্মরণে থাকবে শুধু উনার নাম। কিন্তু আফসোস! আমি তো তাও জানি না।"
"আমার নাম; তামান্না। তাসনিম তামান্না।" মেয়েটা হঠাৎ করে বলে উঠল।
এটা শুনে লজ্জায় হেসে দিলাম। একাধারে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। "নামটা বেশ সুন্দর।" আমার মুখ থেকে হঠাৎ বের হয়ে গেল।
মেয়েটাও লজ্জায় হেসে দিল। আর ডিটেকটিভ নিজামের কথা তো মনে হয় কিছুক্ষণের জন্য দুজন ভুলেই গিয়েছিলাম।
উনি এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বললেন, "আহেম! আহেম!" এটা শুনে আমরা দুজন হাসি চেপে, মাথা নত করে বসে রইলাম। তখন উনি রসিকতা করে আরো বললেন, "শুধু নাম জানাতেই এই অবস্থা! নাম্বার জানলে তো কি না কি, হ্যাঁ?"
একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সবাই হেসে দিলাম। তবে মেয়েটা যখন এভাবে জোরে জোরে হাসছিল, তখন আমি চোখের পাশ দিয়ে অতি মনোযোগের সঙ্গে তার হাসি দেখছিলাম। আমাদের একসঙ্গে ভ্রমণের এতক্ষণ পর তার মুখে হাসি দেখতে পেলাম। এতো সুন্দর হাসি লুকিয়ে ছিল সেই অশ্রুভরা চোখের নিচে। এমন সুন্দর হাসি শুধু একাধারে দেখেই গেলাম। কি সুন্দর লাগছিল সেই চোখ, যখন হাসির কারণে সঙ্কুচিত হয়ে গেল! কি সুন্দর লাগছিল সেই নাক, যখন হাসির কারণে সামান্য বেঁকে উঠছিল! কি সুন্দর লাগছিল সেই ঠোঁট, যখন হাসির কারণে গালের দুপাশে ছড়িয়ে গিয়েছিল! সেই ঝলমলে গোলাপি ঠোঁট। এই দৃশ্য দেখে আমি মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেও রাজি আছি। তখন খুব মন চাচ্ছিল ডিটেকটিভ নিজামকে একবার সাধুবাদ জানাতে। তবে আমি জানতাম এই মুহূর্তটা অতি শীঘ্রই স্মৃতিতে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। তামান্নার ভবিষ্যতে রয়েছে তার বোনের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি পর্যন্ত পৌছিয়ে দেয়া এবং তার কিছু সময় পর একজন সুশিক্ষিত, নরসুন্দর এবং ধনী লোকের সঙ্গে বিয়ে করে, তার সঙ্গে সংসার করা। আমার মতো গরীব পরিবারের, অশিক্ষিত একজন লোকের সঙ্গে এমন উচ্চশিক্ষিত মেয়ের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ভাল এটাই হবে; ঢাকায় পৌছাবার পূর্বেই, মনের মধ্যে গড়া স্বপ্নগুলো জ্যান্ত কবর দিয়ে পুঁতে দেই।
অতঃপর এয়ারপোর্টে পৌছে গেলাম। সবাই গাড়ি থেকে নেমে, সরাসরি প্লেনে উঠে চড়লাম। পুলিশের দ্বারা বুক করা ছিল বলে আমাদের কারো মালপত্র চেকিং করা হয়নি। প্লেনের ভেতরে আমি এবং ডিটেকটিভ নিজাম বসলাম একই সিটে, আর সেই প্রবাসী বাংলাদেশি ভাইয়ের সঙ্গে বসল তামান্না।
আমি ছিলাম বাম পাশের শাড়ির বাম পাশে, এবং তামান্না ছিল ডান পাশের শাড়ির ডান পাশে। আমার সঙ্গে ডিটেকটিভ নিজামের কিছু গুরুগম্ভীর বিষয়ে আলোচনা হলো।
প্লেন ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ডিটেকটিভ নিজাম আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, "আপনি যার বাসায় কাজ করতেন, উনি ঢাকার কোথায় থাকেন?"
"পুরান ঢাকার কেরানীগঞ্জের মডেল টাউন এলাকায়।"
"আমার বাসাও পুরাণ ঢাকায়।"
"পুরান ঢাকার কোথায়?"
"নাজিমুদ্দিন রোড। ছোট কাল থেকে বড় হয়েছি নবাববাড়ীতে।"
"ওঃ আচ্ছা। আমি মুলত উনার বাসার এলাকা এবং গুলিস্তান এলাকা চিনি। রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্তও আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাস করে করে গিয়েছিলাম।"
"যাক্! ব্যাপার না। আপনি কি উনার ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন?"
