কেদারায় ভ্রমণ (মানসিক) - ২.১

এমনই সময় হঠাৎ করে ম্যাডামের ব্যাগের ভিতর থেকে ফোনের এলার্মের শব্দ বেজে উঠল। উনি ফোনটা বেড় করে এলার্মটা বন্ধ করে, ব্যাগে আবার রেখে, উঠে দাড়িয়ে পড়লেন। এ দৃশ্য দেখে আমি দ্রুত পালাতে নিবো আর এমতাবস্থায় দেখি; অ্যাডভোকেট সাহেব ম্যাডামের বাম হাত নিজ বাম দিয়ে ধরে, নিজের দিকে টেনে আনলেন। এরপর নিজের ডান হাতটা দিয়ে উনার গলা চেপে ধরলেন। গলা চেপে ধরলেন বেশ মজবুতভাবে, তবে কণ্ঠনালীতে কোনো ধরনের জোর প্রয়োগ করছিলেন না। দৃশ্যটা দেখে এক মুহূর্তের জন্য আমার মাথা থেকে পালানোর চিন্তা গায়েব হয়ে গেল। আমি সেই মুহুর্তে একজন বড়মাপের দর্শকের মতো শুধু কৌতূহলের সঙ্গে দেখেই যাচ্ছিলাম। পালিয়ে যাওয়ার ভয় আমার মন ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। এই দৃঢ় কৌতূহলের সঙ্গে দেখলাম; অ্যাডভোকেট সাহেব ম্যাডামের গলা ধরে উনাকে আরো নিজের আরো কাছে টানছিলেন। একেবারে যখন ম্যাডামের ঠোঁটখানা অ্যাডভোকেট সাহেবের ঠোঁটের কাছে এসে পড়ে, তখন উনি থেমে গিয়ে বলেন, "ওঠার পূর্বে অনুমতি প্রার্থনা করা হল এক প্রকারের শিষ্টাচার। তোমার অতি ভদ্র কর্নেল বাপজান তোমাকে এই শিক্ষা দিয়েছেন?"
ম্যাডাম নিজের ডান হাত দিয়ে অ্যাডভোকেট সাহেবের ডান হাতটা নিজের গলা থেকে সরানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু একটা চিৎকারও দেননি। উনার জায়গায় অন্য কোনো মহিলা হলে এতক্ষণে চিৎকার মারতো অন্তত পাঁচ-ছয়বার। কিন্তু উনি এমন অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও একফোঁটা শব্দও করেননি। উনার ঠিক সেভাবেই অ্যাডভোকেট সাহেবের চোখের মধ্যে ডুবেছিল, যেভাবে শুরু থেকেই দেখে আসছি। অবাক হলাম যখন ম্যাডামের মুখে একটা মুচকি হাসি ফুটে উঠল। সেই মুহুর্তে ম্যাডাম অ্যাডভোকেট সাহেবের ডান হাত নিজের উভয় হাত দিয়ে ধরে জিজ্ঞাস করলেন, "এবার আসি?" তা দেখে অ্যাডভোকেট সাহেবও একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "এবার যেতে পারো।" বলার সাথেসাথে ম্যাডামের গলা ছেড়ে আরো বললেন, "তোমার অপেক্ষায় থাকবো।" অতঃপর ম্যাডাম দরজার দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। তা দেখে, আমি দ্রুত আস্তে আস্তে হেঁটে, রান্নাঘরে ঢুকে, পানির গ্লাসে পানি ঢেলে, হাতে নিয়ে রাখলাম। ম্যাডাম রুম থেকে বের হবার পর আমি উনাকে দেখে পানি পান করতে লাগলাম। এবার ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেও কোনো প্রকার প্রশ্ন করেননি। বাহিরে বের হবার জন্য অগ্রসর হতেই, পেছন থেকে অ্যাডভোকেট সাহেব বললেন, "বৃষ্টি! বাসায় গিয়ে আমাকে সব তথ্য পাঠিয়ে দিও। আর হ্যাঁ! আমি ইন্টারভিউটা ইমেইলে পাঠিয়ে দিয়েছি।" তার উত্তরে ম্যাডাম বললেন, "ঠিক আছে। নিজের খেয়াল রেখ।" দরজা খুলতে খুলতে বললেন, "গেলাম এবার। আল্লাহ্ হাফেজ।" জবাবে অ্যাডভোকেট সাহেব বললেন, "সাবধানে যেও। আল্লাহ্ হাফেজ।"

সেই রাত অ্যাডভোকেট সাহেব খাবারের টেবিলে আমাকে হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলেন। উনি জিজ্ঞাস করলেন, "আচ্ছা রাফি, তোমার কাছে ভালমন্দর জ্ঞান কতটুকু আছে?" আমি প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলাম, "তেমন একটা নেই। মানে, আপনার তুলনায়। এমনি তো যথেষ্ট জ্ঞান আছে। যতটা সাধারণ মানুষের থাকার কথা, ততটাই আর কি।"
"অর্থাৎ, খুবই সীমিত।"
"জি।"
"আচ্ছা, তুমি কি প্রত্যেক সাধারণ মানুষের জ্ঞানের সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা রাখো?"
"না। সেটা না। কিন্তু সমাজে সাধারণত যা সবাই ভাল বা মন্দ মনে করে থাকে, সে সকল বিষয়বস্তু নিয়ে আমারও একই মত।"
"হুম! তাহলে চলো, তোমার ধারণা আজ পরীক্ষা করা যাক।"
একথা শুনে, কিছুটা ভয় পেয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "জি, কেমন পরীক্ষা?"
"আরে, ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। সামান্য কিছু প্রশ্ন করবো।"
"জি, কেমন প্রশ্ন?"
"খুবই সহজ। তুমি শুধু নিজের মতামত জানাবে, আর কিছুই না।"
"ঠিক আছে! বলুন।"
"আচ্ছা, বিড়ি সিগারেট সম্বন্ধে তোমার মতামত কেমন?"
"এ বিষয়ে আমার তেমন একটা মতামত নেই। তবে এতটা জানি; যারা ধূমপান করে, তাদের কাছে এটা বেশ প্রিয়; আর যারা ধূমপান করে না বা ধূমপান পছন্দ করে না, তাদের কাছে এটা ঘৃণিত।"
"হা হা হা! তোমার মতামত বলতে কি চেয়েছি, তা মনে হয় তুমি বুঝতে পারনি। আমি জানতে চেয়েছি, তুমি কি এগুলোকে ভাল মনে কর নাকি মন্দ।"
"যে কাজ মানবজাতির অকল্যাণ বয়ে আনে, তা তো অবশ্যই মন্দ। আমিও বিড়ি সিগারেট সম্বন্ধে একই মত পোষণ করি।"
"তাহলে, সোজাসুজি বলতে গেলে; তুমি এটার ব্যবহারের ফলে যে খারাপ প্রভাব বিস্তার হয়, তার উপর ভিত্তি করে পুরো জিনিসটাই খারাপ বলছো, তাই না?"
"জি!"
"তাহলে, তোমার মতে এর কোনো ধরনের ভাল উপযোগ নেই? কোনো ভাল বা কল্যাণকর উদ্দেশ্যে এটা ব্যবহার করা সম্ভব না?"
আমি কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলাম, "জি না।"
"তবে এবার আমি যদি এটার ভাল একটা ব্যবহার বলতে পারি?"
অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "এগুলোর ভাল ব্যবহারও আছে?"
"জি! অবশ্যই আছে। তবে সেটা সেবনে নয়, তা রোপণে।"
"ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না।"
"আমি আরেকটু ভাল করে বুঝিয়ে বলি। আসলে, ব্যাপারটা বুঝতে হলে কিছুটা কৃষিবিজ্ঞানের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। আচ্ছা, তুমি কোনো এক শ্রেণীতে কৃষিবিজ্ঞান পাঠ করেছিলে, তাই না?"
"জি, করেছিলাম।"
"তাহলে, নিশ্চয়ই তুমি কীটনাশক শব্দটির সঙ্গে পরিচিত।"
"হ্যাঁ"
"কি সেটা, বলতে পারবে?"
"ফসলের জন্য ক্ষতিকারক সকল পোকামাকড় দমনের জন্য একটি বিষ ব্যবহার হয়ে থাকে। সেই বিষ মাটি বা পানিতে ছিটিয়ে দিলে সকল কীটপতঙ্গ মারা যায়।"
"বাহ্! দারুণভাবে মনে রেখেছ। আচ্ছা, তুমি কি জানতে; সিগারেট দিয়ে এক প্রকার  কীটনাশক বানানো যায়?"
"না। সেটা তো জানতাম না।"
"হা হা হা! তামাক পাতা হলো একটি প্রাকৃতিক কীটনাশক। এটার প্রয়োগের বেলায় আমরা শুধু খারাপ দিকটার দিকেই নজর দিয়ে থাকি। এর ভাল কোনো দিক রয়েছে কি না, তা কখনওই আমাদের চোখে পড়ে না।"
"হুম! বুঝতে পেরেছি।"
"এটার অন্যান্য কিছু উপযোগও রয়েছে। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য তোমাকে কৃষিবিজ্ঞানের জ্ঞান দেয়া নয়। আমার উদ্দেশ্য হলো তোমার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা।"
"কেমন ধরনের পরিবর্তন?"
"বিচারবুদ্ধি এবং বিবেক। একজন মানুষকে কখনওই সাদাকালো তর্কে জড়ানো উচিত নয়।"
"সাদাকালো তর্ক বলতে কি বোঝাতে চাচ্ছেন?"
"সাদাকালো তর্ক বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি; কোনো কিছুকে এত সহজেই ভাল বা খারাপ মনে করে নেওয়া উচিত না। কেননা পৃথিবী হলো রঙিন আর এই রঙিন পৃথিবীর মধ্যেই লুকিয়ে বহু অজানা রহস্য। আচ্ছা, তুমি কখনও রামধনু দেখছ?"
"হ্যাঁ! দেখতে খুবই চমৎকার।"
"হ্যাঁ! কিন্তু তুমি কি জানো, এতে কয়টি রং থেকে থাকে?"
"সাতটি।"
"শাবাস! এবার বলতো দেখি, এই রামধনুর সাতটি রং আমরা কীভাবে দেখতে পাই?"
"বৃষ্টির পর আকাশের এক পাশে দেখতে পাই।"
"কিন্তু তখনই কেন দেখতে পাই? তখন এটা নতুন করে জন্মগ্রহণ করে নাকি তা চিরকাল থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিল?"
"সে প্রশ্ন কখনও মাথায় আসেইনি।"
"সেজন্যই তো। জানতে তো হবে। না জেনে তো থাকলে তো সারাজীবন ভেবেই যাবে, কিন্তু কিছুই করতে পারবে না। শুধু দেখেই যাবে, কিন্তু কিছুই বুঝবে না। শুধু শুনেই যাবে, কিন্তু কিছুই উপলব্ধি করতে পারবে না। জানার একটা ইচ্ছে থাকতে হবে তো।"
"এককালে আমার অনেক জানার ইচ্ছে ছিল। পুরো বিশ্বটার প্রতি আমার কৌতূহল ছিল। তবে তা আর নেই। এখন আমি শুধু কোনোভাবে বাকিটা জীবন শান্তিতে কাটাতে চাই।"
"যেই জীবনকে তুমি শান্তিপূর্ণ মনে করছ, সেই জীবনটা সবচেয়ে বেশি অশান্তির। কেননা, বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো জ্ঞান। একজন মানুষের মধ্যে সেই জ্ঞান নামক জিনিসটা না থাকলে, তার অস্তিত্বের কোনো মূল্য আর থাকে না। সে হয়ে পড়ে একটা জীবন্ত লাশ।"
"কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেকেই তো আছে, যারা কিছু না জেনেও বেঁচে আছে। তাদের অস্তিত্বও কি বৃথা?"
"অবশ্যই। কারণ তারা বেঁচে আছে শুধু বাহ্যিক দিক দিয়ে। বাস্তবে তাদের কোনো পরিচয় নেই, কোনো পৃথক গুণাবলি নেই, নেই কোনো প্রতিভা, নেই কোনো বিশ্বাস। মোট কথা বলতে গেলে, তাদের কাছে বেঁচে থাকার কোনো কারণই নেই। এদের মৃত্যুতে মর্মাহত হবার কেউ নেই। এদের মনে রাখার মতো কোনো স্মৃতি নেই। এই সামান্য একটা শ্বাসপ্রশ্বাসের কার্যক্রমকে যদি তুমি জীবন বলে থাকো, তাহলে তোমার বেঁচে থাকার সংজ্ঞাটি ভুল। কিন্তু কথা অন্য হচ্ছিল ভিন্ন প্রসঙ্গে। কি ছিল সেটা?"
"আপনি রামধনুর রং নিয়ে কিছু বলছিলেন।"
"ওঃ হ্যাঁ! ধন্যবাদ। আমি বলছিলাম, রামধনুর সাতটি রং আমরা শুধু বৃষ্টির পরই দেখতে পাই। তার একটা নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। সেই কারণটা হলো; এই সাতটি রং সর্বদা লুকিয়ে থাকে সূর্যের সাদা রশ্মির মধ্যেই। সেই রশ্মি খালি চোখে দেখতে গেলে শুধু সাদা, কিন্তু বৃষ্টির পরে তার মধ্যের যত রং আছে, তা দেখতে পাওয়া যায়। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় যাব না, তবে এতে প্রমাণিত হয় যে সাদাও পুরোপুরি সাদা নয়।"
"কিন্তু কালো তো কালোই হয়, তাই না?"
"না! কালোর মধ্যেও অসংখ্য প্যাঁচ রয়েছে।"
"কেমন প্যাঁচ?"
"কালো হলো আধারের রং। এই আধারেই লুকিয়ে থাকে মানুষের মনের এবং প্রাণের নানা রহস্য। তাছাড়া বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলেও আমরা দেখতে পাই; কালো একটিমাত্র রং হবার সত্ত্বেও এর সৃষ্টির মোট চারটি ভিন্ন পন্থা আছে। মোট সাতটি রঙের চার ভিন্ন ধরনের মিশ্রণের মাধ্যমে কালো রং তৈরি করা সম্ভব।"
"শেষের ব্যাখ্যাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।"
"সোজাসুজি বলতে গেলে; সাতটি রঙের এমন চারটি মিশ্রণ আছে, যার ফলে কালো উৎপাদন করা যায়। যেমন: সবুজ এবং লালের সংমিশ্রণে কালো তৈরি করা সম্ভব। ইত্তেফাক  দেখো, আমাদের দেশের পতাকাটাও লাল আর সবুজ। কি অদ্ভুত একটা ব্যাপার না?"
