মেয়েটার মনে সঙ্কোচ প্রচুর। কিছু হবার আগেই মেয়েটা অতিরিক্ত চিন্তা করে বসে। মেয়েটা অনেক বেশি ভিতু এবং অনিশ্চিত। কিন্তু এর জন্য শুধু তাকেই পুরোপুরি দোষারোপ করলে চলবে না। মেয়েটার হাতে খুবই কঠিন কাজ দেয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তার আচরণ ওতটাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এমন সময় এমন আচরণ মানুষকে বিশাল বিপদে ফেলতে পারে।
এখন শুধু হাতে হাত রেখে, বসে থেকে, আশা করতে হবে যে মেয়েটা যাতে সবকিছু ঠিকমতো করতে পারে। সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হলে আজ রাত অযথা আরো দুজনকে মরতে হবে না। এখন শুধু আশাই করতে পারি। আশা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
আমি এসব নিয়ে ভাবছি, এমন সময়ে মেয়েটি ফিরে এলো। এসে আমাকে বলছিল, "আমি তাদের সঙ্গে কিছুটা খাতির জমিয়েছি। তারা আমার গান শুনতেও রাজি। পানি খাওয়ার বাহানা করে আপনাকে এটা জানাতে এসেছি।"
আমি মুচকি হেসে বললাম, "দারুণ! এখন শুধু এই লাশগুলো ফেলে নেই, তাহলেই শান্তি।"
"জি। আপনি লাশগুলো নিয়ে যাওয়ার পথে কোনো শব্দ যেন না করে বসেন, তা মাথায় থাকে।"
"আমি যত আস্তে সম্ভব, তত আস্তেই নিয়ে যাবো। আমার উপর বিশ্বাস করুন।"
"আপনার উপর বিশ্বাস করা ছাড়া অন্য কোনো রাস্তাও নেই আমার কাছে। আশা করছি, নিরাশ করবেন না।"
"জি। আমি আমার দিক থেকে পুরোপুরি চেষ্টা করবো।"
"ঠিক আছে। সাবধানে থাকবেন।" বলেই মেয়েটি আবার সেই দুজন অন্ধলোকের কাছে গান শোনাতে ফিরে গেল। মেয়েটা বলছিল, তাকে নিরাশ না করতে। কিন্তু মেয়েটি কি আদৌ জানে, নিরাশা নামক অনুভূতির জন্ম কোথা থেকে?
দুনিয়ার সকল নিরাশা এসে থাকে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর উপর মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে আশা রাখার ফলে। আমরা যখন কারো উপর এতটাই আস্থা রেখে ফেলি যে তারা সেটার জন্য প্রস্তুত কি না তাও ভেবে দেখি না, ঠিক তখনই নিরাশা নামক বোঝা, আকাশ থেকে আমাদের অসংখ্য আশার উপর পড়ে, সকল আশা ভেঙে চুরমার করে ফেলে। আশা হলো খুবই ভঙ্গুর একটা জিনিস। যত বেশি আশা কোনো কিছুর উপর রাখা হয়, তত বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয় তখন, যখন দেখা যায় সেই আশা কখনওই পূরণ হবে না।
কিন্তু আমি সেই মেয়েটার জীবন নিরাশ করে ফেলার জন্য বাঁচাইনি। তার জীবন বাঁচানোর মানেই হলো তাকে আর তার আশাগুলোকে জীবিত রাখারও দায়িত্ব নেয়া। তাই আজ কোনোভাবেই আমি কোনো ভুল করতে পারবো না। আজ হেরে গেলে জীবনটা পুরোপুরি বৃথা হয়ে যাবে।
এই চিন্তা মাথায় রেখে প্রথমে একটা লাশ বাকি দুটো হতে আলাদা করলাম। এরপর লাশের দুই হাতের কবজি ধরে আস্তে ধীরে, মেঝেতে ঘষতে ঘষতে ট্রেনের পেছনের দিকে নিয়ে যেতে লাগলাম।
নিয়ে যাওয়ার পথে প্রথমবার সেই বৃদ্ধ, অন্ধ লোকদের দিকে চোখ পড়লো। দুজন খুবই মনোযোগ দিয়ে মেয়েটার গান শুনছিল। এত মিষ্টি কন্ঠে কেউ গান শোনালে, আমিও ঠিক সেভাবেই মনোযোগ দিয়ে গান শুনতাম। কিন্তু এই বেচারারা টেরও পাচ্ছে না, তাদেরই সামনে দিয়ে লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই মধুর কন্ঠের ছলে কিছুক্ষণ মগ্ন থেকে আমার দিকে মনোযোগ না দিলেই কাজটা হয়ে যায়।
প্রথম লাশটা সফলভাবে ট্রেনের পেছনের দিকে নিয়ে, ফাঁকা জায়গা দিয়ে ফেলে দিলাম।
দ্বিতীয় লাশটা প্রথমটার তুলনায় বেশ ভারি ছিল। তিনজনের মধ্যে সবচাইতে ভারি দ্বিতীয়টাই ছিল।
তৃতীয় লাশটা প্রথম দুটোর তুলনায় বেশ হালকা ছিল। মৃত লোকটার চেহারা দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাদকাসক্ত ছিল এই লোকটাই। শরীর থেকে অত্যাধিক মাত্রায় মদের গন্ধও আসছিল। আর এই গন্ধের জন্য কিছুটা সন্দেহের শিকার হতে হয়।
ঠিক যখনই এই তৃতীয় লাশটা ট্রেনের পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই দুজন অন্ধ লোকের মধ্যে জিনি পুরুষমানুষ ছিলেন, উনি মদের গন্ধটা পেয়ে, জিজ্ঞাস করে বসলেন, "এই গন্ধটা মদের না? কোথা থেকে আসছে?"
মেয়েটা গান থামিয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমিও সেখানেই থেমে গেলাম।
মেয়েটা ঘাবড়ে বললো, "জানি না, আঙ্কেল।"
লোকটা নাক দিয়ে গন্ধের দিকে আরো কিছুটা মনোযোগ দিচ্ছিল। লোকটা বুঝতে পেরেছিল এখানে কিছু না কিছু হচ্ছে।
"আচ্ছা আশেপাশে কি কেউ মদ খাচ্ছে, দেখো তো?"
"না, আঙ্কেল। আমাদের আশেপাশে কেউ খাচ্ছে না।"
"একটু ঠিকমতো দেখে বলো না, মা।"
"আঙ্কেল হতে পারে পেছনের দিকে কেউ খাচ্ছে। আমি দেখে আসি?"
"হ্যাঁ, দেখে আসো।"
মেয়েটা এই সুযোগ নিয়ে আমার দিকে ইশারা করে বললো, লাশটা এখানেই কিছুক্ষণের জন্য রেখে দিতে।
তার কথামতো লাশটা সেখানেই রেখে, স্থিরভাবে দাড়িয়ে রইলাম।
মেয়েটা পেছনের দিকে দেখতে যাবে, এমন সময়ে বৃদ্ধা মহিলাটা তার স্বামীকে বলে উঠলেন, "একটা মেয়েকে পাঠাচ্ছেন এমন কাজে। তার জন্য তো মোটেও নিরাপদ না।" এরপর মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "মা, তোমার যাওয়ার কোনো দরকার নেই। কেউ মদ খেয়ে থাকলে খাক। এসব মানুষ মোটেও ভাল হয় না। তোমাকে কিছু করে ফেললে তো তোমার জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। যারা মদ খেয়ে, নেশা করে নিজের ক্ষতি করতে পারে, তারা অন্যের ক্ষতি করতে কখনও দ্বিধা বোধ করে না। এদের থেকে যত সম্ভব দূরে থাকাই ভাল।"
মহিলাটি অজান্তেই আমাদের কষ্ট কমিয়ে ফেললেন। আমি সেই মুহূর্তে কথা বলতে পারলে উনাকে ধন্যবাদ জানাতাম। কিন্তু এ সুযোগ আর কপালে নেই।
মেয়েটা বৃদ্ধা মহিলাটির কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। আমিও আবার লাশটার দুহাতের কবজি ধরে প্রস্তুত হয়ে পড়লাম। মেয়েটা তাদেরকে আরেকটা গান শোনাতে শুরু করল, আর তারা আবার নিজের মনোযোগ তাদের দিকে ফেরালেন। এই সুযোগ পাওয়ামাত্র আমি লাশটা আস্তে ধীরে নিয়ে ফেলে দিলাম। তিনটি লাশ সফলভাবে ট্রেন থেকে ফেলার পর এক স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। এমন গভীর রাতের আঁধারে, তিনটি লাশ তিনটি ভিন্ন স্থানে ফেলা হলো।
এরপর আমি আবার আস্তে আস্তে হেঁটে আমার সিটের দিকে ফিরে গেলাম। আর যাওয়ার পথে মেয়েটাকে ইশারার মাধ্যমে এসে পড়তে বললাম। মেয়েটা তাদের কাছে ঘুমের বাহানা করে, চুপচাপ ফিরে এলো। তৎকালীন বিপদ মাথার উপর দিয়ে সরামাত্র মেয়েটা কান্নায় ভেঙে পড়লো। প্রথম দেখায় মনে হচ্ছিল, হতে পারে আজ রাতের এই ঘটনা নিয়েই হয়তো নিজেকে দোষী ভেবে কাঁদছে। কিন্তু জিজ্ঞাস করাতে জানতে পেলাম, কারণটা ছিল পুরোপুরি ভিন্ন।
আমি সবসময়ের মতোই জ্ঞান দেওয়া শুরু করে দিলাম। বলতে লাগলাম, "এগুলো নিয়ে নিজেকে দোষী ভেবে কোনো লাভ নেই। যাদেরকে মেরেছি, তাদের কেউই ভাল কিছু ছিল না। আপনি তাদের মৃত্যুতে অশ্রু বাহাচ্ছেন কেন?"
মেয়েটা কান্না থামিয়ে, আমার দিকে গভীর নজরে তাকিয়ে রইল। আমি তার উত্তরের অপেক্ষায় নীরবতা পালন করছিলাম। সেই নীরবতার মধ্য দিয়েও বিদ্যমান ছিল আন্তরিক কিছু কথোপকথন।
সেই নীরব সংলাপ চলছিল একে অপরের চোখে চোখ রেখে। উভয়ের মধ্যে কারো ঠোঁট নড়ছিল না, কিন্তু কথা সুস্পষ্ট হচ্ছিল।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিলাম, আমার ধারণা ভুল ছিল। কখনও ভাবতেও পারিনি জীবনে এক পর্যায়ে এসে পৌছাবো। এমনই এক পর্যায়, যেখান থেকে ফিরে যাওয়া নিজের জীবনের জন্যই ভাল, কিন্তু সেই জীবন হবে শুধু এক জ্যান্ত লাশের। সেই জীবন হবে লজ্জার। সেই জীবন হবে পুরোপুরি বৃথা।
মেয়েটা অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর, হঠাৎ বলে উঠলো, "আমি এসব ভেবে কাঁদছি না। আমি কাঁদছি অন্যকিছু নিয়ে।"
আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাস, "এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার সত্ত্বেও অন্য এক ঘটনা মনে করে কাঁদছেন! বিষয়টা বেশ সাংঘাতিক কিছু হবে, যা এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেও মন থেকে সরার নাম নেয় না।"
"জি, এমন কিছুই ভেবে নেন।"
"হুম! যদি মনে কিছু না করে থাকেন, তবে আমাকে বলা যাবে?"
"আপনার কাছ থেকে এখন লুকাবার মতো আমার বেশি কিছু নেই। কিন্তু এটা শোনার পর আপনাকে আমার জন্য একটা কাজ করতে হবে।"
অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "জি, কাজ বলতে?"