"না। সহকারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণী পাসের চাইতে অনেক বেশি হওয়া লাগে। আমি উনার বাসায় কাজের লোক ছিলাম। একটা সামান্য চাকর।"
উনি চমকে উঠে জিজ্ঞাস করলেন, "চাকর! একজন সামান্য চাকরকে আঠারো কোটি টাকা দিয়ে ভরসা করে ফেলল! এ কীভাবে সম্ভব?"
"জি, আমার বাবা উনাদের বাসায় আগে একই কাজ করতেন। আমার জন্মেরও অনেক আগে। আর তখনও আমাদের পরিবারের অনেক দুঃসময়ে উনার পরিবার আমাদেরকে আর্থিক সাহায্য দিয়েছিল।"
"নিজের পরিবারের এমন অবস্থা দেখে অন্তত আপনাকে সুশিক্ষিত হবার চেষ্টা করা উচিত ছিল।"
আমি সামান্য হেসে জিজ্ঞাস করলাম, "আপনার কি মনে হয়, আমি একটুও চেষ্টা করিনি?"
"তাহলে পড়ালেখা চালিয়ে যাননি কেন?"
"কারণ আমাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।" বলে এক মুচকি হেসে, সঙ্গে সঙ্গে মুখ মাটির দিকে করে নিলাম।
"যাক্! এ প্রসঙ্গে আর কিছু জিজ্ঞাস করবো না। তবে কিছু মনে না করে থাকলে একটা প্রশ্ন করতাম। করতে পারি?"
"আমি সামান্য একটা চাকর; একথা জানার পরও আপনি আমাকে এতো সম্মান দিচ্ছেন! আপনার বদলে অন্য কেউ হলে, তুইতোকারি করে কথা বলা শুরু করে দিত।"
আমার কথাটা শুনে ডিটেকটিভ নিজাম হাসতে হাসতে বললেন, "আমাকে তাদের মাঝে গণ্য করবেন না, যারা অন্যকে সম্মান দিতে জানে না। আপনাদের চোখে আমি অনেকগুলো আইন অমান্য করে চলা একজন আহাম্মক হতে পারি। কিন্তু আমি সারাজীবনে কখনও বেয়াদবি শিখিনি।"
"তো আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, আইনকে অমান্য করা আপনি কোনোখান থেকে শিখে এসেছেন?"
"আমার প্রশ্নটা উনাকে বেশ জটিলতায় ফেলে দিল।
উনি কিছুক্ষণ থেমে বললেন, "হুম... এক হিসেবে বলা যেতে পারে। তবে আদবকায়দা সবাই বাসা থেকে শিখে আসে। কিন্তু আইনের শিক্ষা তো কেউ বাসায় দেয় না। তার দায়দায়িত্ব পুরোপুরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। আমি এইমাত্র কথা বলছিলাম আমার আচরণ বিষয়ক শিক্ষার ব্যাপারে। আর আচারআচরণ সবাই বাসা থেকেই শিখে।" উত্তরটি দিয়ে ডিটেকটিভ নিজাম একটা মুচকি হাসি দিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল কোনো বড় একটা বাজি মেরে এসেছেন। লোকটার মধ্যে একটা চঞ্চলতা আছে, যা সাধারণত এই বয়সের লোকদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাও আবার এমন পেশার লোকদের মাঝে এমন স্বভাব কল্পনাও করা যায় না।
তবে লোকটার এই চঞ্চলতার মাঝেও একটা বড়সড় রহস্য রয়েছে। তা যতই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, তার চোখে তাকালেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
কিন্তু সেসব কথা নিয়ে আমার কিছুই যায়-আসে না। আমাদের এই প্রায় এক ঘণ্টার সফরে অনেক কিছু নিয়েই আলাপ-আলোচনা হলো। আমার কাছে সবচেয়ে দারুণ লেগেছিল উনার গোয়েন্দা হবার পেছনের ঘটনাটা। উনি ছোটবেলা থেকে গোয়েন্দাদের নাটক, চলচ্চিত্র এবং কার্টুন দেখে বড় হয়েছেন। উনার কাছে গোয়েন্দাদের জীবনটা বেশ রোমাঞ্চকর মনে হতো। উনার প্রিয় একটা চরিত্রের সম্বন্ধে আমাকে জানালেন। সেই চরিত্রটার নাম হলো; ব্যাটম্যান। ডিটেকটিভ নিজাম এই চরিত্র দ্বারাই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত। এমনকি উনার পোশাকআসাক পর্যন্ত বেশিরভাগ কালো পরিধান করেন শুধু এই একটা কাল্পনিক চরিত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে।
