কেদারায় ভ্রমণ (বাস্তবিক) - ৩.১

আমি বাড়িতে ফেরার জন্য এবার বাসে না চড়ে, চড়লাম ট্রেনে। কারণ এত ভাঁড়ি ব্যাগ নিয়ে বাসে চড়লে এমন নিবিড় রাতে নিশ্চয়ই ছিনতাই হবার সুযোগ রয়েছে। যশোরের ট্রেনে উঠার সময় কিছু আশ্চর্যজনক ব্যাপার খেয়াল করলাম। ট্রেনের মধ্যে মানুষের সংখ্যা ছিল খুবই কম। মনে হচ্ছিল যেন বাকি সবাইকে ওঠার সুযোগ দেয়া হয়নি। আমি এত বেশি চিন্তা না করে দ্রুত ট্রেনে উঠে পড়লাম।
আমার সবসময়ই জানালার পাশে বসতে ভাল লাগত। তাই এবারও জানালার পাশের সিটে গিয়েই বসলাম। এমন এক কোনা বেছে নিয়েছিলাম, যেখানে কেউ ছিল না, যাতে ব্যাগটি রক্ষা করতে আরো সুবিধা হয়। ঠিক এমন সময় ট্রেনের ইঞ্জিন আরম্ভ হলো, আর তা যশোরের দিকে অগ্রসর হলো। আমি ক্লান্ত ছিলাম বলে একটু বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে শুয়ে পড়লাম। তার ঠিক কিছুক্ষণ পরে আমি কিছু লোকের কথা বলার শব্দ শুনতে পারছিলাম। শব্দ তো এমন লোকাল ট্রেনে প্রায় সময়ই থাকে। তবে গলার কণ্ঠস্বর শুনে চেনাজানা মনে হচ্ছিল। আমি সতর্কতা অবলম্বন করে মুখের উপর একটা কাপড় রেখে শুয়ে পড়লাম। শব্দগুলো ধীরে ধীরে নিকটে চলে আসছিল। মুখে ঢাকা কাপড়ের ফাঁক দিয়ে চেয়ে তাদের একজনের চেহারা দেখতে পেলাম। সেই লোকটা ছিল অ্যাডভোকেট সাহেবের সেই খুনি দলেরই একজন। ঠিক সেই মুহুর্তে আমি বুঝতে পেলাম, আমার সঙ্গে কত বড় একটা ষড়যন্ত্র খেলা হয়েছে। আমি বুঝতে পেলাম এই পৃথিবীতে আমার শেষ সময় এসে পড়েছে। ইহাই ছিল আমার পরিণাম। একজন খুনিকে সহায়তা করার পরিণাম।

আমি এই চিন্তা নিয়েই চিন্তিত অবস্থায় সেখানে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। ভাবছিলাম সেই মুহুর্তে কি এমন করা যায়। কিভাবে নিজেকে সেই পরিস্থিতি থেকে বাঁচানো যায়। আমি চাই না আমার মায়ের কোল খালি হতে। আমি চাই না এই অল্প বয়সে মৃত্যু। আমি শুধু কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে, সেখান থেকে বের হতে চাই। এসব চিন্তার মাঝে একবার চিন্তা করছিলাম, "কেননা তাদেরকে টাকার ব্যাগ দিয়ে দেয়া হোক?" কারণ খুব সম্ভবত অ্যাডভোকেট সাহেব তাদেরকে বলেছেন; আমাকে মেরে ফেলে, এই আঠারো কোটি টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে ফেলতে। কিন্তু আবার বিবেকে নাড়া দিলো। এত সহজেই হার মেনে নিবো? এত সহজেই সব কষ্ট বৃথা করে ফেলবো? মোটেও না। সংগ্রামী বীরপুরুষ আমি। আমি মরলে, আখরি বারের মতো লড়াই করেই মরবো। কিন্তু লড়াই করার যতো যথাযথ মাধ্যম খুঁজে পাচ্ছিলাম না, বা বলতে গেলে; একজন নিরীহ ব্যক্তি হয়ে, এতজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত খুনিদের কীভাবে পরাজয় করবো? এদেরকে মারতে হলে হয় আমার লাগবে আরো বড়ো মাপের জনশক্তি, নাহয় তাদের সকলকে একইসঙ্গে মারার কোনো বিশেষ উপায়। তৎকালীন সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পড়ল। এক শীতল সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন বাসায় বিদ্যুৎ ছিল না। অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে বললেন, কিছু মজার