"বেশি কঠিন কিছু না। পরবর্তী স্টেশনে আমার সঙ্গে নেমে, আমাকে তার কাছে নিয়ে যাবেন যার জন্য ঐ গুন্ডাগুলো কাজ করতো।"
"এসব কি বলছেন আপনি? মাথা ঠিক আছে তো? আমি অনেক কষ্ট করে সেখান থেকে রেহাই পেয়েছি। আমার সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান কাজ হলো এখন বাড়ি ফিরে যাওয়া।"
"আপনি আমার সাহায্য না করলে, আমিও আপনাকে আমার কান্নার কারণ বলবো না।"
একথা শুনে, রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলাম, "আপনার কাহিনি শোনার আগেও যা ছিলাম, তাই থাকবো। আপনার সঙ্গে এমন কি হয়েছে না হয়েছে, এসব জানার আগ্রহের খাতির আমার স্বপ্নগুলো নষ্ট করে ফেলব না। আপনার দুঃখের কাহিনি আপনার কাছেই রাখুন।"
মেয়েটা আমার কথা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শুধু চুপচাপ আমার কথাগুলো শুনেই গেল। দেখে মনে হচ্ছিল, সে কিছুর অপেক্ষায় আছে।
আমি যেমনেই তাকে ঝাড়ি দেওয়ার পর, তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে, আবার তার চোখের দিকে তাকালাম, ঠিক তখনই সে কিছু বলতে নিলো। বলতে নিয়ে প্রথমবার একটু থেমে গেল।
দ্বিতীয়বারের মতো বলে উঠলো, "আমার বড় বোন ঢাকা শহরের একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। মাসখানেক আগেই সে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পরে তাকে মেরে ফেলা হয়। আর তারপর তার মৃতদেহটা পুড়িয়ে ফেলা হয়।"
মেয়েটা কিছুক্ষণ কান্না আটকে রেখে এসব বলার পর, কান্নায় ভেঙে পড়ে আরো বললো, "আমি জানি, আমার জন্য এত কিছু করার পর আপনার কাছে কিছু চাওয়া মোটেও ঠিক না। কিন্তু আমি করবো, বলুন? আমার কাছে আর কোনো রাস্তা নেই। আমি এখন পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়েছি।"
নিজের চোখের পানি মুছতে মুছতে সে আরো বললো, "আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন শুধুমাত্র আমার উপর রহম খেয়ে। কিন্তু এই জীবনটা পুরোপুরি বৃথা হয়ে যাবে, যদি আমি আমার বোনের উপর হওয়া অন্যায়গুলোর প্রতিশোধ না নিতে পারি।" অতঃপর আমার সামনে হাত জোর করে সাহায্যের ভিক্ষা চাইতে লাগল।
আমি সেই রাত সবকিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু এ কি শুনে বসলাম! মেয়েটার বেদনাদায়ক কন্ঠে এমন দুর্দান্ত এক সংবাদ শুনে ফেটে যাচ্ছিল। কোন ধরনের জানোয়ার হতে হয় এমন এক অপরাধ করার জন্য! আর কতো বড় এক জানোয়ারের পরিচয় আমি দিব, যদি আমি এই মেয়েকে এমন সময়ে মানা করে দেই?
এগুলো প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক করছিল। চোখ থেকে অশ্রুগুলো ঝড়ে পড়বার জন্য মাত্তম করছিল করে চিৎকার করছিল। কিন্তু মাথায় চির বিরাজমান ছিল সেই ব্যাগ ভরা টাকা পৌঁছানোর কথা।
মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। মুখ থেকে যা বের হবে, তা শুধু আমার একার ভবিষ্যতের উপর প্রভাব ফেলবে না। তার প্রভাব আরো অসংখ্য মানুষের উপর পড়বে। তাই কিছু না বলে, কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত নেবার জন্য ওতটা ভাবতে হয়নি। এ নীরবতার মধ্যেই যাতে সকল সমস্যার সমাধান কোনো চমৎকারের দ্বারা আমাদের মাঝে পৌঁছে যাক। এ আশা নিয়েই নীরবতা পালন করছিলাম।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর, মুখ খোলার সাহস পেলাম।
সাহস করে বললাম, "আমি আপনার এই শেষ একটা সাহায্য করতে রাজি আছি। কিন্তু আমি আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাবো না।"
মেয়েটা আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলো, "মানে? তাহলে কীভাবে সাহায্য করবেন?"
"আমি উনার সম্বন্ধে যা কিছু জানি, তা সবই আপনাকে বলতে রাজি আছি। কিন্তু তা আমি বলবো একটি শর্তে।"
"জি, কেমন শর্ত?"
"আপনি কোনোভাবেই আমার কোনো ধরনের পরিচয় দিতে পারবেন না। আমাকে কথা দিন, তাহলে আমি সব বলতে রাজি আছি।"
"জি, আমি রাজি। কিন্তু অন্তত আমাকে ঢাকা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসেন।"
"তা করতে পারবো। কিন্তু আমার জন্য সাক্ষাতের পূর্বেও তো আপনি একা ছিলেন। হঠাৎ আমাকে সাথে রাখার প্রয়োজন অনুভব করছেন কেন?"
মেয়েটা মেঝের দিকে তাকিয়ে, কান্নায় ভেঙে পড়ে, আমাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরল। তার কোমল দুটো হাত আমার চিকন কাঁধের ওপর, তার কপাল আমার বুকের উপর, আর তার সমস্ত দেহের ভার আমার ওপর। জীবনে প্রথমবার কোনো পরনারীর শরীরের সঙ্গে এভাবে, এতো নিকটে এসেছি। জীবনে প্রথমবার কোনো মেয়ের সঙ্গে এভাবে গা ঘেষে দাড়িয়ে ছিলাম। অনুভূতিটা আসলেই অসাধারণ। এক নারীর স্পর্শ পাওয়ার অনুভূতি আমার কাছে নতুন ছিল, কিন্তু এর দ্বারা আমার মন যেই তৃপ্তি পেয়েছে, তার জন্য যেন সে চিরকাল ধরে অপেক্ষায় ছিল। এ স্পর্শে ছিল না কোনো নোংরামি, ছিল না কোনো অসৎ উদ্দেশ্য, ছিল না কোনো খারাপ নিয়ত। সেখানে বিদ্যমান ছিল শুধু নির্ভরতা। একজন অসহায় নারীর একজন বীরত্বপূর্ণ পুরুষের উপর। তার শরীর প্রতিটি অঙ্গ আমার কাছে সাহায্য চাচ্ছিল। তার গায়ের সুবাসিনী সুগন্ধি এবার আমার জামার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। কি সুন্দর এক মুহূর্ত ছিল! কি সুন্দর তার গায়ের সুবাস! কি সুন্দর সেই অল্প কিছু শব্দ! সেই শব্দ, যা আমাদের উভয়ের কারো ঠোঁট দিয়েও বের হয়নি। শরীরের সঙ্গে শরীর শুধু স্পর্শেই রয়েছিল। কিন্তু কথপোকথন চলছিল দু হৃদয়ের মাঝে।
এ কথপোকথন সবার জন্য নয়। এ কথপোকথন সবার ভাগ্যে নয়। যার ভাগ্যে একবার জুটে পড়ে, সে উজ্জীবিত হয়ে উঠে পড়ে। আর যার ভাগ্যে এ কথপোকথন জীবনে একবারও জুটে না, সে যে কি মাপের দুর্ভাগা, সে তা নিজেও বোঝে না। এভাবেই দুজন মিশে যাচ্ছিলাম একে অপরের ওপর নির্ভরশীল ভাবনা দেখে। ভোর কখন, কিভাবে হলো, কেউ টের পাইনি কারণ আবেগে ছিলাম মেতে।
আমাকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা কখন ঘুমিয়ে পড়ল, তা হয়ত সে নিজেও বুঝতে পারেনি। ভোরবেলা সূর্যের কিরণ পড়তেই না পড়তে, মেয়েটা চমকে উঠলো। উঠে দেখল; আমি তাকে, নিজের বুকের উপর ভারপ্রাপ্ত অবস্থায় রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি এর চেয়ে শান্তির ঘুম আমার সারাটা জীবনে কখনও অনুভব করিনি। মেয়েটা ঘুম থেকে উঠে, খুবই নম্রভাবে আমার শরীরের উপর থেকে উঠে দাঁড়াল। উঠে খেয়াল করলো; তাকে শরীরের উপর রেখে এতক্ষণ এভাবে ঘুমিয়ে থাকার কারণে আমার হাত এবং পা খুবই বেকায়দা অবস্থায় ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। ব্যপারটা লক্ষ করে, সে আমার হাত এবং পা যত্নসহকারে, সিটের উপর তুলে রাখল। আমার হাত উঠিয়ে রাখাতে, আমি ঘুমের মধ্যে দিক পরিবর্তন করতে গিয়ে, পড়ে যেতে নিয়েছিলাম। মেয়েটা দ্রুত আমার সমস্ত শরীরের ভার, নিজের দুটো হাত দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছিল। আমার উঠতে আরো এক ঘণ্টা বাকি ছিল। সেই একটা ঘণ্টা সে আমার সমস্ত শরীরের ভার সহ্য করছিল, যাতে আমি মেঝেতে পড়ে ব্যথা না পেয়ে যাই। ট্রেনের সকল যাত্রী নামা শুরু করল। অনেকে তাকে এই অবস্থায় দেখে গেল। যাত্রীদের আওয়াজ এবং কুলিদের ডাক শুনে আমার ঘুম ভাঙল।
আমি চোখ খোলামাত্র দেখি এই অবস্থা। এই দৃশ্য দেখে এতটাই অবাক হয়ে পড়েছিলাম, যে কি বলা উচিত, তা বুঝে পাচ্ছিলাম না।
ভাগ্যবশত আমার কিছুই বলতে হয়নি। আমার ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই সে খেয়াল করল। যত্নসহকারে নিজের হাত সরিয়ে নিল। আমি গভীরভাবে তার দুচোখে ডুবে ছিলাম, তাই তখন নিজে নিজেই উঠে পড়ার মতো খেয়ালও ছিল না।
দুজনেই মানসিকভাবে অসহায়। দুজনেই শারীরিকভাবে ভেঙে পড়া। সারারাত শুধু কেঁদে, ভেবে এবং অপরাধে যাপন করা দুই যাত্রী।
এসব ভাবার মাঝখানে সে মেঝেতে উঠে দাড়িয়ে, বলে উঠলো, "চলুন নেমে পড়ি। নেমে আবার পরের ট্রেন ধরে ঢাকার দিকে রওনা দিব।"
"জি, অবশ্যই।" আমি বললাম, চোখ ডলন করতে করতে।
"আপনি কাপড় পালটে নেন। আমি সামনের দিক থেকে হয়ে আসি।" বলেই মেয়েটা চোখ নিচু করে, ট্রেনের সামনের দিকে হাঁটতে লাগল।
আমি মাঝপথে ডেকে উঠলাম, "জি, শুনেন!"
মেয়েটা মাঝপথে থেমে, ঘুরে তাকিয়ে বললো, "জি, বলেন।"
লজ্জিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "আপনি কতক্ষণ ধরে আমার শরীরটা এভাবে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন?"
মেয়েটা মুচকি হেসে জিজ্ঞাস করলো, "কেন? প্রতিশোধ করার ইচ্ছে আছে নাকি?"
আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, "জি, বুঝতে পারলাম না।"
"কিছু না। আপনি যতক্ষণ আমার শরীরের ওজন সহ্য করে রেখেছিলেন, তার তুলনায় আমি কিছুই করতে পারিনি। এগুলো নিয়ে বেশি ভেবে লাভ নেই। তাড়াতাড়ি কাপড় পালটে নিন। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেন আবার ছাড়বে।"
ঠিক তখনই আমার মনে পড়ল, ট্রেন তো এতক্ষণ থেমে থাকার কথা না। তাই জিজ্ঞাস করে উঠলাম, "আচ্ছা, ট্রেনটা এতক্ষণ ধরে দাড়িয়ে থাকার কারণ কি? সাধারণত তো অল্প সময়ের মধ্যেই ছেড়ে দেয়।"
"ট্রেন থামানোর পর এক যাত্রী দেখে, কন্ডাক্টর মাটিতে বেহুঁশ পড়ে আছে। তাকে ওঠানোর পরে জানা গেল, কয়েকজন মিলে, তাকে বেহুঁশ করার ওষুধের মাধ্যমে বেহুঁশ করে, সেখানেই ফেলে যায়। তাই পুলিশ ডেকেছে তদন্তের জন্য।"
"আচ্ছা! এখন বুঝতে পেরেছি।"
"জি।"
"কারো তল্লাশি নিচ্ছে না তো?"