"জি! আসলেই।"
"আচ্ছা, তুমি নিশ্চয়ই চিন্তা করছ যে আমি তোমাকে এতগুলো প্রশ্ন জিজ্ঞাস করছি, এতগুলো ব্যাখ্যা দিচ্ছি, নিজের মানসিক বিকাশ ঘটানোর কথা বলছি; এসবের পেছনে নিশ্চয়ই আমার কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে, তাই না?"
আমি কিছুটা ঘাবড়ে উত্তর দিলাম, "না! তেমন কিছু না।"
"ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমি একটা বিশেষ উদ্দেশ্যেই এই প্রশ্নগুলো করেছি।"
"সেই উদ্দেশ্যটা কি?"
"সেটা বলার আগে আরো কিছু প্রশ্ন করার ছিল একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে।"
"জি, বলুন।"
"তুমি আজ কি কি দেখেছিলে এবং কি কি শুনেছিলে? তার সবটুকু আমাকে বলো।"
একথা শুনে আমি থতমত খেয়ে, একটু নিম্ন স্বরে জিজ্ঞাস করলাম, "কি দেখাশোনার কথা বলছেন? আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।"
মুচকি হেসে বললেন, "আরে মিঞা, ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। আমি ভাল করেই জানি, তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের কথাগুলো শুনছিলে।"
"তা কি করে বুঝলেন?"
"তোমার কি মনে হয়, আমি এতই বোকা? আমি এত কোটি কোটি টাকা কামাই করি, এত বড় একটা বাসার মালিক, এত ধনী হবার সত্ত্বেও বাসায় গুপ্ত ক্যামেরার ব্যবস্থাও করতে পারবো না?"
"তা অবশ্যই পারবেন। আপনার তো যথেষ্ট সামর্থ্য আছে। কিন্তু আমি তো কখনও কোনো ক্যামেরা দেখিনি।"
"ক্যামেরাগুলো খুবই অস্বাভাবিক স্থানে অবস্থিত। সেগুলোর অবস্থান শুধু আমিই জানি। তোমার আগে জিনি কাজ করতেন, উনিও এ সম্বন্ধে কিছু জানতেন না।"
"এসব আমাকেই বলছেন। এতই বেশি বিশ্বাস আমার উপর?"
"তা তো অবশ্যই। কেননা তোমার মধ্যে জানার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও, তা তুমি লুকিয়ে রাখো। এমন মন মানসিকতা সবাই পোষণ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে তুমি বাকি সবার তুলনায় আমার কাছে ব্যতিক্রম একজন ব্যক্তি। আমি চাই তুমি যাতে এতটাই জানো যে তোমার জ্ঞান খুব তাড়াতাড়িই চরম মাত্রায় বিকশিত হোক।"
আমি খুবই অবাক হলাম উনার এই কথাগুলো শুনে। মনে মনে ভাবছিলাম, এর পিছনেও নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। তবে অতিমাত্রার ভয়ের কারণে তা জিজ্ঞাস করতে দ্বিধা বোধ করছিলাম। ইতিমধ্যে অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের থেকেই বলে উঠলেন, "তোমার নীরবতার কারণ আমি ভাল করেই জানি। আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি, তোমার চিন্তিত হবার কিছুই নেই। তোমার কোনো প্রকার ক্ষতিসাধন করার কোনো উদ্দেশ্য নেই আমার। উদ্দেশ্য আছে তো শুধু তোমাকে একজন স্বনামধন্য মানুষে পরিণত করা এবং সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে, এই সমাজের এক সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে জীবনযাপন করার সুযোগ করে দেয়া।"
"কিন্তু হঠাৎ আমার প্রতি এত দরদ! তার তো নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে, তাই না?"
"ঠিক! তবে যে কারণে আমি তোমার জন্য এসব করবো তা হলো আমার প্রতি তোমার আনুগত্য। আমার সকল কাজেই তোমার যথাযথ সহায়তা এবং সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা আশা করার মতো নির্ভরযোগ্যতাই আমার জন্য যথেষ্ট হবে।"
"কি ধরনের কাজ?"
"সেটা তো তুমি ভাল করেই জানো। আমাকে নতুন করে কিছু বোঝানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমি জানি, তুমি যথাযথ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী, তাই তোমাকেই বিশ্বাসযোগ্য কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত মোটেও ব্যর্থ হবে না।"
"কিন্তু আমি তো এমনিতেই আপনার জন্য কাজ করি। আলাদাভাবে করে আর কি কি করাতে চাচ্ছেন আমার মাধ্যমে?"
"গোয়েন্দাদের মতো কিছু তদন্তের কাজ। ব্যাস! আর কিছু না।"
"কিন্তু আমি তো কোনো গোয়েন্দা না। আমি তো কখনও এমন ধরনের কাজ করিওনি।"
"মানা না করে, নিজের যোগ্যতার অজুহাত দিচ্ছো। অর্থাৎ আগ্রহ রয়েছে ঠিকই, ঘাবড়ে গিয়েছ। ধরা খাওয়ার ভয়, তাই তো?"
"জি!"
"সেটা কোনো ব্যাপার না। অভিজ্ঞ ব্যক্তি লাগলে তোমায় বলতাম না। আমার দরকার এমন কারো, যে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখাশোনার কাজ করতে পারবে। ঠিক সেভাবেই, যেভাবে তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের দেখছিলে এবং আমাদের কথাগুলো শুনছিলে।"
"সেটা তো ছোটখাটো ব্যাপার ছিল। আমি তো আপনার কাছে ধরাও পড়লাম।"
"তা তো পড়েছো, কিন্তু তা নিজের কোনো ত্রুটির কারণে নয়। তুমি ধরা পড়েছো একমাত্র আমার সতর্কতার কারণে। এই সতর্কতা সকলের মধ্যে বিদ্যমান নয়। বরং অবহেলাটাই বেশি। তাই তুমি এই কাজের জন্য পুরোপুরি যোগ্য এবং দক্ষ একজন প্রতিনিধি।"
"আমি যদি কোনো ভুলে ভুলে কোনো প্রকার ভুল তথ্য নিয়ে আসি? তাহলে তো তার দায়ভার আমাকেই নিতে হবে।"
"আমি তো এখন পর্যন্ত একবারও দায়ভারের কথা বলিনি। আমি তো শুধু কাজ এবং তার পুরস্কারের কথা বলেছি। তোমার দায়ভার নেয়ার কোনো দরকার নেই। তুমি শুধু তথ্য আদানপ্রদান করবে, আর কিছুই না।"
অ্যাডভোকেট সাহেবের মুখ থেকে একথা শুনে আমার মনের সব ভয়ভীতি দূর হয়ে গেল, আর আমি আনন্দে মেতে উঠে, খুবই আগ্রহের সঙ্গে, মুখে বড় একটা হাসির সঙ্গে বললাম, "ঠিক আছে! ঠিক আছে! তাহলে আমি রাজি। এবার বলুন, কি করতে হবে আমার?"