কি বিস্ময়কর এই জগৎ। মানুষ কত কিছু দিয়ে প্রভাবিত হয়ে থাকে। একটা সামান্য টিভির পর্দায় একটা কাল্পনিক জগতে কীভাবে হারিয়ে গেয়ে, নিজের জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া যায়! আমিই একমাত্র অভাগা যে এখনও নিজের জীবনের জন্য এমন কোনো লক্ষ্য খুঁজে পায়নি, যার পেছনে জীবনটা ব্যয় করা যায়। এভাবে খেয়ালে ডুবে থাকা অবস্থায় উনার জীবনের আরেকটি মজার ঘটনা জানতে পেলাম।
উনি ছোটবেলায় খুবই চিকন শরীরের অধিকারী ছিলেন। চতুর্থ শ্রেণীতে পাঠরত অবস্থায় কয়জন দুষ্ট এবং মোটাসোটা ছেলে উনাকে বিরক্ত করছিল। তখন উনি উত্যক্ত হয়ে তাদেরকে মারেন। উনার মার খেয়ে তারা এতটাই আহত হয়, পরবর্তীতে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। স্কুলে এ ঘটনা নিয়ে বিশাল বৈঠক বসে। সেই বৈঠকে কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না, এতো চিকন একটা ছেলে এতো মোটাসোটা ছেলেদের এভাবে মেরে আহত করে ফেলতে পারে। প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, নিজামকে ডাক্তারের কাছে দেখাতে। ডাক্তার সাহেব উনার এক্সরে করে জানালেন, উনার শরীরের হাড়ের ঘনত্ব একজন সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। এমন ঘনত্ব সাধারণত লোহার মতো আরো শক্ত বস্তুর মাঝে পাওয়া যায়। অর্থাৎ ডিটেকটিভ নিজাম হলেন সাধারণ একজন মানুষ যার মধ্যে সুপার পাওয়ার রয়েছে। এজন্যই তিনি কখনও সকলের সমান হবার ব্যাপারটা অস্বীকার করে আসছেন। আমি তখন উনাকে জিজ্ঞাস করলাম, উনার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তো উনাকে আইনের সঠিক জ্ঞান দান করেছে, তাহলে এই শিক্ষা অমান্য করার দায়দায়িত্ব পুরোপুরি তাঁদের কেন হবে? তখন উনি মুচকি হেসে উত্তরে ব্যাখ্যা দিলেন, উনাকে সেই আইনগুলো শেখানোর পাশাপাশি সেগুলোর যৌক্তিকতা বোঝানোর দায়িত্বও তাদের ছিল। তাঁরা কখনও উনাকে সেই আইনগুলো মেনে চলার জন্য কোনো যৌক্তিক কারণ দিতে পারেনি। এ কারণে উনিও সেগুলো অযৌক্তিক ভেবে অমান্য করতে বাধ্য হন।
এর প্রক্ষিতে আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কিছু আইনের যৌক্তিকতা তো অপরাধীরাও বুঝতে অক্ষম হয়, তা বলে কি তাদের বেআইনি কার্যক্রমও কি বৈধ হয়ে যায়? এর উত্তরে উনি খুব সুন্দর করে ব্যাখ্যা দিলেন, একজন অপরাধী যে আইনগুলো ভঙ্গ করে, সেগুলো হলো মানবাধিকার আইন। উনি মানবাধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে কিছু সামান্য আইন ভঙ্গ করে থাকেন। এমন সামান্য কিছু আইন পালনের পক্ষে যেদিন কেউ ভাল কিছু যুক্তি উপস্থাপন করতে পারবে, সেদিন হতে উনিও সেগুলো মানা শুরু করবেন। তার আগ পর্যন্ত উনি উনার মতোই চালিয়ে যাবেন।
উনার যুক্তিটা আমার কাছে খারাপ লাগেনি। তবে এমন আইন বানানোর পেছনে কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ তো নিশ্চয়ই রয়েছে। তা নাহলে এতকাল ধরে সবাই মেনে চলছে কেন? কেনই বা এ নিয়ে কারো কোনো আপত্তি দেখতে পাই না? একবার অ্যাডভোকেট সাহেবের ঠিকানায় পৌছে নিই, দুজনকে বিতর্কে ব্যস্ত করে দিব। দেখি; অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছে একটা সেন্তাষজনক উত্তর পান কি না!
এই কথোপকথন শেষ হতে না হতেই প্লেনটি ঢাকায় এসে নামল। সবাই নিজ নিজ মালপত্র নিয়ে প্লেন থেকে নেমে পড়লাম। সেখানে দেখি আরেকটা অসম্ভব সুন্দর কালো গাড়ি আমাদের অপেক্ষা করছে।
গাড়িতে চড়ে সরাসরি বের হলাম কেরানীগঞ্জ, মডেল টাউনের দিকে। সারা পথে সামান্য কিছু হাসি ঠাট্টা ব্যতীত তেমন কোনো কথা হয়নি। ডিটেকটিভ নিজাম রসিকতা করে তামান্নাকে বললেন, "আপনি যেদিন উকিল হয়ে যাবেন, সেদিন আমার কেস লড়তে আপনাকেই ডাকব।"
আশ্চর্য হয়ে তামান্না জিজ্ঞাস করলো, "জি, কোন কেসের কথা বলছেন?"