"না। শুধু সবাইকে ডেকে ডেকে একবার চেহারা দেখিয়ে যেতে বলছে কন্ডাক্টরের কাছে। যদিও তল্লাশি করাটা আরো ভাল হতো। এভাবে হঠাৎ করে সকল যাত্রীকে হয়রানিতে ফালানোতে তাদেরই দুর্নাম ছড়াবে বলে এভাবে চেহারা দেখিয়ে চেনার চেষ্টা করছে।"
"যাক! আমাদের জন্য সুবিধা হলো।"
"হ্যাঁ। ওঃ, ভাল কথা মনে পড়ল। আপনি চাকুটা কি করলেন?"
"সেটা! তা তো প্রথম লাশের সাথেই ফেলে দিয়েছিলাম।"
"প্রথমটার সাথেই! কিন্তু আপনি না কোনো ত্রুটি হলেই তা ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন? তাহলে প্রথমটার সঙ্গে ফেলে দিলেন কেন? ফেলা তো উচিত ছিল সবকিছুর শেষে ফেলা।"
মুচকি হেসে বললাম, "তা আমি জানি। কিন্তু আপনার উপর আমার পুরা ভরসা ছিল। তাই আমি প্রথমবারেই তা ফেলে দিলাম। কারণ আমার বিশ্বাস ছিল, আপনি এটা করে দেখাতে পারবেন।"
আমার উত্তরটা শুনে মেয়েটা কিছুক্ষণ লজ্জার চোখ নিয়ে, এক আনন্দের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। মুখে এক মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছিল তার। এই মিষ্টি হাসির মুখে, মিষ্টি কন্ঠে বলে উঠলো, "ধন্যবাদ। আমার উপর আস্থা রাখার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।" বলে চোখ দুটো নামিয়ে আরো বললো, "এবার তাড়াতাড়ি কাপড় পালটে নিন। আমি আমার চেহারা দেখিয়ে আসি।" বলে আবার ট্রেনের সামনের দিকে হাঁটতে লাগল।
আমি কিছুক্ষণ বসে ভাবলাম, এসবের পরিণতি কি হতে পারে। আদতে কি আমি আমার লক্ষগুলো পূরণ করতে পারবো? আমি যেগুলোকে লক্ষ বলে প্রাধান্য দেই, সেগুলো কি আদৌ আমার জীবিত থাকার মূল উদ্দেশ্য?
এসব ভাবার ওত সময় ছিল না বলে ঝটপট কাপড় পালটে নিলাম। ভাল করে আশেপাশে দেখে নিলাম, কেউ আছে কি না। যখন নিশ্চিত হলাম কেউই দেখছে না, তখন ব্যাগটার ভেতরে খুলে দেখলাম, সব টাকা ঠিকঠাক জায়গামতো আছে কি না। যখন নিশ্চিত হলাম, কিছু এদিকসেদিক হয়নি, তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। অতঃপর মেয়েটা ফেরত এলো। এসে বললো, "আমারটা হয়ে গিয়েছে। এবার আপনিও গিয়ে নিজের চেহারা দেখিয়ে আসেন।"
"জি।" বলেই উঠে, ট্রেনের সামনের দিকে গিয়ে, কন্ডাক্টরকে নিজের চেহারা দেখিয়ে আসলাম। আমি জানতাম, এ কাজটা কোনো মহিলা করেনি। সেও জানত, কিন্তু তাও মেয়েটাকেও শুধু শুধু চেহারা দেখাতে ডাকলো। বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার! কিন্তু আমি সেখানে এই প্রসঙ্গে কোনো প্রশ্নও করিনি। নাহলে আমার উপরও এরা সন্দেহ করে বসতে পারতো। জীবনে চুপ থাকাটা কতো কাজে লাগতে পারে, তা প্রাথমিকভাবে শিখতে পারছিলাম।
আমরা সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে, ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। নামার সঙ্গে সঙ্গে একগাদা কুলি আমাদের সামনে এসে, আমার মালপত্র কাঁধে তোলার জন্য তর্কাতর্কি শুরু করে দিল। আমাদের কাছে যে মালপত্র ছিল, তা ভারি না, এমন কোনো কথা না। কিন্তু ব্যাগের ভেতর আঠারো কোটি টাকা থাকার কারণে, একটা কুলি নেওয়াতে দ্বিধা বোধ করছিলাম। মেয়েটা এর সম্বন্ধে না জানার ফলে, কুলি নেওয়ার জন্য জোড় করছিল। কয়েকবার তো এমনও বললো যে কুলির ভাড়া সেই দিবে। সে মনে করছিল, হয়তো টাকার অভাবে এমন করছিলাম। নাহলে মনে করছিল, আমাকে দ্বারা এতো কাজ করানো ঠিক হবে না। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে তাকে কিছু বলতেও পারছিলাম না। তাই সবার হাত সরিয়ে, একাই একাই হাঁটতে লাগলাম। আমার এ আচরণ দেখে মেয়েটা মনে কষ্ট পেয়েছিল, এটা তার চেহারায় স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছিল।
আমি তবুও থামিনি। থামতে পারিনি। শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে হেঁটেই গেলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর স্টেশন থেকে একটু দূরে এসে পড়লাম। মেয়েটা ঠিক আমার পিছনে পিছনে হেঁটে চলে আসছিল। আমি রাস্তা পার করে একটি পুরাতন কারখানার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কারখানার গেটের সামনে ব্যাগটা রেখে একটু আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম খাওয়ার জন্য ভাল কোনো হোটেল আছে কি না। অতঃপর মেয়েটা এসে আমাকে জিজ্ঞাস করলো, "আমাকে এভাবে রেখে চলে এলেন কেন?"
আমি কিছুটা অবাক হবার ভাণ করে বললাম, "আমি কোথায় আপনাকে রেখে আসলাম? আপনি তো ঠিকই আমার সাথে এখান পর্যন্ত এসে পড়লেন।"
মেয়েটা আমার কথায় মোটেও সন্তুষ্ট ছিল না। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল বড়ই নিরাশ আমার উপর। আমার চেহারাও দেখতে ইচ্ছা নেই বলে; হাত দুটোর বাহু ক্রস করে, মুখ সরিয়ে, পাশের দিকে তাকিয়ে ছিল।
আমি কিছু বললে হয়তো আরো রেগে যাবে। আমি চাই এই ব্যাগে লুকোনো রহস্য যাতে রহস্য-ই রয়ে যাক। কিন্তু তার পাশাপাশি এই মেয়েটার মনে কষ্ট দিতেও ভাল লাগছে না। মন তো মনের কাছ থেকে আশা রাখে। টাকাপয়সা তো বস্তুত প্রয়োজন। মনের কাছে সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো অন্য কারো মনের ভেতর জায়গা দখল করে আধিপত্য বিস্তার করা। সে ভাল করে জানে, এতে কোনো লাভ নেই। এতে অনুভূতি ছাড়া আর কিছুই নেই। কারো সম্পত্তি দখল করে আধিপত্য বিস্তার করলে তো তা সবার কাছে স্পষ্ট দেখা দেয়। তার প্রমাণ সরাসরি দেয়া যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে মনের ব্যাপারটা বেশ ভিন্ন। মনের আধিপত্য প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই। কার মনের মধ্যে কে কতটা স্থান দখল করতে পেরেছে, তা দেখার কোনো উপায় নেই। এমন তথ্য জানারও কোনো উপায় নেই। শুধু অনুভূতির দ্বারা এর অনুসন্ধান পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে এটা কিছুই না। এমন কিছুই না যা আমার বাঁচার জন্য অনস্বীকার্য। কিন্তু মনমতো বেঁচে থাকতে হলে এর প্রয়োজন রয়েছে। আর যদি আমি আমার মনের চাহিদাসমূহ একেবারেই অস্বীকার করে দেই, তবেই আমি নিজের মনুষ্যত্ব পুরোপুরি হারিয়ে ফেলব। হারিয়ে ফেলব সেই চেতনা, যা আমার বেঁচে থাকতে অনুপ্রাণিত করে থাকে। তাই তো পৃথিবীর ইতিহাসে বহু কিংবদন্তি রয়েছেন যারা শুধু এই উপাধি পেয়েছিলেন একটিমাত্র কারণে। সেই কারণটি ছিল, পৃথিবীর বাকি মানুষের মতো নিজের চেতনার হত্যা না করে, নিজের মনের মধ্যে বিদ্যমান আগুন জ্বালিয়ে সকলের সামনে প্রদর্শন করা। ইতিহাস তাদের স্মরণ করে কারণ তারা বাকিদের মধ্যে বিদ্যমান নেতিবাচক চেতনাকে বর্জন করেছেন। ইতিহাস তাদের স্মরণ করে কারণ তারা নিজের জীবনের প্রকৃত লক্ষ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারা নিজের মনের কথা শুনেছিলেন। বস্তুত প্রয়োজন নিয়ে চিন্তাভাবনা বর্জন করেছিলেন। তারা শক্ত এবং মজবুত মানসিকতার অধিকারী ছিলেন। সকলের পক্ষে তা সম্ভব না। আমি নিজেও তাদেরই একজন।
এত কিছু ভাবতে ভাবতে পেট সাড়া দিল। ক্ষিদে বাড়ছে। পেটের গর্জন শুনে মেয়েটাকে বললাম, "আপনি রাগ করেন আর যা-ই করেন, অন্তত সকালের নাস্তা করে নেন।"
মেয়েটা আমার কথায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে, ঠিক আগের মতো অবস্থায় মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিল। বুঝতে পেলাম, এভাবে করে কোনো কাজ হবে না। মেয়েটাকে কোনোভাবে রাজি করাতে হবে। তাকে রাজি করাতে আমি কিছু বলতে নিবো, এমতাবস্থায় কারখানার ভেতর থেকে জোরে এক শব্দ এলো। শব্দটা শুনে কানের মধ্যে গুঞ্জন হচ্ছিল। শব্দটা ছিল একটি বিস্ফরনের। তার কিছুক্ষণ পরই পুরো জায়গাটা পুলিশ দিয়ে ভরে গেল। চারিদিক থেকে পুলিশ এসে কারখানা ঘেরাও করে নিল। তাদের মধ্যে একজন পুলিশ অফিসার আমাদের তাড়াতাড়ি এখান থেকে দূরে কোথাও যেতে। একথা শুনে মেয়েটা আমার হাত ধরে রাস্তার বিপরীত দিকে দৌড় দিল। আমার কানে তখনও গুঞ্জন হচ্ছিল বিধায় আমি পরিস্থিতি ঠিকমতো বুঝতে পারছিলাম না। তাই মেয়েটার সঙ্গে সঙ্গে আমিও দ্রুত রাস্তার বিপরীত দিকে দৌড় দিলাম। কিন্তু ব্যাগটা সেখানেই রয়ে গিয়েছিল। ব্যাগটা সাথে নিয়ে দৌড় দেওয়ার কথা আমার খেয়ালে না থাকায় ব্যাগটা সেখানেই রেখে দৌড় দিয়েছিলাম। ব্যাগের কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি মেয়েটার হাত ছাড়িয়ে, আবার কারখানার দিকে দৌড় দিলাম। পুলিশেরা আমাকে যেতে দিচ্ছিল না, তবুও আমি ব্যাগ পর্যন্ত যাওয়ার অনেক চেষ্টা করছিলাম। এমতাবস্থায় আরেকটি বিস্ফরনের শব্দ এলো। এবারেরটি আগেরটির চেয়ে বড় ছিল। আমার কানে আবার গুঞ্জন হতে শুরু করল। এবারের গুঞ্জন ছিল তীব্র মাত্রার। আমি এই অবস্থায় কানে হাতে রেখে, মাটিতে পড়ে গেলাম। তখনই দেখি কারখানার ভেতর থেকে কয়জন বেড়িয়ে আসছে। প্রায় সাত থেকে আটজন, হাতে বন্দুক নিয়ে এবং মুখে কাপড় পেঁচিয়ে। তাদের সবারই পরিধানে ছিল হলুদ ফোঁটাযুক্ত কমলা রঙের কাপড়। মুখে পেঁচানো কাপড়ও একই রকম ছিল। তাদের হাতে থাকা বন্দুক দিয়ে পুলিশের দিকে গুলি করতে লাগল। তাদের মাঝে একজন ছিল খুবই লম্বা। সেই লম্বা সন্ত্রাসীটা ধীরে ধীরে আগে বাড়তে লাগল। ঠিক তখনই আমার সামনের পুলিশ অফিসার তার গলায় গুলি করে বসে।
দৃশ্যটা দেখে মনে হচ্ছিল, আমি একটি যুদ্ধের মাঝে আছি। বুকটা থরথর করে কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল, শেষমেশ এই সন্ত্রাসীদের গুলি খেয়েই বোধহয় মরতে হবে।
সেসময় আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার মনের মধ্যে আলাদা করে যুদ্ধ লেগেছিল আমার লোভ এবং নিজের জীবনের প্রতি ভালবাসার মধ্যে। আমার লোভী প্রকৃতি আমাকে দুঃসাহসের সঙ্গে, সেই ব্যাগ নেওয়ার জন্য চেষ্টা করতে বলছিল। আমাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল আমার দারিদ্রতার দোহাই দিয়ে।
অপরদিকে আমার বুকের সব পানি শুকিয়ে গিয়েছিল। জীবনের প্রতি মায়ায় কিছুই করতে পারছিলাম না। শরীরটা সেখানে শক্ত হয়ে পড়েছিল। চারিদিকে গুলির আওয়াজ। আমার পাশের একজন পুলিশ অফিসারের পায়ের হাঁটুর মধ্যে গুলি লেগেছিল। তখন মনের ভেতর আরো আতঙ্ক ঢুকে পড়ল। আমার পাশের জনের লাগতে পারলে আমার লাগতে আর কতক্ষণ? লোভে এসে যেভাবে বিপদের মাঝে ঝাঁপ দিয়ে বসলাম, তা কি আদৌ ঠিক হয়েছে আমার? আমি কি আমার সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে, নিজের জীবনটাই বিসর্জন করতে নিচ্ছি?