আমার আগ্রহ দেখে অ্যাডভোকেট সাহেব হেসে বললেন, "হা হা হা! দ্যাট্স দা স্পিরিট, মাই বয়! এবার গিয়ে লাইনে এসেছ। তোমাকে তোমার কাজ বোঝানোর আগে আমাকে জানতে হবে তুমি কতটা দেখেছো, আর কতটা শুনেছো।"
"আমি আপনাদের আলাপের অধিকাংশটুকুই শুনেছি। বলতে গেলে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই। তবে ঠিক যে সময়ে কথা শুরু হয়েছিল, ঠিক সেই সময়ের কথাটুকু শুনতে পারিনি।"
"তার স্বামীর ব্যাপারটা শুনেছো তো?"
"হ্যাঁ! উনার কাছ থেকে ম্যাডাম তালাক চান।"
"একদম ঠিক! তার পরের ভাগ মনে আছে?"
"আপনি তালাক আদায় করে নেয়ার একটা পন্থা বলেছিলেন। কারো সঙ্গে যদি হাতেনাতে ধরা খেয়ে যায়, তাই তো?"
"হ্যাঁ! তার জন্য একজন গুপ্তচর নিয়োগ দেয়ার কথা মনে আছে?"
"জি! আপনার পরিচিত কারো কথা বলছিলেন।"
"হ্যাঁ! সেই পরিচিত গুপ্তচরটাই তুমি।"
আমি উনার এই কথাটা শুনে প্রথমে অবাক হলেও, তা বলার আগেই কিছুটা ধারণা করতে পেরেছিলাম। একথা মাথায় রেখে, খুবই শান্তশিষ্টভাবে বললাম, "উক্ত কাজটি করবার পূর্বে, আমার কিছু প্রশ্ন ছিল। আপনার অনুমতি হলে, তা জিজ্ঞাস করবো।"
"তোমার প্রশ্নের উত্তর না দিলে কি কাজটা করবে না?"
"আমি সেটা বলিনি। আমি শুধু নিজের মনের একটা কৌতূহল প্রশ্ন করার অনুমতি চাচ্ছিলাম। তবে আপনি জবাব দিতে অনিচ্ছুক হলে, আমি আর প্রশ্ন করবো না।"
"হা হা হা! আমি তো ঠাট্টা করছিলাম। বলো! বলো! কি প্রশ্ন তোমার?"
"জি, আমার প্রশ্ন হচ্ছে; আপনি তো বলেছিলেন আপনার একটাই প্রেমিকা আপনাকে ছেড়ে দিয়েছিল সেই দুর্ঘটনার পর। তখন তো আপনি নতুন কোনো সঙ্গীর কথা উল্লেখও করেননি। তাহলে এই ম্যাডামটা কে? উনার সঙ্গে কিভাবে প্রেম আর বিয়ের কথা শুরু হলো?"
"বৃষ্টির সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল মারজিয়ারও আগ থেকে। সে আমার খুবই ভাল একজন বান্ধবী ছিল। তার আর আমার মধ্যে কখনও এই আকর্ষণ ছিলই না। আসলে, আমার মতে তা ছিল না, কিন্তু তার মনে আমার জন্য জায়গা করাই ছিল।"
"প্রেমটা কীভাবে হয়েছিল?"
"তোমার মনে আছে, যখন মারজিয়া আমাকে ফোনে উল্টাপাল্টা শুনিয়েছিল? সেসময় বৃষ্টি আমার খাতির তার বাসায় গিয়ে, তাকে মানানোর চেষ্টা করে, সে না মানাতে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, সারা দিনরাত হাসপাতালে আমার সেবা করে, রাত জেগে থাকত আমার জন্য, আমার ঔষধের নিয়মানুবর্তিতার খেয়াল রাখত। আমার জন্য তার পরিবারের কাছেও অনেক বকাঝকা শুনতে হয়। তবুও সে আমার পাশেই ছিল। একদিন জিজ্ঞাস করে বসলাম; আমার এত খেয়াল রাখার বিনিময়ে তাকে আমি কীভাবে ধন্যবাদ জানাতে পারি। তখন সে তার গালের টোল পড়া মিষ্টি হাসি দিয়ে আমাকে বলে, সে আমার ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই চায় না। আর এভাবেই কিছু মাসের শ্রম এবং সেই একটি মুহূর্তের জাদুর ছোঁয়ায়, আমি তার প্রেমে মাতাল হয়ে পড়লাম।"
"যে আপনার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছিল, তার জন্য আপনি তার বাবার কিছু মন্দ আচরণ সহ্য করতে পারলেন না? কাউকে মন থেকে ভালবেসে থাকলে অন্তত এতটুকু ধৈর্য তো থাকা দরকার।"
একটু বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, "তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিলে, যা আমি দিয়েছি। আমি এই প্রসঙ্গে তো তোমার মতামত জানতে চাইনি। তাছাড়া তোমার এই উক্তিটি আমার কাছে পুরোপুরি অযৌক্তিক।"
"অপ্রয়োজনীয় মতামতের জন্য দুঃখিত। কিন্তু আমার উক্তিটি অযৌক্তিক হওয়ার কারণ জানতে পারি?"
"ভালবাসা সম্পর্কে তোমার ধারণাই তো অযৌক্তিক। এই ভ্রান্ত ধারণা সম্পর্কে কি বলতে পারি, বলো?"
"তাহলে আমার জ্ঞান বিকশিত করার উদ্দেশ্যে হলেও, আমাকে ভালবাসার সঠিক ধারণাটা দিন। আমার এ সম্বন্ধে অধিক আগ্রহ রয়েছে।"
"দেখো, ভালবাসা শুধু স্বীকারকেই বোঝায় না। ভালবাসা হলো একটি মনে, আরেকজনের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান এবং আত্মিক বন্ধন। ভালবাসায় কখনও দেখা হয় না, কে কত সুন্দর বা, কে কত কুৎসিত। কারণ যদি দেখার ভিত্তিতে হয়েছে, তা হলো চোখের পছন্দ। ভালবাসা কখনও কণ্ঠ শুনে হয় না। কারণ সুন্দর কণ্ঠস্বর শুধু কানের পছন্দ। ভালবাসা কখনও শারীরিক চাহিদার জন্য হয় না। কারণ সেই চাহিদা মেটানোর আরো অনেক উপায় রয়েছে। ভালবাসা কখনও আগ্রহের মাধ্যমে হয় না। ভালবাসা কখনও সম্পদ দেখে হয় না। কারণ সেটা হলো লোভ। ভালবাসা কখনও দয়া করে হয় না। কারণ সেটা হলো ভিক্ষা। কারণ আগ্রহ তো সবার প্রতিদিন পরিবর্তিত হয়ে থাকে।" এরপর হঠাৎ মাটির দিকে চেয়ে, কোনো এক চিন্তায় হারিয়ে উনি গেলেন।
"জি, কিছু ভাবছেন?"