দেখাবেন। আমি খুবই আগ্রহের সঙ্গে, মনোযোগ সহকারে উনার সামনে গিয়ে বসে পড়লাম। আমাকে বলা হয়েছিল; একটা ব্যাটারি, দুই টুকরো বৈদ্যুতিক তার, একটি পানি ভরা পাত্র, এক বাটি লবণ, একটি ছোট্ট লাইট বাল্ব এবং দুটো সেফটি পিন। সেদিন উনি আমাকে একটি বৈদ্যুতিক সার্কিট বানিয়ে শেখালেন, তাও আবার পানির মধ্যে। সাধারণত পানির মধ্যে বিদ্যুৎ চলাচল করতে পারে না। কিন্তু লবণাক্ত পানিতে বিদ্যুৎ স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে। অ্যাডভোকেট সাহেবের সেই সার্কিটের শিক্ষা আজ তারই বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার সময় এসে পড়েছিল। কিন্তু তার আগে একটা কথা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি ছিল; এরা কি আমার পিছনে পিছনে এখান পর্যন্ত এসেছে, নাকি এরা আগে থেকেই জানতো, আমি কোথায় যেতে পারি। প্রথম ধারণাটি প্রথমদিকে সঠিক মনে হলেও, দ্বিতীয় ধারণাটি আরো বেশি যুক্তিসঙ্গত। কেননা আসার সময় স্টেশনে মানুষ খুবই কম ছিল। ট্রেনের ভিতর থেকেও যাত্রীদের শুধু নামতেই দেখেছি, ট্রেনে চড়তে কাউকেই দেখতে পাইনি। আমার মনে হচ্ছে, এরা নিজেদেরকে দলে দলে ভাগ করে এসব করছে। নাহলে তো শুধু একজন পরিচিত চেহারা দেখা যেত না।

এমন মুহূর্তে আমার উপস্থিত বুদ্ধি ছাড়া আর কিছুই কাজে আসবে না, সেটা আমি স্পষ্টকরে বুঝতে পেরেছিলাম। আমি সব ছেড়ে বৈদ্যুতিক সার্কিটের কথা মনে পড়ার একটি বিশেষ কারণ ছিল। অ্যাডভোকেট সাহেব সেদিন শুধু আমাকে লবণাক্ত পানিতে বৈদ্যুতিক প্রবাহের শিক্ষা দেননি, আমাকে আরেকটি বিশেষ তথ্য দিয়েছিলেন। সেদিন উনি আমাকে বলেছিলেন, "একজন ব্যক্তিকে মেরে ফেলার জন্য বিয়াল্লিশ ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক প্রবাহ যথেষ্ট।"
একজন খুনির মুখে এমন তথ্য পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
আমি ট্রেনে আসার পথে একটা মশা মারার রেকেট, তার ব্যাটারি এবং একটা হাতুড়ি নিয়ে যাচ্ছিলাম। আসার পথে মাকে ফোন করে জিজ্ঞাস করেছিলাম কিছু নিয়ে আসতে লাগবে কিনা। মা বলেছিলেন; একটা মশা মারার রেকেট, একটা নতুন হাতুড়ি এবং এক প্যাকেট লবণ। যে মা আমাকে জন্ম দিয়ে এই পৃথিবীতে এনেছিল, যে মা আমাকে জীবন দিয়েছিলেন, সেই মায়ের আদেশ পালনের কারণেই আজ আমার জীবন বাঁচানোর জন্য একটি পন্থা আমার হাতের নাগালে উপস্থিত রয়েছে। কিন্তু এমন এক পরিস্থিতিতে মনে একটি আশঙ্কা বিরাজমান রয়েছে। রয়েছে নীতি নৈতিকতার প্রভাব। নিজেকেই প্রশ্ন করে যাচ্ছিলাম, "এমনটা করা কি ঠিক হবে? কি নিজের জীবন বাঁচাতে অন্যের জীবন নেওয়া ঠিক হবে? যদি আমি প্রকৃতপক্ষে হত্যার বিরুদ্ধেই হয়ে থাকি, তবে আমি নিজেই বা কেন হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হতে যাবো?" একদিকে আমার মস্তিষ্ক আমাকে বাঁচার স্বার্থে মারার বুদ্ধি দিয়ে যাচ্ছিল, আর অপরদিকে আমার মন আমাকে অন্যের জীবন নেওয়ার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করছিল। মন এবং মস্তিষ্কের এই সংঘর্ষে শেষমেশ মস্তিষ্কই জয়লাভ করেছিল। কারণ মস্তিষ্কের এমন একটাই প্রশ্ন ছিল, যার উত্তর না পাওয়ায় মনের সকল যুক্তি বাতিল হয়ে গিয়েছিল। সেই মুহুর্তে আমি সিদ্ধান্তে এলাম; আমি বেঁচে গেলে একটি পরিবারের কল্যাণ হবে, কিন্তু তারা বেঁচে থাকলে আরো অসংখ্য পরিবারের ক্ষতি হবে। আজ যদি তারা বেঁচে, আমাকে মেরে, এই টাকা নিয়ে চলে যায়; তাহলে সেই অহংকারী লোকের অহংকারেরই জয় হবে। জয় হবে এমন এক মানুষের, যে মনে করে; পৃথিবীর সবই তার যুক্তির কাছে তুচ্ছ।