বড়ই কঠিন প্রশ্ন এগুলো। এগুলোর উত্তর খুঁজে বের করার মতো সময়টুকু পাবো কি না, বুঝতে পারছিলাম না। দেখতেই দেখতে আমাকে একটু আগে যে পুলিশ অফিসার সরতে বলেছিলেন, উনি নিজেই একটা গুলি খেয়ে আহত হলেন। গুলিটি লেগেছিল তার ডান হাতের বাহুতে। আমি তার ডান পাশেই অবস্থানরত ছিলাম। অর্থাৎ গুলি শুধু তার বুহুতে লাগেনি, গুলিটি আমার একদম কাছে দিয়ে গেল। তখন মনে হচ্ছিল, মৃত্যু আরো কাছে এসে পড়ল। বেঁচে থাকার সকল আশা বর্জন করে, চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম।
মৃত্যুর অপেক্ষায় মাটিতে নিরীহ অবস্থায় পড়ে ছিলাম। ঠিক তখনই পিছন থেকে জোরে এক মহিমান্বিত কন্ঠের অধিকারী একজনের ডাক শুনতে পেলাম। এমন বীরপুরুষের মতো পৌরুষপূর্ণ কন্ঠ বিশিষ্ট লোকটা চিল্লিয়ে বললো, "সবাই ডিফেন্সের জন্য প্রস্তুত হও।"
এমন কন্ঠে একথা শুনে আমি চোখ না খুলে থাকতে পারলাম না।
চোখ আস্তে করে খুলে দেখি প্রায় ছয় ফুট লম্বা, সম্পূর্ণ কালো পোশাক পড়া একজন লোক, হাতে বৃহৎ আকৃতির একটি বন্দুকের মতো অস্ত্র নিয়ে কারখানার দিকে আগে বাড়ছিল। লোকটার বন্দুকের মতো অস্ত্রের মুখখানা ছিল পিভিসি পাইপের মতো চওড়া।
আমার পাশের পুলিশ অফিসার আমাকে কাছে টেনে নিজের ঢালের পেছনে নিয়ে নিল। বুঝতে পেলাম, আসল খেলা এবার শুরু হবে।
লোকটা বাকি পুলিশ অফিসারদের চাইতে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে আগে গিয়ে দাঁড়ালেন। কারখানার সামনে অবস্থানরত সন্ত্রাসীরা এ দৃশ্য দেখে, সবাই সমান লাইন করে দাঁড়িয়ে নিজেদের বন্দুকের ম্যাগাজিন পরিবর্তন করতে লাগল। বোধহয় এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন এই কালো পোশাকে অস্ত্রধারী লোকটি। দেখে মনে হচ্ছিল, লোকটি খুব সম্ভবত এই পুলিশ অফিসারদের সিনিয়র অফিসার। সেই সিনিয়র অফিসারটি নিজের বৃহৎ আকৃতির সেই অস্ত্র দ্বারা তাদের মাঝে একটি ছোট আকৃতির বোমা নিক্ষেপ করলেন। বোমাটি কিছুটা কারখানা এবং সেই সন্ত্রাসীদের মাঝামাঝি স্থানে গিয়ে পড়ল। বোমাটির বিস্ফারনের ফলে তারা আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তারপর সেই সিনিয়র অফিসার আরেকটি অস্ত্র এনে তা দ্বারা সন্ত্রাসীদের প্রত্যেকের উপর ব্যাটারির মতো দেখতে কিছু নিক্ষেপ করলেন। সেই ব্যাটারির মতো দেখতে অস্ত্রটি তাদের দেহে স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে তারা এক বৈদ্যুতিক ঝটকা খেয়ে, কিছুক্ষণ ছটফট করে বেহুঁশ হয়ে পড়ল। মনে হচ্ছিল অবশেষে যুদ্ধ শেষ হলো, কিন্তু সেটা ছিল আমার জ্ঞানের স্বল্পতা।
আমি উঠতে নিতে নিলে আমার পাশের পুলিশ অফিসার, আমার হাত ধরে টান দিয়ে বললেন, "চুপচাপ বসে থাকো। স্যার এখনও ওঠার নির্দেশ দেননি।"
আমি মনোযোগ সহিত উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখছিলাম; উনি নিজের হাতের কব্জিতে অবস্থিত একটি হাতঘড়ির মতো যন্ত্রে কিছু দেখছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল উনি কিছু খোঁজার দৃঢ় চেষ্টা করছেন। হঠাৎ করে উনার মুখে একটি মুচকি হাসি ফোটে উঠল। যা খোঁজার চেষ্টা করছিলেন, তা পেয়ে যাওয়ার লক্ষণ বোধহয়।
ওনার হাতের সেই যন্ত্রে দুবার স্পর্শ করে, কারখানার উপরের দিকে তাকালেন। এই দৃশ্য দেখে আমিও ঠিক সেই দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখে চাপ প্রয়োগ করে দেখতে পেলাম আর্মিদের পোশাকের মতো রঙের ছোট একটি উড়ন্ত যন্ত্র। সেই যন্ত্রের দ্বারা কারখানার ছাদের এক স্থান থেকে, কারখানার ভেতর বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। তখন বুঝতে পেলাম, কিছুক্ষণ আগে ওখান দিয়েই বিস্ফারনের শব্দ আসছিল।
এরপর সিনিয়র অফিসার নিজের ডান হাত দ্বারা ইশারার মাধ্যমে কারখানার বিল্ডিং ঘেরাও করে ফেলতে বললেন। ওনার ইশারা দেখে বাকি পুলিশ অফিসাররা ধীরে ধীরে কারখানার দিকে এগোতে লাগল। আমার পাশের পুলিশ অফিসার আমার সঙ্গে জায়গামতো অবস্থানরত ছিলেন। দৃশ্যটা দেখে আমার বুকের থরথর আরো বাড়তে লাগল। কিন্তু গোলাগুলি স্থগিত হওয়ার কারণে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করছিলাম।
কারখানার বিল্ডিং পুরোপুরি ঘেরাও হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সিনিয়র অফিসার তাদের পিছনে পিছনে এগোতে শুরু করলেন।
কারখানার ভেতর থেকে আরো একজন চিৎকার করতে করতে বেড়িয়ে এলো, "কেউ আগে বাড়বি না। আমার দেহে বম লাগানো। কাছে আসলে সবাইকে একসঙ্গে উড়িয়ে দিব।"
তখন সিনিয়র অফিসার ওনার সেই অস্ত্র দ্বারা তাকে সেই ব্যাটারির মতো দেখতে বস্তু মেরে বেহুঁশ করে ফেললেন। এখানে মজার ব্যাপার হলো, উনি নিশানা লাগিয়েছিলেন তার দেহে লাগানো সেই বমের উপর। কিন্তু বোমাটা মোটেও বিস্ফারিত হয়নি। তা দেখে আমি বেশ অবাক হলাম। এর মানে, সেই সন্ত্রাসীটা মিথ্যে বলছিল!
সিনিয়র অফিসার এবার ইশারার মাধ্যমে সবাইকে স্বাভাবিক হবার নির্দেশ দিলেন। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। পুলিশ অফিসাররা একেক করে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে পুলিশের জিপে ঢোকানো শুরু করতে লাগল। আমার পাশের পুলিশ অফিসার আহত হবার ফলে তাকে আরো দুইজন পুলিশ অফিসার ধরে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেল। কিন্তু যাওয়ার আগে সেই অফিসারটা আমাকে ধরে রাখতে বলে গেল। এক বিপদ কাটতে না কাটতেই এসে পড়ল আরেক বিপদ। কপালটাই খারাপ আমার।
আমি অতি মাত্রার চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিন্তু এখানে মজার ব্যাপারটা হলো গিয়ে, আমি ছোট থেকেই এমন সব অবস্থাগুলোতে খুবই শান্ত থাকতে পারি। মনের ভেতর দুশ্চিন্তার জোয়ার বয়ে গেলেও, চেহারা দেখে মনে হয় যেন কিছুই হয়নি।
এই অতি আজব একটা গুণ আজ আমাকে বিশাল এক বিপদের মুখোমুখি হবার থেকে রক্ষা করল। পুলিশ আমাকে বহু প্রশ্ন করল। তার মধ্যে অধিকাংশ প্রশ্ন ছিল আমার সাথে থাকা ব্যাগটি কেন্দ্র করে। কিন্তু এতো প্রশ্ন করার সত্ত্বেও কেউ একবারও ব্যাগটি খুলে দেখল না। কিন্তু তাদের কোনো প্রশ্ন ব্যাগের ভেতরের মালামাল নিয়ে ছিলও না। তাদের প্রশ্ন ছিল মূলত; আমার নাম, কোথা থেকে এসেছি, আমার জেলা, আমার বয়স, এই ব্যাগটার জন্য কেন এমন করছিলাম, ব্যাগটা কোনোখান থেকে চুরি করা কি না, ভ্রমণের জন্য ব্যবহৃত ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলাম এবং ব্যাগটার প্রকৃত মালিক কে। এতগুলো প্রশ্নের মাঝে একবারও ব্যাগের ভেতরের সামগ্রীর ব্যাপারে জিজ্ঞাস না করা বেশ অবাক করার বিষয় ছিল। কিন্তু আমার চেহারার মধ্যে কোনো ধরনের ভয় না দেখার ফলে, তারা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল, আমি তাদের মিথ্যে কিছু বলিনি। হতে পারে এ কারণেই তারা চেয়েও সেই প্রশ্ন করেনি।
এখন শুধু হাতে হাত রেখে, বসে থেকে, আশা করতে হবে যে মেয়েটা যাতে সবকিছু ঠিকমতো করতে পারে। সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হলে আজ রাত অযথা আরো দুজনকে মরতে হবে না। এখন শুধু আশাই করতে পারি। আশা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
আমি এসব নিয়ে ভাবছি, এমন সময়ে মেয়েটি ফিরে এলো। এসে আমাকে বলছিল, "আমি তাদের সঙ্গে কিছুটা খাতির জমিয়েছি। তারা আমার গান শুনতেও রাজি। পানি খাওয়ার বাহানা করে আপনাকে এটা জানাতে এসেছি।"
আমি মুচকি হেসে বললাম, "দারুণ! এখন শুধু এই লাশগুলো ফেলে নেই, তাহলেই শান্তি।"
"জি। আপনি লাশগুলো নিয়ে যাওয়ার পথে কোনো শব্দ যেন না করে বসেন, তা মাথায় থাকে।"
"আমি যত আস্তে সম্ভব, তত আস্তেই নিয়ে যাবো। আমার উপর বিশ্বাস করুন।"
"আপনার উপর বিশ্বাস করা ছাড়া অন্য কোনো রাস্তাও নেই আমার কাছে। আশা করছি, নিরাশ করবেন না।"
"জি। আমি আমার দিক থেকে পুরোপুরি চেষ্টা করবো।"
"ঠিক আছে। সাবধানে থাকবেন।" বলেই মেয়েটি আবার সেই দুজন অন্ধলোকের কাছে গান শোনাতে ফিরে গেল। মেয়েটা বলছিল, তাকে নিরাশ না করতে। কিন্তু মেয়েটি কি আদৌ জানে, নিরাশা নামক অনুভূতির জন্ম কোথা থেকে?