"আপনিই তো আমাকে বলছিলেন, ধরা খাওয়ার পর আমার শাস্তি কেমন হবে। সেই প্রেক্ষিতেই বললাম, আমি ধরা খাওয়ার পর আপনি আমার কেস লড়বেন।" বলে হেসে দিলেন।
গাড়ির মধ্যে প্রায় সবাই হাসছিলাম। এভাবে হাসতে হাসতে এসে পড়লাম কেরানীগঞ্জ। অ্যাডভোকেট সাহেবের বাড়ির ঠিকানায় পৌছানোর পর ডিটেকটিভ নিজাম আমার জিজ্ঞাস করলেন, "আপনি সাব্বির ক্বারির জন্য কাজ করতেন?"
আমি আশ্চর্যের সঙ্গে উত্তর দিলাম, "জি। অ্যাডভোকেট সাব্বির ক্বারি।"
আমার উত্তর শুনে একটা সন্তোষজনক হাসি দিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল বহুদিন ইচ্ছে, আজ পূরণ হতে যাচ্ছে। সবাই বাসায় উঠে কলিং বেল বাজালাম। দরজা খুলেছিলেন স্বয়ং অ্যাডভোকেট সাহেব। দরজা খোলার আগে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাস করছিলেন, "কিরে বাবা, তোমার না বিকেলের দিকে আসার কথা ছিল?"
বুঝতে পেলাম, আমার বদলে আরেকজনকে কাজে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। দেখে অবাক হলাম না। হুইলচেয়ারে বসে তো একজন লোক একা একা এত কিছু করতে পারে না। তবে অবাক লাগল এ দেখে যে আমার যাওয়ার কথা পুরোপুরি জানার পরও, নতুন কাউকে তো সেদিন থেকেই রাখা উচিত ছিল। নতুন কাজের লোক এতো দেরি করে নিয়োগ দেওয়ার তো কথা না!
বাসায় প্রবেশ করার পর সবাইকে বসিয়ে, আমি আগের মতোই কাজে লেগে গেলাম। ডিটেকটিভ নিজাম আর অ্যাডভোকেট সাহেবের হাসাহাসির গুঞ্জন রান্নাঘর পর্যন্ত আসছিল। আমি সবার জন্য কফি এবং অ্যাডভোকেট সাহেবের জন্য উনার প্রিয় গ্রিন টি নিয়ে আসলাম। আমাকে ফেরত দেখে উনার প্রতিক্রিয়া বেশ স্বাভাবিক ছিল। কীভাবে আসা হলো? হঠাৎ কি হলো? কিছু হয়েছে কি না? এমন সব প্রশ্ন জিজ্ঞাস করতে লাগলেন। সবার সামনে নিজেকে যতটা সহজ-সরল প্রকৃতির দেখাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল যেন মেয়েটাকে আগে কখনওই দেখেননি। সবাই উনার অভিনয়ের বশে এসে পড়ল। এমনকী তামান্না পর্যন্ত উনার সব কথা মেনে নিচ্ছিল। এসব কথার মধ্য দিয়ে অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে উনার রুম থেকে উনার ফোন নিয়ে আসতে বললেন। রুমে ঢোকার পর বুঝতে পেলাম, কেন একটা নতুন কাজের লোক তাৎক্ষণিক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। উনার রুমের চাদর এলোমেলো হয়ে ছিল। তাছাড়া একজন মহিলার সুগন্ধির ঘ্রাণ আসছিল। একটু কাছ থেকে দেখায় লম্বা একটা চুল বালিশে পড়ে ছিল। অ্যাডভোকেট সাহেব তো একাই ঘুমান, কিন্তু বিছানায় দুটো বালিশ ছিল পাশাপাশি। উভয় বালিশেই মাথা রাখার ফলে যেই গর্ত হয়ে, তেমন গর্ত। অর্থাৎ রাতে খুব সম্ভবত সেই ম্যাডাম এসে, রাত্রিযাপন করে গিয়েছিলেন।
বাহ্ অ্যাডভোকেট সাহেব! বাহ্! আমি যেতে না যেতেই আপনি মৌজ মাস্তিও করা শুরু করে দিলেন, তাও আবার একটা নিরীহ মেয়েকে খুন করার জন্য কয়টা গুন্ডা পাঠানোর পর!

Comments