অ্যাডভোকেট সাহেব চমকে উঠে বললেন, "না! তেমন কিছু না। তো, আমি যা বলছিলাম। ভালবাসা এতটাই সহজলভ্য নয়। যদি তা ই হতো, তাহলে তো আর কোনো সমস্যাই হতো না। ভালবাসা মানে এই না, যে সারাদিন একে অপরের জন্য শুধু দিয়েই যেতে হবে। কোনো কোনো সময় কষ্ট দেওয়াও ভালবাসার এক বহিপ্রর্কাশ। কখনও কখনও ঝগড়া করাও ভালবাসার একটি ছোটখাটো রূপ। কখনও কখনও ভুলে যাওয়াটাও ভালবাসার অনেক বড় একটা প্রতিচ্ছবি।"
"কিন্তু যাকে ভালবাসি, তাকে কষ্ট দিব কি করে? যাকে ভালবাসি, তার সঙ্গে ঝগড়া হবেই বা কেন? যাকে ভালবাসি, তাকে কি ভুলে যাওয়ার জন্য একসময় ভালবেসেছিলাম?"
"কেন? কেন কষ্ট দিতে পারবে না? তাকে কষ্ট দিয়ে যদি সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, তবে কেন কষ্ট দিতে পারবে না? যদি কোনো বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার ফলে ঝগড়া লেগে যায়, তবে কি সেই ঝগড়ার দ্বারা উভয়ের মানসিকতা সম্বন্ধে আরো ভাল ধারণা পাওয়া সম্ভব না? তুমি যদি কখনও ঝগড়া না ই করে থাকো, তবে তো তুমি বিভিন্ন প্রসঙ্গে তার মতামত জানতে পারবে না। ফলে তাকে কখনও পুরোপুরি বুঝতে পারবে না। আর যদি ভুলে যাওয়ার কথা বলি, সেক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রথমে নিজের বিবেকের দিকে তাকাতে হবে। তুমি কাউকে একতরফা ভালবেসে থাকলে, তার কাছ থেকে কখনও ভালবাসা আশা করা যায় না। কারণ তা ভালবাসা হবার সত্ত্বেও শুধুমাত্র ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার। সে যদি তোমাকে ভাল না বেসে থাকে, তবে নিশ্চয়ই অন্য কাউকে তো ভালবাসবে। সেই মুহুর্তে তোমার জন্য সর্বোত্তম করণীয় হলো, তাকে মন থেকে ভুলে যাওয়া। কারণ যতদিন সে তোমার মনে থাকবে, ততদিন সে তোমার জীবনে থাকবে না। যার ফলে সৃষ্টি হবে ঘৃণা এবং ক্রোধ। এককালে যাকে ভালবাসতে, তার প্রতি মনে শুধু নেতিবাচক চিন্তাচেতনা রয়ে যাবে। তাই ভুলে যাওয়াও একজন আদর্শ প্রেমিকের প্রশংসনীয় একটি গুণ। এই নাও। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে বলতে পারো।"
"না! আর কোনো প্রশ্ন নেই। তবে একটা বিষয়ে আপনার মতামত চাই।"
"হ্যাঁ, বলো।"
"ভালবাসা তো রূপ দেখে হয় না। তবে এমন কেউ যদি থাকে, যে সমাজের কাছে কুৎসিত হয়ে থাকলেও আমার কাছে সবচেয়ে রূপবতী? অর্থাৎ শুধু আমার কাছেই সে সুন্দর। তবে সেটাও কি রূপ দেখে পছন্দ করার মতোই হবে?"
"হ্যাঁ, অবশ্যই। কেননা একজন ব্যক্তিকে ভালবাসার জন্য তার সুন্দর হবার এমন কি প্রয়োজন? তুমি যদি একজনের কুৎসিত হওয়া মেনে নিয়ে, তার সঙ্গে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখতে পারো; তুমি ভালবেসেছো। তুমি যদি তার অস্তিত্বকে সেই সম্মানটুকু দিতে পারো, যেটা অন্য যেকোনো সুন্দর ব্যক্তিকে দিতে পারো; তুমি ভালবেসেছো। তুমি যদি সেই কুৎসিত ব্যক্তির পাশে থেকেই মনের তৃপ্তি পাও, যে তৃপ্তি কোনো সুন্দর ব্যক্তির পাশে থেকেও না পেয়ে থাকো; তুমি ভালবেসেছো। মোট কথা হচ্ছে; সত্যকে ভালবাসো তা পুরোপুরি মেনে নিয়ে। সেই সত্যের মধ্যে যদি মিথ্যার দাগ পাওয়া যায়। তবে সেই একটা দাগের জন্য সত্যটা কলঙ্কিত সতে পারে, কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারে না।"
"হুম! বুঝতে পেরেছি। এবার আমার ধারণা অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে।"
"ঠিক আছে! আজকের আলোচনা এখানেই সমাপ্ত করছি। তোমার কাজ কাল সকালে বুঝিয়ে দিব।"
"ঠিক আছে!"
"ওঃ, আরেকটা কথা। আজ রাতে আমার রুমের আশেপাশে যাতে না দেখি। দরকার পড়লে একটা জগের মধ্যে পানি নিয়ে, নিজের রুমে রেখে দাও।"
"ঠিক আছে!" বলেই আমি সকল থালাবাসন ধুয়ে, এক জগ পানি নিয়ে, ঘুমোতে চলে গেলাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে, খোলা চোখে এক মধুর স্বপ্ন দেখছিলাম। ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে, প্রতিষ্ঠিত হয়ে, এক সুন্দরী দেখে মেয়ে বিয়ে করবো। মা বলতেন, তার জন্য অনেক বড় কপাল লাগে। বাবা বলতেন, তার জন্য প্রচুর টাকাপয়সা লাগে। শিক্ষকেরা বলতেন, তার জন্য অধিক শিক্ষিত হতে লাগে। কি বিশাল কপাল আমার! অ্যাডভোকেট সাহেবের জন্য কাজ করছি, উনার কাজগুলোর জন্য টাকাপয়সাও প্রচুর পাবো, তাছাড়া আমাকে নানান বিষয়ে শিক্ষাও প্রদান করা হচ্ছে। অর্থাৎ এখন আমার কাছে একজন সুন্দরী নারী বিয়ে করার মতো সামর্থ্য রয়েছে। তবে এবার আমার আর সেই উদ্দেশ্য নেই। এবার আমার স্বপ্ন একজন এমন কাউকে বিয়ে করা, যে আমাকে প্রকৃতপক্ষে ভালবাসবে। সে হোক সুন্দর, হোক কুৎসিত; সে হবে শুধু আমার, আমি তাহার। এই স্বপ্নটা চোখে রেখে, চোখটা সামান্য বন্ধ করলাম। চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে মুখে একটি মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। সেই রাত চোখ দুটো খোলার মতো ইচ্ছে করছিল না। ইচ্ছে করছিল এই সুন্দর স্বপ্নেই ডুবে থাকি। এমনই এক শান্তিপূর্ণ মুহূর্তে শুয়ে ছিলাম। তার ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

পরের সকালে চোখ খুলে দেখি উঠতে কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছে। তাড়াহুড়া করে, মুখ ধুয়ে, রান্নাঘরে গেলাম নাস্তা তৈরি করতে। তখনই মনে পড়ল, প্রথমে তো গ্রিন টি বানাতে হবে। গ্রিন টি বানিয়ে, অ্যাডভোকেট সাহেবের রুমে নিয়ে গেলাম। ওখানে উনি ছিলেন না। তখন মনে করলাম, নিশ্চয়ই অফিস রুমে হবেন। অফিস রুমের দিকে যাওয়ার সময়, কারো সঙ্গে কথা বলার শব্দ শুনতে পারছিলাম। সকালে এমন সময়ে কারো আনাগোনা খুবই দুর্লভ। কিন্তু সেখানে দাড়িয়ে, কিছুক্ষণ কান পেতে, কথাগুলো শোনার পর বুঝতে পেলাম, আলাপটা ফোনে হচ্ছে। আমি চা এর ট্রে হাতে নিয়ে, অফিস রুমের ভিতরে ঢুকতে নিলাম। ঠিক সেসময় অ্যাডভোকেট সাহেব মা শব্দটি উচ্চারণ করলেন। আমি ইহা শুনে অবাক হয়ে সেখানে দাড়িয়ে রয়ে গেলাম। আসার পূর্বে তো বাবা বলেছিলেন, উনার মা এবং বাবা উভয়ই মারা গিয়েছিলেন। তাহলে এত মধুর সুরে কাকে মা বলে ডাকছিলেন? আমার মনের আশঙ্কা দূর করবার উদ্দেশ্যে রুমের ভিতরে ঢুকে, চা এর ট্রে টেবিলে রেখে, টেবিলের পাশে চুপচাপ দাড়িয়ে ছিলাম। আমার আগমনের ইতিমধ্যে অ্যাডভোকেট সাহেব ফোনের লোকটিকে বললেন, "আচ্ছা মা, এবার রাখি।" এটা বলেই ফোন রেখে দিলেন। আমাকে পাশে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকা দেখে, জিজ্ঞাস করলেন, "কিছু বলতে চাও?"