দুনিয়ার সকল নিরাশা এসে থাকে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর উপর মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে আশা রাখার ফলে। আমরা যখন কারো উপর এতটাই আস্থা রেখে ফেলি যে তারা সেটার জন্য প্রস্তুত কি না তাও ভেবে দেখি না, ঠিক তখনই নিরাশা নামক বোঝা, আকাশ থেকে আমাদের অসংখ্য আশার উপর পড়ে, সকল আশা ভেঙে চুরমার করে ফেলে। আশা হলো খুবই ভঙ্গুর একটা জিনিস। যত বেশি আশা কোনো কিছুর উপর রাখা হয়, তত বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয় তখন, যখন দেখা যায় সেই আশা কখনওই পূরণ হবে না।
কিন্তু আমি সেই মেয়েটার জীবন নিরাশ করে ফেলার জন্য বাঁচাইনি। তার জীবন বাঁচানোর মানেই হলো তাকে আর তার আশাগুলোকে জীবিত রাখারও দায়িত্ব নেয়া। তাই আজ কোনোভাবেই আমি কোনো ভুল করতে পারবো না। আজ হেরে গেলে জীবনটা পুরোপুরি বৃথা হয়ে যাবে।
এই চিন্তা মাথায় রেখে প্রথমে একটা লাশ বাকি দুটো হতে আলাদা করলাম। এরপর লাশের দুই হাতের কবজি ধরে আস্তে ধীরে, মেঝেতে ঘষতে ঘষতে ট্রেনের পেছনের দিকে নিয়ে যেতে লাগলাম।
নিয়ে যাওয়ার পথে প্রথমবার সেই বৃদ্ধ, অন্ধ লোকদের দিকে চোখ পড়লো। দুজন খুবই মনোযোগ দিয়ে মেয়েটার গান শুনছিল। এত মিষ্টি কন্ঠে কেউ গান শোনালে, আমিও ঠিক সেভাবেই মনোযোগ দিয়ে গান শুনতাম। কিন্তু এই বেচারারা টেরও পাচ্ছে না, তাদেরই সামনে দিয়ে লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই মধুর কন্ঠের ছলে কিছুক্ষণ মগ্ন থেকে আমার দিকে মনোযোগ না দিলেই কাজটা হয়ে যায়।
প্রথম লাশটা সফলভাবে ট্রেনের পেছনের দিকে নিয়ে, ফাঁকা জায়গা দিয়ে ফেলে দিলাম।
দ্বিতীয় লাশটা প্রথমটার তুলনায় বেশ ভারি ছিল। তিনজনের মধ্যে সবচাইতে ভারি দ্বিতীয়টাই ছিল।
তৃতীয় লাশটা প্রথম দুটোর তুলনায় বেশ হালকা ছিল। মৃত লোকটার চেহারা দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাদকাসক্ত ছিল এই লোকটাই। শরীর থেকে অত্যাধিক মাত্রায় মদের গন্ধও আসছিল। আর এই গন্ধের জন্য কিছুটা সন্দেহের শিকার হতে হয়।
ঠিক যখনই এই তৃতীয় লাশটা ট্রেনের পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই দুজন অন্ধ লোকের মধ্যে জিনি পুরুষমানুষ ছিলেন, উনি মদের গন্ধটা পেয়ে, জিজ্ঞাস করে বসলেন, "এই গন্ধটা মদের না? কোথা থেকে আসছে?"
মেয়েটা গান থামিয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমিও সেখানেই থেমে গেলাম।
মেয়েটা ঘাবড়ে বললো, "জানি না, আঙ্কেল।"
লোকটা নাক দিয়ে গন্ধের দিকে আরো কিছুটা মনোযোগ দিচ্ছিল। লোকটা বুঝতে পেরেছিল এখানে কিছু না কিছু হচ্ছে।
"আচ্ছা আশেপাশে কি কেউ মদ খাচ্ছে, দেখো তো?"
"না, আঙ্কেল। আমাদের আশেপাশে কেউ খাচ্ছে না।"
"একটু ঠিকমতো দেখে বলো না, মা।"
"আঙ্কেল হতে পারে পেছনের দিকে কেউ খাচ্ছে। আমি দেখে আসি?"
"হ্যাঁ, দেখে আসো।"
মেয়েটা এই সুযোগ নিয়ে আমার দিকে ইশারা করে বললো, লাশটা এখানেই কিছুক্ষণের জন্য রেখে দিতে।
তার কথামতো লাশটা সেখানেই রেখে, স্থিরভাবে দাড়িয়ে রইলাম।
মেয়েটা পেছনের দিকে দেখতে যাবে, এমন সময়ে বৃদ্ধা মহিলাটা তার স্বামীকে বলে উঠলেন, "একটা মেয়েকে পাঠাচ্ছেন এমন কাজে। তার জন্য তো মোটেও নিরাপদ না।" এরপর মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "মা, তোমার যাওয়ার কোনো দরকার নেই। কেউ মদ খেয়ে থাকলে খাক। এসব মানুষ মোটেও ভাল হয় না। তোমাকে কিছু করে ফেললে তো তোমার জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। যারা মদ খেয়ে, নেশা করে নিজের ক্ষতি করতে পারে, তারা অন্যের ক্ষতি করতে কখনও দ্বিধা বোধ করে না। এদের থেকে যত সম্ভব দূরে থাকাই ভাল।"
মহিলাটি অজান্তেই আমাদের কষ্ট কমিয়ে ফেললেন। আমি সেই মুহূর্তে কথা বলতে পারলে উনাকে ধন্যবাদ জানাতাম। কিন্তু এ সুযোগ আর কপালে নেই।
মেয়েটা বৃদ্ধা মহিলাটির কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। আমিও আবার লাশটার দুহাতের কবজি ধরে প্রস্তুত হয়ে পড়লাম। মেয়েটা তাদেরকে আরেকটা গান শোনাতে শুরু করল, আর তারা আবার নিজের মনোযোগ তাদের দিকে ফেরালেন। এই সুযোগ পাওয়ামাত্র আমি লাশটা আস্তে ধীরে নিয়ে ফেলে দিলাম। তিনটি লাশ সফলভাবে ট্রেন থেকে ফেলার পর এক স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। এমন গভীর রাতের আঁধারে, তিনটি লাশ তিনটি ভিন্ন স্থানে ফেলা হলো।
এরপর আমি আবার আস্তে আস্তে হেঁটে আমার সিটের দিকে ফিরে গেলাম। আর যাওয়ার পথে মেয়েটাকে ইশারার মাধ্যমে এসে পড়তে বললাম। মেয়েটা তাদের কাছে ঘুমের বাহানা করে, চুপচাপ ফিরে এলো। তৎকালীন বিপদ মাথার উপর দিয়ে সরামাত্র মেয়েটা কান্নায় ভেঙে পড়লো। প্রথম দেখায় মনে হচ্ছিল, হতে পারে আজ রাতের এই ঘটনা নিয়েই হয়তো নিজেকে দোষী ভেবে কাঁদছে। কিন্তু জিজ্ঞাস করাতে জানতে পেলাম, কারণটা ছিল পুরোপুরি ভিন্ন।
আমি সবসময়ের মতোই জ্ঞান দেওয়া শুরু করে দিলাম। বলতে লাগলাম, "এগুলো নিয়ে নিজেকে দোষী ভেবে কোনো লাভ নেই। যাদেরকে মেরেছি, তাদের কেউই ভাল কিছু ছিল না। আপনি তাদের মৃত্যুতে অশ্রু বাহাচ্ছেন কেন?"
মেয়েটা কান্না থামিয়ে, আমার দিকে গভীর নজরে তাকিয়ে রইল। আমি তার উত্তরের অপেক্ষায় নীরবতা পালন করছিলাম। সেই নীরবতার মধ্য দিয়েও বিদ্যমান ছিল আন্তরিক কিছু কথোপকথন।
সেই নীরব সংলাপ চলছিল একে অপরের চোখে চোখ রেখে। উভয়ের মধ্যে কারো ঠোঁট নড়ছিল না, কিন্তু কথা সুস্পষ্ট হচ্ছিল।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিলাম, আমার ধারণা ভুল ছিল। কখনও ভাবতেও পারিনি জীবনে এক পর্যায়ে এসে পৌছাবো। এমনই এক পর্যায়, যেখান থেকে ফিরে যাওয়া নিজের জীবনের জন্যই ভাল, কিন্তু সেই জীবন হবে শুধু এক জ্যান্ত লাশের। সেই জীবন হবে লজ্জার। সেই জীবন হবে পুরোপুরি বৃথা।
মেয়েটা অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর, হঠাৎ বলে উঠলো, "আমি এসব ভেবে কাঁদছি না। আমি কাঁদছি অন্যকিছু নিয়ে।"
আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাস, "এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার সত্ত্বেও অন্য এক ঘটনা মনে করে কাঁদছেন! বিষয়টা বেশ সাংঘাতিক কিছু হবে, যা এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেও মন থেকে সরার নাম নেয় না।"
"জি, এমন কিছুই ভেবে নেন।"
"হুম! যদি মনে কিছু না করে থাকেন, তবে আমাকে বলা যাবে?"
"আপনার কাছ থেকে এখন লুকাবার মতো আমার বেশি কিছু নেই। কিন্তু এটা শোনার পর আপনাকে আমার জন্য একটা কাজ করতে হবে।"
অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "জি, কাজ বলতে?"
"বেশি কঠিন কিছু না। পরবর্তী স্টেশনে আমার সঙ্গে নেমে, আমাকে তার কাছে নিয়ে যাবেন যার জন্য ঐ গুন্ডাগুলো কাজ করতো।"
"এসব কি বলছেন আপনি? মাথা ঠিক আছে তো? আমি অনেক কষ্ট করে সেখান থেকে রেহাই পেয়েছি। আমার সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান কাজ হলো এখন বাড়ি ফিরে যাওয়া।"
"আপনি আমার সাহায্য না করলে, আমিও আপনাকে আমার কান্নার কারণ বলবো না।"
একথা শুনে, রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলাম, "আপনার কাহিনি শোনার আগেও যা ছিলাম, তাই থাকবো। আপনার সঙ্গে এমন কি হয়েছে না হয়েছে, এসব জানার আগ্রহের খাতির আমার স্বপ্নগুলো নষ্ট করে ফেলব না। আপনার দুঃখের কাহিনি আপনার কাছেই রাখুন।"
মেয়েটা আমার কথা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শুধু চুপচাপ আমার কথাগুলো শুনেই গেল। দেখে মনে হচ্ছিল, সে কিছুর অপেক্ষায় আছে।
আমি যেমনেই তাকে ঝাড়ি দেওয়ার পর, তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে, আবার তার চোখের দিকে তাকালাম, ঠিক তখনই সে কিছু বলতে নিলো। বলতে নিয়ে প্রথমবার একটু থেমে গেল।
দ্বিতীয়বারের মতো বলে উঠলো, "আমার বড় বোন ঢাকা শহরের একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। মাসখানেক আগেই সে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পরে তাকে মেরে ফেলা হয়। আর তারপর তার মৃতদেহটা পুড়িয়ে ফেলা হয়।"
মেয়েটা কিছুক্ষণ কান্না আটকে রেখে এসব বলার পর, কান্নায় ভেঙে পড়ে আরো বললো, "আমি জানি, আমার জন্য এত কিছু করার পর আপনার কাছে কিছু চাওয়া মোটেও ঠিক না। কিন্তু আমি করবো, বলুন? আমার কাছে আর কোনো রাস্তা নেই। আমি এখন পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়েছি।"
নিজের চোখের পানি মুছতে মুছতে সে আরো বললো, "আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন শুধুমাত্র আমার উপর রহম খেয়ে। কিন্তু এই জীবনটা পুরোপুরি বৃথা হয়ে যাবে, যদি আমি আমার বোনের উপর হওয়া অন্যায়গুলোর প্রতিশোধ না নিতে পারি।" অতঃপর আমার সামনে হাত জোর করে সাহায্যের ভিক্ষা চাইতে লাগল।
আমি সেই রাত সবকিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু এ কি শুনে বসলাম! মেয়েটার বেদনাদায়ক কন্ঠে এমন দুর্দান্ত এক সংবাদ শুনে ফেটে যাচ্ছিল। কোন ধরনের জানোয়ার হতে হয় এমন এক অপরাধ করার জন্য! আর কতো বড় এক জানোয়ারের পরিচয় আমি দিব, যদি আমি এই মেয়েকে এমন সময়ে মানা করে দেই?
এগুলো প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক করছিল। চোখ থেকে অশ্রুগুলো ঝড়ে পড়বার জন্য মাত্তম করছিল করে চিৎকার করছিল। কিন্তু মাথায় চির বিরাজমান ছিল সেই ব্যাগ ভরা টাকা পৌঁছানোর কথা।
মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। মুখ থেকে যা বের হবে, তা শুধু আমার একার ভবিষ্যতের উপর প্রভাব ফেলবে না। তার প্রভাব আরো অসংখ্য মানুষের উপর পড়বে। তাই কিছু না বলে, কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত নেবার জন্য ওতটা ভাবতে হয়নি। এ নীরবতার মধ্যেই যাতে সকল সমস্যার সমাধান কোনো চমৎকারের দ্বারা আমাদের মাঝে পৌঁছে যাক। এ আশা নিয়েই নীরবতা পালন করছিলাম।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর, মুখ খোলার সাহস পেলাম।
সাহস করে বললাম, "আমি আপনার এই শেষ একটা সাহায্য করতে রাজি আছি। কিন্তু আমি আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাবো না।"
মেয়েটা আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলো, "মানে? তাহলে কীভাবে সাহায্য করবেন?"
"আমি উনার সম্বন্ধে যা কিছু জানি, তা সবই আপনাকে বলতে রাজি আছি। কিন্তু তা আমি বলবো একটি শর্তে।"
"জি, কেমন শর্ত?"
"আপনি কোনোভাবেই আমার কোনো ধরনের পরিচয় দিতে পারবেন না। আমাকে কথা দিন, তাহলে আমি সব বলতে রাজি আছি।"
"জি, আমি রাজি। কিন্তু অন্তত আমাকে ঢাকা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসেন।"
"তা করতে পারবো। কিন্তু আমার জন্য সাক্ষাতের পূর্বেও তো আপনি একা ছিলেন। হঠাৎ আমাকে সাথে রাখার প্রয়োজন অনুভব করছেন কেন?"
মেয়েটা মেঝের দিকে তাকিয়ে, কান্নায় ভেঙে পড়ে, আমাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরল। তার কোমল দুটো হাত আমার চিকন কাঁধের ওপর, তার কপাল আমার বুকের উপর, আর তার সমস্ত দেহের ভার আমার ওপর। জীবনে প্রথমবার কোনো পরনারীর শরীরের সঙ্গে এভাবে, এতো নিকটে এসেছি। জীবনে প্রথমবার কোনো মেয়ের সঙ্গে এভাবে গা ঘেষে দাড়িয়ে ছিলাম। অনুভূতিটা আসলেই অসাধারণ। এক নারীর স্পর্শ পাওয়ার অনুভূতি আমার কাছে নতুন ছিল, কিন্তু এর দ্বারা আমার মন যেই তৃপ্তি পেয়েছে, তার জন্য যেন সে চিরকাল ধরে অপেক্ষায় ছিল। এ স্পর্শে ছিল না কোনো নোংরামি, ছিল না কোনো অসৎ উদ্দেশ্য, ছিল না কোনো খারাপ নিয়ত। সেখানে বিদ্যমান ছিল শুধু নির্ভরতা। একজন অসহায় নারীর একজন বীরত্বপূর্ণ পুরুষের উপর। তার শরীর প্রতিটি অঙ্গ আমার কাছে সাহায্য চাচ্ছিল। তার গায়ের সুবাসিনী সুগন্ধি এবার আমার জামার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। কি সুন্দর এক মুহূর্ত ছিল! কি সুন্দর তার গায়ের সুবাস! কি সুন্দর সেই অল্প কিছু শব্দ! সেই শব্দ, যা আমাদের উভয়ের কারো ঠোঁট দিয়েও বের হয়নি। শরীরের সঙ্গে শরীর শুধু স্পর্শেই রয়েছিল। কিন্তু কথপোকথন চলছিল দু হৃদয়ের মাঝে।
এ কথপোকথন সবার জন্য নয়। এ কথপোকথন সবার ভাগ্যে নয়। যার ভাগ্যে একবার জুটে পড়ে, সে উজ্জীবিত হয়ে উঠে পড়ে। আর যার ভাগ্যে এ কথপোকথন জীবনে একবারও জুটে না, সে যে কি মাপের দুর্ভাগা, সে তা নিজেও বোঝে না। এভাবেই দুজন মিশে যাচ্ছিলাম একে অপরের ওপর নির্ভরশীল ভাবনা দেখে। ভোর কখন, কিভাবে হলো, কেউ টের পাইনি কারণ আবেগে ছিলাম মেতে।
আমাকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা কখন ঘুমিয়ে পড়ল, তা হয়ত সে নিজেও বুঝতে পারেনি। ভোরবেলা সূর্যের কিরণ পড়তেই না পড়তে, মেয়েটা চমকে উঠলো। উঠে দেখল; আমি তাকে, নিজের বুকের উপর ভারপ্রাপ্ত অবস্থায় রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি এর চেয়ে শান্তির ঘুম আমার সারাটা জীবনে কখনও অনুভব করিনি। মেয়েটা ঘুম থেকে উঠে, খুবই নম্রভাবে আমার শরীরের উপর থেকে উঠে দাঁড়াল। উঠে খেয়াল করলো; তাকে শরীরের উপর রেখে এতক্ষণ এভাবে ঘুমিয়ে থাকার কারণে আমার হাত এবং পা খুবই বেকায়দা অবস্থায় ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। ব্যপারটা লক্ষ করে, সে আমার হাত এবং পা যত্নসহকারে, সিটের উপর তুলে রাখল। আমার হাত উঠিয়ে রাখাতে, আমি ঘুমের মধ্যে দিক পরিবর্তন করতে গিয়ে, পড়ে যেতে নিয়েছিলাম। মেয়েটা দ্রুত আমার সমস্ত শরীরের ভার, নিজের দুটো হাত দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছিল। আমার উঠতে আরো এক ঘণ্টা বাকি ছিল। সেই একটা ঘণ্টা সে আমার সমস্ত শরীরের ভার সহ্য করছিল, যাতে আমি মেঝেতে পড়ে ব্যথা না পেয়ে যাই। ট্রেনের সকল যাত্রী নামা শুরু করল। অনেকে তাকে এই অবস্থায় দেখে গেল। যাত্রীদের আওয়াজ এবং কুলিদের ডাক শুনে আমার ঘুম ভাঙল।
আমি চোখ খোলামাত্র দেখি এই অবস্থা। এই দৃশ্য দেখে এতটাই অবাক হয়ে পড়েছিলাম, যে কি বলা উচিত, তা বুঝে পাচ্ছিলাম না।
ভাগ্যবশত আমার কিছুই বলতে হয়নি। আমার ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই সে খেয়াল করল। যত্নসহকারে নিজের হাত সরিয়ে নিল। আমি গভীরভাবে তার দুচোখে ডুবে ছিলাম, তাই তখন নিজে নিজেই উঠে পড়ার মতো খেয়ালও ছিল না।
দুজনেই মানসিকভাবে অসহায়। দুজনেই শারীরিকভাবে ভেঙে পড়া। সারারাত শুধু কেঁদে, ভেবে এবং অপরাধে যাপন করা দুই যাত্রী।
এসব ভাবার মাঝখানে সে মেঝেতে উঠে দাড়িয়ে, বলে উঠলো, "চলুন নেমে পড়ি। নেমে আবার পরের ট্রেন ধরে ঢাকার দিকে রওনা দিব।"
"জি, অবশ্যই।" আমি বললাম, চোখ ডলন করতে করতে।
"আপনি কাপড় পালটে নেন। আমি সামনের দিক থেকে হয়ে আসি।" বলেই মেয়েটা চোখ নিচু করে, ট্রেনের সামনের দিকে হাঁটতে লাগল।
আমি মাঝপথে ডেকে উঠলাম, "জি, শুনেন!"
মেয়েটা মাঝপথে থেমে, ঘুরে তাকিয়ে বললো, "জি, বলেন।"
লজ্জিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "আপনি কতক্ষণ ধরে আমার শরীরটা এভাবে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন?"
মেয়েটা মুচকি হেসে জিজ্ঞাস করলো, "কেন? প্রতিশোধ করার ইচ্ছে আছে নাকি?"
আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, "জি, বুঝতে পারলাম না।"
"কিছু না। আপনি যতক্ষণ আমার শরীরের ওজন সহ্য করে রেখেছিলেন, তার তুলনায় আমি কিছুই করতে পারিনি। এগুলো নিয়ে বেশি ভেবে লাভ নেই। তাড়াতাড়ি কাপড় পালটে নিন। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেন আবার ছাড়বে।"
ঠিক তখনই আমার মনে পড়ল, ট্রেন তো এতক্ষণ থেমে থাকার কথা না। তাই জিজ্ঞাস করে উঠলাম, "আচ্ছা, ট্রেনটা এতক্ষণ ধরে দাড়িয়ে থাকার কারণ কি? সাধারণত তো অল্প সময়ের মধ্যেই ছেড়ে দেয়।"
"ট্রেন থামানোর পর এক যাত্রী দেখে, কন্ডাক্টর মাটিতে বেহুঁশ পড়ে আছে। তাকে ওঠানোর পরে জানা গেল, কয়েকজন মিলে, তাকে বেহুঁশ করার ওষুধের মাধ্যমে বেহুঁশ করে, সেখানেই ফেলে যায়। তাই পুলিশ ডেকেছে তদন্তের জন্য।"
"আচ্ছা! এখন বুঝতে পেরেছি।"
"জি।"
"কারো তল্লাশি নিচ্ছে না তো?"