আমি সাধারণত এসব ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে অনেক দ্বিধা বোধ করতাম। কিন্তু সেদিন বুকভরা সাহসের সঙ্গে জিজ্ঞাস করেই বসলাম, "আপনি ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন?"
আমার আচরণে এমন বিরাট পরিবর্তন দেখে অ্যাডভোকেট সাহেব কিছুটা অবাক হয়েছিলেন, সেটা উনার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছিলাম। অবাক হবারই কথা। যে মানুষ গতকাল রাত পর্যন্ত কদমে কদমে ভয় পেত, তার মধ্যে এমন সাহস তো কেউও আশা করতে পারে না। কিন্তু তবুও সে ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়ে, অ্যাডভোকেট সাহেব আমার প্রশ্নের সত্যি সত্যি উত্তর দিলেন। উত্তর শুনে তো আমার পায়ের নিচ থেকে জমি টেনে নেয়া হয়েছে, এমনটা বোধ হচ্ছিল।
অ্যাডভোকেট সাহেব এত অস্বাভাবিক একটা প্রশ্নের, খুবই স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলেন, "আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম।"
"কিন্তু বাবা তো বলেছিলেন, আপনার মা-বাবা উভয়ই মারা গিয়েছেন।"
"তাও সত্য, কিন্তু পুরো সত্য নয়।"
"মানে?"
"মানে, আমার জন্মদাতা বাবা মারা গিয়েছিল, কিন্তু আমার জন্মদাত্রি মা মারা যায়নি। দুনিয়ার সামনে যেই মহিলাটি সারাটা জীবন আমার মা হিসেবে নিজেকে দাবি করছিল, সে মহিলার তো কোনো সন্তান জন্ম দেয়ার সক্ষমতাই ছিল না। বরং আমার জন্ম হয়েছিল এক পতিতার গর্ভে।"
অ্যাডভোকেট সাহেবের এই বক্তব্য শোনার সঙ্গে সঙ্গে রুমের মধ্যে সকালবেলার যে নীরবতা বিদ্যমান ছিল, তা হঠাৎ করে বাকি সকল বাহ্যিক শব্দকে দমন করে, আমার কানের মধ্যে একাকী বিরাজমান করতে লাগল। বাকি দুনিয়াটা কেমন বোবা হয়ে গিয়েছিল এটা শোনার পর। কিন্তু মনের কৌতূহল চেপে না রেখে, জিজ্ঞাস করলাম, "জি, কীভাবে?"
"আমার জীবনের সবচেয়ে অজানা রহস্য। আমি এটা জানতে পেলাম আমার বাবার কাছ থেকে যখন উনি মৃত্যুশয্যায় শুয়ে ছিলেন। হৃদরোগে আক্রান্ত আমার বাবা, হাসপাতালের রুমে বাকি সবাইকে বললেন বের হতে, আমার সঙ্গে কথা ছিল। তখন মৃত্যুর কিছু মুহূর্ত আগে, আমাকে সবকিছু বলে, পরকালের জন্য প্রস্থান করলেন। জীবন পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় যাকে মা ভাবছিলাম, সে তো আমাকে জন্মই দেয়নি। আমাকে এই সংবাদ জানানোর সঙ্গে, আমার আসল মায়ের ঠিকানা দিয়ে গেলেন। জানো, সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার কি?"
"কি?"
"আমার মা একথা গোপন রাখার জন্য পেয়েছিল সেই সময়ের এক কোটি টাকা। তখনকার সময় এত টাকা তো অনেক জমিদারেরও ছিল না। কিন্তু এত টাকা দিয়ে আমার মা বাকিটা জীবন শান্তিতে কাটানোর সিদ্ধান্ত না নিয়ে, নিজস্ব এক পতিতালয় খুলে বসলেন।"
"কেন?"
"উনার পূর্বের পতিতালয়ের বোনদের কথা চিন্তা করে। তাদের সেখানে প্রচুর নিপীড়িত করা হতো এবং তাদের কাজের বেতনও ঠিকমতো পরিশোধ করা হতো না। তাই আমার মা নিজেরই একটা পতিতালয় স্থাপন করে ফেললেন।"
"নিজের সেই বোনদের নিয়ে তো উনি সমাজে একটা সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারতেন। তা না করে আবার এসবে জড়ালেন কেন?"
"কারণ উনি ভাল করেই জানতেন; এই সমাজ উনাকে যতই যা দেক, সম্মান আর দিবে না। যারা আমার মায়ের সঙ্গে নির্লজ্জ রাত যাপন করেছিল, তারা সরাসরি দুটো কথা বলতেও লজ্জা পাবে। উনি জানতেন; এই সমাজ উনার একটিমাত্র রূপ দেখেছে, তারা অন্য কোনো রূপ কখনওই মেনে নিতে পারবে না। এ সকল বিবেচ্য বিষয় মাথায় রেখেই উনি এত কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন। তাই আমি সবসময় নিজের মানসম্মানের কথা মাথায় রেখে সবকিছু করে থাকি। কারণ আমি জানি; এই সমাজ কালো কাফন মেনে নিবে, কিন্তু সাদা কাফনে কালো দাগ মেনে নিতে পারবে না।"
"আপনার সৎ মায়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?"
আমার এ প্রশ্নটা শুনে, অ্যাডভোকেট সাহেব একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "খুবই অদ্ভুত একটা প্রশ্ন তোমার। কিন্তু তার উত্তর খুবই সহজ। আমি তো সারাজীবন তাকেই মা ভেবে এসেছি, তাই উনি মারা যাবার সময় প্রচুর কেঁদেছিলাম।"
"উনি কীভাবে মারা গিয়েছিলেন?"
"ব্রেস্ট ক্যান্সার। ফাইনাল স্টেজে ধরা পড়েছিল। তাই শত চেষ্টা সত্ত্বেও বাঁচাতে পারলাম না কেউও।"
"আচ্ছা, আপনার বাবা-মা একজন এতিম শিশু আলাদা করে কোনো এতিমখানা থেকেও তো নিয়ে আসতে পারতেন, তাই না?"