"না। শুধু সবাইকে ডেকে ডেকে একবার চেহারা দেখিয়ে যেতে বলছে কন্ডাক্টরের কাছে। যদিও তল্লাশি করাটা আরো ভাল হতো। এভাবে হঠাৎ করে সকল যাত্রীকে হয়রানিতে ফালানোতে তাদেরই দুর্নাম ছড়াবে বলে এভাবে চেহারা দেখিয়ে চেনার চেষ্টা করছে।"
"যাক! আমাদের জন্য সুবিধা হলো।"
"হ্যাঁ। ওঃ, ভাল কথা মনে পড়ল। আপনি চাকুটা কি করলেন?"
"সেটা! তা তো প্রথম লাশের সাথেই ফেলে দিয়েছিলাম।"
"প্রথমটার সাথেই! কিন্তু আপনি না কোনো ত্রুটি হলেই তা ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন? তাহলে প্রথমটার সঙ্গে ফেলে দিলেন কেন? ফেলা তো উচিত ছিল সবকিছুর শেষে ফেলা।"
মুচকি হেসে বললাম, "তা আমি জানি। কিন্তু আপনার উপর আমার পুরা ভরসা ছিল। তাই আমি প্রথমবারেই তা ফেলে দিলাম। কারণ আমার বিশ্বাস ছিল, আপনি এটা করে দেখাতে পারবেন।"
আমার উত্তরটা শুনে মেয়েটা কিছুক্ষণ লজ্জার চোখ নিয়ে, এক আনন্দের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। মুখে এক মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছিল তার। এই মিষ্টি হাসির মুখে, মিষ্টি কন্ঠে বলে উঠলো, "ধন্যবাদ। আমার উপর আস্থা রাখার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।" বলে চোখ দুটো নামিয়ে আরো বললো, "এবার তাড়াতাড়ি কাপড় পালটে নিন। আমি আমার চেহারা দেখিয়ে আসি।" বলে আবার ট্রেনের সামনের দিকে হাঁটতে লাগল।
আমি কিছুক্ষণ বসে ভাবলাম, এসবের পরিণতি কি হতে পারে। আদতে কি আমি আমার লক্ষগুলো পূরণ করতে পারবো? আমি যেগুলোকে লক্ষ বলে প্রাধান্য দেই, সেগুলো কি আদৌ আমার জীবিত থাকার মূল উদ্দেশ্য?
এসব ভাবার ওত সময় ছিল না বলে ঝটপট কাপড় পালটে নিলাম। ভাল করে আশেপাশে দেখে নিলাম, কেউ আছে কি না। যখন নিশ্চিত হলাম কেউই দেখছে না, তখন ব্যাগটার ভেতরে খুলে দেখলাম, সব টাকা ঠিকঠাক জায়গামতো আছে কি না। যখন নিশ্চিত হলাম, কিছু এদিকসেদিক হয়নি, তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। অতঃপর মেয়েটা ফেরত এলো। এসে বললো, "আমারটা হয়ে গিয়েছে। এবার আপনিও গিয়ে নিজের চেহারা দেখিয়ে আসেন।"
"জি।" বলেই উঠে, ট্রেনের সামনের দিকে গিয়ে, কন্ডাক্টরকে নিজের চেহারা দেখিয়ে আসলাম। আমি জানতাম, এ কাজটা কোনো মহিলা করেনি। সেও জানত, কিন্তু তাও মেয়েটাকেও শুধু শুধু চেহারা দেখাতে ডাকলো। বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার! কিন্তু আমি সেখানে এই প্রসঙ্গে কোনো প্রশ্নও করিনি। নাহলে আমার উপরও এরা সন্দেহ করে বসতে পারতো। জীবনে চুপ থাকাটা কতো কাজে লাগতে পারে, তা প্রাথমিকভাবে শিখতে পারছিলাম।
আমরা সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে, ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। নামার সঙ্গে সঙ্গে একগাদা কুলি আমাদের সামনে এসে, আমার মালপত্র কাঁধে তোলার জন্য তর্কাতর্কি শুরু করে দিল। আমাদের কাছে যে মালপত্র ছিল, তা ভারি না, এমন কোনো কথা না। কিন্তু ব্যাগের ভেতর আঠারো কোটি টাকা থাকার কারণে, একটা কুলি নেওয়াতে দ্বিধা বোধ করছিলাম। মেয়েটা এর সম্বন্ধে না জানার ফলে, কুলি নেওয়ার জন্য জোড় করছিল। কয়েকবার তো এমনও বললো যে কুলির ভাড়া সেই দিবে। সে মনে করছিল, হয়তো টাকার অভাবে এমন করছিলাম। নাহলে মনে করছিল, আমাকে দ্বারা এতো কাজ করানো ঠিক হবে না। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে তাকে কিছু বলতেও পারছিলাম না। তাই সবার হাত সরিয়ে, একাই একাই হাঁটতে লাগলাম। আমার এ আচরণ দেখে মেয়েটা মনে কষ্ট পেয়েছিল, এটা তার চেহারায় স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছিল।
আমি তবুও থামিনি। থামতে পারিনি। শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে হেঁটেই গেলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর স্টেশন থেকে একটু দূরে এসে পড়লাম। মেয়েটা ঠিক আমার পিছনে পিছনে হেঁটে চলে আসছিল। আমি রাস্তা পার করে একটি পুরাতন কারখানার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কারখানার গেটের সামনে ব্যাগটা রেখে একটু আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম খাওয়ার জন্য ভাল কোনো হোটেল আছে কি না। অতঃপর মেয়েটা এসে আমাকে জিজ্ঞাস করলো, "আমাকে এভাবে রেখে চলে এলেন কেন?"
আমি কিছুটা অবাক হবার ভাণ করে বললাম, "আমি কোথায় আপনাকে রেখে আসলাম? আপনি তো ঠিকই আমার সাথে এখান পর্যন্ত এসে পড়লেন।"
মেয়েটা আমার কথায় মোটেও সন্তুষ্ট ছিল না। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল বড়ই নিরাশ আমার উপর। আমার চেহারাও দেখতে ইচ্ছা নেই বলে; হাত দুটোর বাহু ক্রস করে, মুখ সরিয়ে, পাশের দিকে তাকিয়ে ছিল।
আমি কিছু বললে হয়তো আরো রেগে যাবে। আমি চাই এই ব্যাগে লুকোনো রহস্য যাতে রহস্য-ই রয়ে যাক। কিন্তু তার পাশাপাশি এই মেয়েটার মনে কষ্ট দিতেও ভাল লাগছে না। মন তো মনের কাছ থেকে আশা রাখে। টাকাপয়সা তো বস্তুত প্রয়োজন। মনের কাছে সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো অন্য কারো মনের ভেতর জায়গা দখল করে আধিপত্য বিস্তার করা। সে ভাল করে জানে, এতে কোনো লাভ নেই। এতে অনুভূতি ছাড়া আর কিছুই নেই। কারো সম্পত্তি দখল করে আধিপত্য বিস্তার করলে তো তা সবার কাছে স্পষ্ট দেখা দেয়। তার প্রমাণ সরাসরি দেয়া যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে মনের ব্যাপারটা বেশ ভিন্ন। মনের আধিপত্য প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই। কার মনের মধ্যে কে কতটা স্থান দখল করতে পেরেছে, তা দেখার কোনো উপায় নেই। এমন তথ্য জানারও কোনো উপায় নেই। শুধু অনুভূতির দ্বারা এর অনুসন্ধান পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে এটা কিছুই না। এমন কিছুই না যা আমার বাঁচার জন্য অনস্বীকার্য। কিন্তু মনমতো বেঁচে থাকতে হলে এর প্রয়োজন রয়েছে। আর যদি আমি আমার মনের চাহিদাসমূহ একেবারেই অস্বীকার করে দেই, তবেই আমি নিজের মনুষ্যত্ব পুরোপুরি হারিয়ে ফেলব। হারিয়ে ফেলব সেই চেতনা, যা আমার বেঁচে থাকতে অনুপ্রাণিত করে থাকে। তাই তো পৃথিবীর ইতিহাসে বহু কিংবদন্তি রয়েছেন যারা শুধু এই উপাধি পেয়েছিলেন একটিমাত্র কারণে। সেই কারণটি ছিল, পৃথিবীর বাকি মানুষের মতো নিজের চেতনার হত্যা না করে, নিজের মনের মধ্যে বিদ্যমান আগুন জ্বালিয়ে সকলের সামনে প্রদর্শন করা। ইতিহাস তাদের স্মরণ করে কারণ তারা বাকিদের মধ্যে বিদ্যমান নেতিবাচক চেতনাকে বর্জন করেছেন। ইতিহাস তাদের স্মরণ করে কারণ তারা নিজের জীবনের প্রকৃত লক্ষ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারা নিজের মনের কথা শুনেছিলেন। বস্তুত প্রয়োজন নিয়ে চিন্তাভাবনা বর্জন করেছিলেন। তারা শক্ত এবং মজবুত মানসিকতার অধিকারী ছিলেন। সকলের পক্ষে তা সম্ভব না। আমি নিজেও তাদেরই একজন।
এত কিছু ভাবতে ভাবতে পেট সাড়া দিল। ক্ষিদে বাড়ছে। পেটের গর্জন শুনে মেয়েটাকে বললাম, "আপনি রাগ করেন আর যা-ই করেন, অন্তত সকালের নাস্তা করে নেন।"
মেয়েটা আমার কথায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে, ঠিক আগের মতো অবস্থায় মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিল। বুঝতে পেলাম, এভাবে করে কোনো কাজ হবে না। মেয়েটাকে কোনোভাবে রাজি করাতে হবে। তাকে রাজি করাতে আমি কিছু বলতে নিবো, এমতাবস্থায় কারখানার ভেতর থেকে জোরে এক শব্দ এলো। শব্দটা শুনে কানের মধ্যে গুঞ্জন হচ্ছিল। শব্দটা ছিল একটি বিস্ফরনের। তার কিছুক্ষণ পরই পুরো জায়গাটা পুলিশ দিয়ে ভরে গেল। চারিদিক থেকে পুলিশ এসে কারখানা ঘেরাও করে নিল। তাদের মধ্যে একজন পুলিশ অফিসার আমাদের তাড়াতাড়ি এখান থেকে দূরে কোথাও যেতে। একথা শুনে মেয়েটা আমার হাত ধরে রাস্তার বিপরীত দিকে দৌড় দিল। আমার কানে তখনও গুঞ্জন হচ্ছিল বিধায় আমি পরিস্থিতি ঠিকমতো বুঝতে পারছিলাম না। তাই মেয়েটার সঙ্গে সঙ্গে আমিও দ্রুত রাস্তার বিপরীত দিকে দৌড় দিলাম। কিন্তু ব্যাগটা সেখানেই রয়ে গিয়েছিল। ব্যাগটা সাথে নিয়ে দৌড় দেওয়ার কথা আমার খেয়ালে না থাকায় ব্যাগটা সেখানেই রেখে দৌড় দিয়েছিলাম। ব্যাগের কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি মেয়েটার হাত ছাড়িয়ে, আবার কারখানার দিকে দৌড় দিলাম। পুলিশেরা আমাকে যেতে দিচ্ছিল না, তবুও আমি ব্যাগ পর্যন্ত যাওয়ার অনেক চেষ্টা করছিলাম। এমতাবস্থায় আরেকটি বিস্ফরনের শব্দ এলো। এবারেরটি আগেরটির চেয়ে বড় ছিল। আমার কানে আবার গুঞ্জন হতে শুরু করল। এবারের গুঞ্জন ছিল তীব্র মাত্রার। আমি এই অবস্থায় কানে হাতে রেখে, মাটিতে পড়ে গেলাম। তখনই দেখি কারখানার ভেতর থেকে কয়জন বেড়িয়ে আসছে। প্রায় সাত থেকে আটজন, হাতে বন্দুক নিয়ে এবং মুখে কাপড় পেঁচিয়ে। তাদের সবারই পরিধানে ছিল হলুদ ফোঁটাযুক্ত কমলা রঙের কাপড়। মুখে পেঁচানো কাপড়ও একই রকম ছিল। তাদের হাতে থাকা বন্দুক দিয়ে পুলিশের দিকে গুলি করতে লাগল। তাদের মাঝে একজন ছিল খুবই লম্বা। সেই লম্বা সন্ত্রাসীটা ধীরে ধীরে আগে বাড়তে লাগল। ঠিক তখনই আমার সামনের পুলিশ অফিসার তার গলায় গুলি করে বসে।
দৃশ্যটা দেখে মনে হচ্ছিল, আমি একটি যুদ্ধের মাঝে আছি। বুকটা থরথর করে কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল, শেষমেশ এই সন্ত্রাসীদের গুলি খেয়েই বোধহয় মরতে হবে।
সেসময় আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার মনের মধ্যে আলাদা করে যুদ্ধ লেগেছিল আমার লোভ এবং নিজের জীবনের প্রতি ভালবাসার মধ্যে। আমার লোভী প্রকৃতি আমাকে দুঃসাহসের সঙ্গে, সেই ব্যাগ নেওয়ার জন্য চেষ্টা করতে বলছিল। আমাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল আমার দারিদ্রতার দোহাই দিয়ে।
অপরদিকে আমার বুকের সব পানি শুকিয়ে গিয়েছিল। জীবনের প্রতি মায়ায় কিছুই করতে পারছিলাম না। শরীরটা সেখানে শক্ত হয়ে পড়েছিল। চারিদিকে গুলির আওয়াজ। আমার পাশের একজন পুলিশ অফিসারের পায়ের হাঁটুর মধ্যে গুলি লেগেছিল। তখন মনের ভেতর আরো আতঙ্ক ঢুকে পড়ল। আমার পাশের জনের লাগতে পারলে আমার লাগতে আর কতক্ষণ? লোভে এসে যেভাবে বিপদের মাঝে ঝাঁপ দিয়ে বসলাম, তা কি আদৌ ঠিক হয়েছে আমার? আমি কি আমার সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে, নিজের জীবনটাই বিসর্জন করতে নিচ্ছি?
বড়ই কঠিন প্রশ্ন এগুলো। এগুলোর উত্তর খুঁজে বের করার মতো সময়টুকু পাবো কি না, বুঝতে পারছিলাম না। দেখতেই দেখতে আমাকে একটু আগে যে পুলিশ অফিসার সরতে বলেছিলেন, উনি নিজেই একটা গুলি খেয়ে আহত হলেন। গুলিটি লেগেছিল তার ডান হাতের বাহুতে। আমি তার ডান পাশেই অবস্থানরত ছিলাম। অর্থাৎ গুলি শুধু তার বুহুতে লাগেনি, গুলিটি আমার একদম কাছে দিয়ে গেল। তখন মনে হচ্ছিল, মৃত্যু আরো কাছে এসে পড়ল। বেঁচে থাকার সকল আশা বর্জন করে, চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম।
মৃত্যুর অপেক্ষায় মাটিতে নিরীহ অবস্থায় পড়ে ছিলাম। ঠিক তখনই পিছন থেকে জোরে এক মহিমান্বিত কন্ঠের অধিকারী একজনের ডাক শুনতে পেলাম। এমন বীরপুরুষের মতো পৌরুষপূর্ণ কন্ঠ বিশিষ্ট লোকটা চিল্লিয়ে বললো, "সবাই ডিফেন্সের জন্য প্রস্তুত হও।"
এমন কন্ঠে একথা শুনে আমি চোখ না খুলে থাকতে পারলাম না।
চোখ আস্তে করে খুলে দেখি প্রায় ছয় ফুট লম্বা, সম্পূর্ণ কালো পোশাক পড়া একজন লোক, হাতে বৃহৎ আকৃতির একটি বন্দুকের মতো অস্ত্র নিয়ে কারখানার দিকে আগে বাড়ছিল। লোকটার বন্দুকের মতো অস্ত্রের মুখখানা ছিল পিভিসি পাইপের মতো চওড়া।
আমার পাশের পুলিশ অফিসার আমাকে কাছে টেনে নিজের ঢালের পেছনে নিয়ে নিল। বুঝতে পেলাম, আসল খেলা এবার শুরু হবে।
লোকটা বাকি পুলিশ অফিসারদের চাইতে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে আগে গিয়ে দাঁড়ালেন। কারখানার সামনে অবস্থানরত সন্ত্রাসীরা এ দৃশ্য দেখে, সবাই সমান লাইন করে দাঁড়িয়ে নিজেদের বন্দুকের ম্যাগাজিন পরিবর্তন করতে লাগল। বোধহয় এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন এই কালো পোশাকে অস্ত্রধারী লোকটি। দেখে মনে হচ্ছিল, লোকটি খুব সম্ভবত এই পুলিশ অফিসারদের সিনিয়র অফিসার। সেই সিনিয়র অফিসারটি নিজের বৃহৎ আকৃতির সেই অস্ত্র দ্বারা তাদের মাঝে একটি ছোট আকৃতির বোমা নিক্ষেপ করলেন। বোমাটি কিছুটা কারখানা এবং সেই সন্ত্রাসীদের মাঝামাঝি স্থানে গিয়ে পড়ল। বোমাটির বিস্ফারনের ফলে তারা আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তারপর সেই সিনিয়র অফিসার আরেকটি অস্ত্র এনে তা দ্বারা সন্ত্রাসীদের প্রত্যেকের উপর ব্যাটারির মতো দেখতে কিছু নিক্ষেপ করলেন। সেই ব্যাটারির মতো দেখতে অস্ত্রটি তাদের দেহে স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে তারা এক বৈদ্যুতিক ঝটকা খেয়ে, কিছুক্ষণ ছটফট করে বেহুঁশ হয়ে পড়ল। মনে হচ্ছিল অবশেষে যুদ্ধ শেষ হলো, কিন্তু সেটা ছিল আমার জ্ঞানের স্বল্পতা।
আমি উঠতে নিতে নিলে আমার পাশের পুলিশ অফিসার, আমার হাত ধরে টান দিয়ে বললেন, "চুপচাপ বসে থাকো। স্যার এখনও ওঠার নির্দেশ দেননি।"
আমি মনোযোগ সহিত উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখছিলাম; উনি নিজের হাতের কব্জিতে অবস্থিত একটি হাতঘড়ির মতো যন্ত্রে কিছু দেখছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল উনি কিছু খোঁজার দৃঢ় চেষ্টা করছেন। হঠাৎ করে উনার মুখে একটি মুচকি হাসি ফোটে উঠল। যা খোঁজার চেষ্টা করছিলেন, তা পেয়ে যাওয়ার লক্ষণ বোধহয়।
ওনার হাতের সেই যন্ত্রে দুবার স্পর্শ করে, কারখানার উপরের দিকে তাকালেন। এই দৃশ্য দেখে আমিও ঠিক সেই দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখে চাপ প্রয়োগ করে দেখতে পেলাম আর্মিদের পোশাকের মতো রঙের ছোট একটি উড়ন্ত যন্ত্র। সেই যন্ত্রের দ্বারা কারখানার ছাদের এক স্থান থেকে, কারখানার ভেতর বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। তখন বুঝতে পেলাম, কিছুক্ষণ আগে ওখান দিয়েই বিস্ফারনের শব্দ আসছিল।
এরপর সিনিয়র অফিসার নিজের ডান হাত দ্বারা ইশারার মাধ্যমে কারখানার বিল্ডিং ঘেরাও করে ফেলতে বললেন। ওনার ইশারা দেখে বাকি পুলিশ অফিসাররা ধীরে ধীরে কারখানার দিকে এগোতে লাগল। আমার পাশের পুলিশ অফিসার আমার সঙ্গে জায়গামতো অবস্থানরত ছিলেন। দৃশ্যটা দেখে আমার বুকের থরথর আরো বাড়তে লাগল। কিন্তু গোলাগুলি স্থগিত হওয়ার কারণে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করছিলাম।
কারখানার বিল্ডিং পুরোপুরি ঘেরাও হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সিনিয়র অফিসার তাদের পিছনে পিছনে এগোতে শুরু করলেন।
কারখানার ভেতর থেকে আরো একজন চিৎকার করতে করতে বেড়িয়ে এলো, "কেউ আগে বাড়বি না। আমার দেহে বম লাগানো। কাছে আসলে সবাইকে একসঙ্গে উড়িয়ে দিব।"
তখন সিনিয়র অফিসার ওনার সেই অস্ত্র দ্বারা তাকে সেই ব্যাটারির মতো দেখতে বস্তু মেরে বেহুঁশ করে ফেললেন। এখানে মজার ব্যাপার হলো, উনি নিশানা লাগিয়েছিলেন তার দেহে লাগানো সেই বমের উপর। কিন্তু বোমাটা মোটেও বিস্ফারিত হয়নি। তা দেখে আমি বেশ অবাক হলাম। এর মানে, সেই সন্ত্রাসীটা মিথ্যে বলছিল!
সিনিয়র অফিসার এবার ইশারার মাধ্যমে সবাইকে স্বাভাবিক হবার নির্দেশ দিলেন। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। পুলিশ অফিসাররা একেক করে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে পুলিশের জিপে ঢোকানো শুরু করতে লাগল। আমার পাশের পুলিশ অফিসার আহত হবার ফলে তাকে আরো দুইজন পুলিশ অফিসার ধরে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেল। কিন্তু যাওয়ার আগে সেই অফিসারটা আমাকে ধরে রাখতে বলে গেল। এক বিপদ কাটতে না কাটতেই এসে পড়ল আরেক বিপদ। কপালটাই খারাপ আমার।
আমি অতি মাত্রার চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিন্তু এখানে মজার ব্যাপারটা হলো গিয়ে, আমি ছোট থেকেই এমন সব অবস্থাগুলোতে খুবই শান্ত থাকতে পারি। মনের ভেতর দুশ্চিন্তার জোয়ার বয়ে গেলেও, চেহারা দেখে মনে হয় যেন কিছুই হয়নি।
এই অতি আজব একটা গুণ আজ আমাকে বিশাল এক বিপদের মুখোমুখি হবার থেকে রক্ষা করল। পুলিশ আমাকে বহু প্রশ্ন করল। তার মধ্যে অধিকাংশ প্রশ্ন ছিল আমার সাথে থাকা ব্যাগটি কেন্দ্র করে। কিন্তু এতো প্রশ্ন করার সত্ত্বেও কেউ একবারও ব্যাগটি খুলে দেখল না। কিন্তু তাদের কোনো প্রশ্ন ব্যাগের ভেতরের মালামাল নিয়ে ছিলও না। তাদের প্রশ্ন ছিল মূলত; আমার নাম, কোথা থেকে এসেছি, আমার জেলা, আমার বয়স, এই ব্যাগটার জন্য কেন এমন করছিলাম, ব্যাগটা কোনোখান থেকে চুরি করা কি না, ভ্রমণের জন্য ব্যবহৃত ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলাম এবং ব্যাগটার প্রকৃত মালিক কে। এতগুলো প্রশ্নের মাঝে একবারও ব্যাগের ভেতরের সামগ্রীর ব্যাপারে জিজ্ঞাস না করা বেশ অবাক করার বিষয় ছিল। কিন্তু আমার চেহারার মধ্যে কোনো ধরনের ভয় না দেখার ফলে, তারা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল, আমি তাদের মিথ্যে কিছু বলিনি। হতে পারে এ কারণেই তারা চেয়েও সেই প্রশ্ন করেনি।
Comments
Post a Comment