"হ্যাঁ! কিন্তু তখনকার সময় এটা বেশ অপমানজনক এবং নিন্দনীয় একটা ব্যাপার ছিল। তখনকার মানুষ কোনো অক্ষম নারী দেখলে, তালাক দিয়ে দেয়ার পরামর্শ দিত। তাই আমার সৎ মা আমার বাবাকে নিয়ে তার এলাকার এক পতিতালয়ে গেলো। সেখানে সবচেয়ে সুন্দরী এবং যুবতী মেয়ে হিসেবে আমার মাকে বেছে নিলো। অতঃপর নয়-দশ মাসের একটা লম্বা ছুটির কথা বলে তারা বিদেশে চলে গেল। শেষমেশ বিদেশ থেকে আসার সময়, মধ্যরাতের আঁধারে, আমাকে আমার প্রকৃত মায়ের কোল থেকে নিয়ে আসা হলো। এটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে গোপন একটা অজানা রহস্য। আমি আশা করি, তুমিও এটা গোপন রাখতে পারবে।"
"জি, অবশ্যই। আপনার গোপন তথ্য আজ থেকে আমারও গোপন তথ্য। এ সকল তথ্য আমি নিজের প্রাণ দিয়ে রক্ষা করবো।"
"ধন্যবাদ! এবার তোমার কাজের প্রসঙ্গে আসি, কি বলো?"
"হ্যাঁ, অবশ্যই। বলুন।"
"আচ্ছা, মনোযোগ দিয়ে শুনো। তুমি প্রথমত আজকে গুলিস্তানে অবস্থিত আমার মায়ের সেই পতিতালয়ে যাবা। সেখানে গিয়ে একজন পতিতার সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে। সেই পতিতার পাশে থেকে, তার দ্বারা বৃষ্টির স্বামীকে ফোন করাবা। সেই মহিলার কাজ হলো; সুন্দর করে কথা বলে, লোকটার উত্তেজনা বৃদ্ধি করা। সাবধানে থাকবে, সে যেন তোমার সম্বন্ধে কিছু না জানতে পারে। সেজন্য তুমি সেখানে একটা নকল নাম ব্যবহার করবে। মাকে ফোনে বলেছিলাম, তোমার নাম; ফারহান। ওখানে গিয়ে এই নামেই পরিচয় দিতে হবে। বাকি সবকিছু তোমার আসার পর বুঝাবো। এতক্ষণ যা কিছু বললাম, বুঝতে পেরেছ তো? কোনো প্রশ্ন থাকলে বলতে পারো।"
"আপনি যে গোয়েন্দাদের মতো তথ্য সংগ্রহের কথা বলছিলেন, তার কি হলো?"
"তা আমি তোমার আসার পর বলবো। কারণ বৃষ্টির স্বামীকে উত্তেজিত করার অংশটুকু ব্যর্থ হলে, সম্পূর্ণ পরিকল্পনাটা ব্যর্থ হবে।"
"জি, বুঝতে পেরেছি।"
এরপর অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছ থেকে সেই পতিতালয়ের ঠিকানা নিয়ে, আমি সেখানের জন্য প্রস্থান করলাম। একটা বাস ধরে সোজা গুরিস্তানে নেমে, আশপাশের কিছু লোকের কাছে ঠিকানা জিজ্ঞাস করে, সেখানে পৌছালাম।
পৌছানোর পর অ্যাডভোকেট সাহেবের মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, নিজের নকল পরিচয় দিয়ে, সেই নিয়োজিত পতিতার সঙ্গে দেখা করে, সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী করলাম। অ্যাডভোকেট সাহেবের পরিকল্পনা ঠিক সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল। সবশেষে বাসায় ফিরে গেলাম। বাসায় পৌছে অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছে সকল তথ্য প্রদান করলাম। তার পরের দিন সকালে আমাকে পাঠানো হয় আমার প্রথম গোয়েন্দা মিশনে পাঠানো হলো।
অ্যাডভোকেট সাহেব বড়ই চতুর একজন লোক, তা তো আগে থেকেই জানা ছিল। কিন্তু উনার চতুরতার একটা বড় উদাহরণ পেলাম সেই মিশনের পরিকল্পনা শুনে। আমি কখনও ভাবতে পারিনি, এমনভাবে কাউকে ফাঁসানো যায়। খুবই সুপরিকল্পিতভাবে আমি সারাদিন লুকিয়ে লুকিয়ে লোকটার পেছনে পেছনে গেলাম। সারাদিন উনার প্রত্যেকটা কার্যক্রম নোট করে, সেই তথ্যাদি অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছে প্রেরণ করলাম। পরিকল্পনা অনুসারে লোকটা কিছু সময় পর পর রাস্তায় হাঁটাচলা থেকে শুরু করে, বাসায় প্রবেশ করার সময় পর্যন্ত সেই পতিতার সঙ্গেই ফোনে আলাপ করছিল। লোকটা তার সুন্দর কন্ঠ এবং উত্তেজনাময় কথাগুলো শুনে কিছু সময়ের মধ্যেই তার সঙ্গে দেখা করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। ঠিক সেই মুহুর্তে সেই লোকটাকে ডাকা হলো সেই পতিতালয়ের দুতলায়। পতিতালয়টা মূলত একসময় একটা গার্মেনটসের কারখানা ছিল। তাই তার কিছু কিছু তলা ছিল টিনের। সেখানকার দ্বিতীয় তলায়ও ছিল ঠিক সেরকম টিনের ছাদ এবং টিনের মেঝ। অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে সেখানে পাঠালেন দালালের ভূমিকা পালনের জন্য। আমি সেখানে লোকটার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তাকে তার রুম নম্বর বুঝিয়ে, তার হাতে চাবি ধরিয়ে বললাম, "এই নেন। রুমে গিয়ে লাইট আর ফ্যান ছেড়ে বসেন। আমি তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
লোকটা আমার কথামতো উপরে গিয়ে, জুতোজোড়া খুলে, বাতি জ্বালানোর জন্য সুইচে চাপ দিল। চাপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা বৈদ্যুতিক ঝটকা খেলো। সেই ঝটকা লেগেছিল কারণ লাইট বাল্বের সকেটের মধ্যে বৈদ্যুতিক তার সংযুক্ত ছিল যা সরাসরি লোকটার পায়ের নিচের লোহার অংশটির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। তারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ যাতে সমগ্র মেঝেতে না ছড়ায়, তাই লোহার অংশটুকু আলাদা করে কেটে, তার আশেপাশের অংশটা কাঠের প্রলেপ দিয়ে আটকিয়ে রাখা হয়েছিল। এভাবে করে লোকটা নিজের হাতেই নিজের মৃত্যু ঘটিয়ে ফেলেছিল। তবে পরিকল্পনার এই অংশটুকু ছিল ভিন্ন। কারণ আমাকে শুধু বলা হয়েছিল, সে রুমে ঢুকে, বাতি জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে গুপ্ত ক্যামেরা চালু হয়ে যাবে। কিন্তু তা কিন্তু মোটেও হয়নি। বরং তাকে ডেকে ফাঁসানোর কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না। শুরু থেকেই এটা ছিল অ্যাডভোকেট সাহেবের আরেকটি সুপরিকল্পিত একটি হত্যা। প্রায় দশটা মিনিট লোকটার শরীরে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছিল। লোকটা তো অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই মারা গিয়েছিল, কিন্তু শুধুমাত্র নিজের মনের সন্তুষ্টির জন্য লোকটার শরীরের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ করা বন্ধ করা হলো প্রায় দশ মিনিট পর। সেই দশ মিনিট এমন পরিস্থিতির পরপর সমগ্র এলাকার বিদ্যুৎ চলে গেল প্রায় এক ঘণ্টার জন্য। এই একটা ঘণ্টার মধ্যে সেই লাশটি চুপচাপ সেখান থেকে বের করা হলো, বৈদ্যুতিক তারগুলো সরানো হলো। সেই লাশটি আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে গিয়ে, তার শরীর থেকে সুই দিয়ে রক্ত বের করা হলো। শরীর থেকে যখন আর রক্ত বের হচ্ছিল না, তখন শিরা কেটে, অবশিষ্ট রক্ত কেঁচে, বের করা হলো। তারপর তার শরীরের চামড়া ছুরির মাধ্যমে আলাদা করা হচ্ছিল। দৃশ্যটি দেখে মনে হচ্ছিল, কোনো গবাদি পশু জবাই দেয়ার পর তার দেহ থেকে যেভাবে চামড়া আলাদা করা হয়। এরপর খুবই সুন্দরভাবে, শরীরের মাংস কেটে ভাগ করা হয়। তার চামড়া এবং পরনের কাপড় পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল আগুনে। তার মাংসের টুকরোগুলো কিছুটা রাস্তার কুকুরদের খাওয়ানো হলো এবং তার অবশিষ্ট রান্না করা হলো, তার পরের দিন গরিবদের খাওয়ানোর জন্য। সেই এক ঘণ্টার মধ্যে লোকটার অস্তিত্ব এভাবেই মিটে গিয়েছিল। এসব করছিল অ্যাডভোকেট সাহেবের সেই নিয়োজিত লোকেরা। তারা উপরের এবং নিচের তলায় অপেক্ষা করছিল। সমস্ত এলাকা অন্ধকার হওয়াটা ছিল তাদের জন্য এক প্রকারের ইশারা।
জীবনে প্রথমবার একটা খুনে এত বড় ভূমিকা পালনের পর শেষমেশ বাসায় ফিরলাম। বাসায় প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, "আসার সময় সাবধানে এসেছো তো? পরিচিত কেউ আবার দেখেনি তো?"
উনার এই প্রশ্ন শুনে, আমি খুবই নিম্নস্বরে উত্তর দিলাম, "না। কেউ দেখেনি আমায়।"
"শাবাশ! তোমার জন্য টাকা রেডি করে রেখেছি। মোট আঠারো কোটি টাকা আছে।" একথা শুনে তো আমার খুশিতে লাফ দিয়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু আমার বিবেক আমাকে সেই আনন্দ অনুভব করার অনুমতি দেয়নি। সেই নিম্নস্বরেই জিজ্ঞাস করলাম, "কি দরকার ছিল এসব করার? লোকটাকে ফাঁসানোর উদ্যোগটাই তো ঠিক ছিল। তার হত্যা করার কি এমন প্রয়োজন ছিল, বলুন?"
"তাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে, তার উপর মামলা দিয়ে, তালাক হবার পরপর বৃষ্টির সঙ্গে বিয়ে করলে, সকল সন্দেহ আমার উপর এসে পড়ত। তাই সেটা না করে, এই পৃথিবী থেকে তার অস্তিত্ব মেটানোর ব্যবস্থাই করে ফেললাম।"
"এসব করতে কি আপনার বিবেকে কখনও বাধা দেয়নি?"
"একসময় এমন ছিল, যখন এগুলো নিয়ে শত শত রাত জেগে থাকতাম। এগুলো চিন্তা করলেও দেহের লোম দাঁড়িয়ে যেত। কিন্তু সেই সকল অনুভূতি এক বন্ধুর লাশের সাথে কবর দিয়ে এসেছিলাম।"
"বন্ধুর লাশ?"
"হ্যাঁ! স্কুলে পড়া কালীন সময়ে আমার এক বন্ধু ছিল; জুলকান। সে আমার সবচেয়ে কাছের এক বন্ধু ছিল। জুলকানের স্বপ্ন ছিল পৃথিবীর একজন ডাক্তার হবার। মানবসেবার প্রতি তার প্রচুর আগ্রহ ছিল। একদিন ক্লাস শেষে, সে স্কুলের বায়োলজি ল্যাবের মধ্যে ঢুকে পড়ে, কিছু কিছু প্রাণীর দৈহিক গঠন সম্বন্ধে কিছু তথ্য জোগাড় করার জন্য। সেদিন আমি তার সঙ্গে যাওয়ার প্রতি অরুচি প্রকাশ করার কারণে সে একা একাই ল্যাবে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে সে দেখে, সিনিয়র কিছু ছেলে সেখানে নেশা করছে। সে তাদের কাছে গিয়ে, সুন্দরভাবে তাদেরকে সেখানে নেশা করতে মানা করেছিল। এই মানা কারাটা এতই বড় অপরাধ হয়ে বসল, যে এটার জন্য তাকে তার জীবন হারাতে হলো। সেই জানোয়ারেরা মেরে ফেলল আমার বন্ধুকে আর আমি কিছুই করতে পারিনি। তাদের বিচারের বেলায়, টাকার সাহায্যে তাদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করা হয়েছিল। সেদিন থেকেই আমি শপথ করলাম; যা বলিব, মিথ্যে বলিব, মিথ্যে বৈ, কিছু বলিব না। এটা আইনি শিক্ষার ঠিক বিপরীত। কিন্তু এই বিপরীত শিক্ষাটা একজন আইনজীবীর কাছ থেকেই শিখেছি।"

এরপর রুমে বাকিটা রাত বিরাজমান ছিল শুধু নীরবতা। এই নীরবতার আড়ালে, নির্লজ্জভাবে, সেই আঠারো কোটি টাকার ব্যাগ নিয়ে, প্রস্থান করলাম বাড়ির দিকে। ভাল করেই জানতাম, এখন এমন মানুষকে বোঝানো সম্ভব নয়। কেননা এমন মানুষের জ্ঞানের তুলনায় পৃথিবীর সকল জ্ঞান কেবল তুচ্ছ মনে হবে। জানি না আমি; এ ঘটনাগুলো ভুলতে কতটা সময় লাগবে, তবে অ্যাডভোকেট সাব্বির ক্বারির জন্য কাজ করা, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে থাকবে। কেননা যেই লোকটাকে জমির উপরে চলার জন্যও হুইলচেয়ারের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, তার তো মোটেও কোনো প্রকার অহংকার থাকা উচিত না। কিন্তু কেবলমাত্র একটা কেদারায় ভ্রমণ করে জীবন কাটানোর সত্ত্বেও এত জ্ঞানী এবং ক্ষমতাসীন একজন ব্যক্তি দিন কাটায় অহংকার করেই। এই অহংকার তার পতন আনুক আর না আনুক, এই সমাজে ধ্বংস বয়ে আনবে নিঃসন্দেহে।

এর সাথেই শেষ করছি এই গল্প।

Comments