অ্যাডভোকেট সাহেব, আজ আমি বাঁচবো। শুধু নিজের ইচ্ছার খাতিরে নয়, আপনার চোখের সামনে থেকে পট্টি সরানোরও উদ্দেশ্যে।
মনে কিছু নিবেন না, অ্যাডভোকেট সাহেব। এবার আমি আর আপনার অধীনস্থ সেই চাকর নই। এই নতুন চিন্তাচেতনার উদ্ভাবন আপনিই ঘটিয়েছেন। এর সব দায়ভার একা আপনার। এর স্বাদ সর্বপ্রথম দিতে যাচ্ছি আপনার এই পোষা হায়েনাদের।
অতঃপর আমি কাজে লেগে পড়েছিলাম। আমার কাছে এক বোতল পানিও ছিল। পানির সঙ্গে সেই এক প্যাকেট লবণ মিশিয়ে নিলাম। সেই লবণাক্ত পানি নিচে মেঝেতে ছড়িয়ে, ফেলে দিলাম। লবণাক্ত পানি ছড়িয়েছিলাম শুধু আমার সিটের পাশের জায়গা পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিলাম, যেন আমার পায়ে স্পর্শ না করতে পারে। আমার কাছে যে মশা মারার রেকেটটা ছিল, সেটার উপরিভাগের প্লাস্টিক অংশটুকু হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে, তারগুলিকে বের করা নিলাম। এরপর এতে ব্যাটারি লাগিয়ে, নীচের দিকে মুখ করে দিয়ে, যেন তা লবণাক্ত পানিতে স্পর্শ করে। চালু করার সুইচটা রাখলাম আমার হাতের পাশে। আমার পরিকল্পনা অনুসারে, যেমনিই তারা আমাকে চিনতে পেরে আমার কাছে আসবে, ঠিক তেমনিই আমি সুইচ চেপে তাদের মেরে ফেলবো। এই আশায় সেখানে বসেছিলাম মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে, খুবই সুসপষ্টভাবে নিজের চেহারা দেখিয়ে। আমার শার্ট খুলে, রেকেটটা ঢেকে রেখেছিলাম। ঠিক আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পেয়ে, আমার কাছে হেঁটে আসছিল। আমি খুবই স্বাভাবিক ভাবে সেখানে বসেছিলাম। কাউকে না চেনার ভাণ করছিলাম। কিন্তু আমাকে দেখাতে তারা আমার দিকে আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে আসেনি। তাদের মধ্যে আমাকে চিনতে পেরেছিল শুধু সেই লোকটা, যাকে আমি সেই দল থেকে চিনতে পেরেছিলাম। লোকটা আমার কাছে এসে জিজ্ঞাস করলো, "এই! তুমি এই ট্রেনে কি করছো?"
"আমি তো আমার বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম।"
"ওঃ! তুমি আশেপাশে কোনো জুয়ান, সুন্দরী মেয়েকে দেখেছো?"
আমি শুনে খুবই অবাক হলাম। খুবই তাজ্জব করার মতো প্রশ্ন। আমি সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, "না তো! কেন?"
"উকিল সাহেব পাঠিয়েছেন ঐ মেয়েটাকে খুঁজতে। অনেক জরুরি।"
"কিসের জন্য? কি করেছে মেয়েটা?"
"মেয়েটার ফোনে একজন মক্কেলের বিরুদ্ধে কিছু গোপন তথ্য আছে। সেগুলো মেটাতে আমাদের পাঠিয়েছেন।"
"তথ্যগুলো মেটানোর পর আপনারা মেয়েটিকে কি করবেন?"
"উকিল সাহেব তো বলেছিলেন, চলতি ট্রেন থেকে ফেলে দিতে। সেটাই করবো।"
তখন বুঝতে পেলাম, এর জন্যই তারা ট্রেনে প্রথমবার আমার ঢাকা চেহারা দেখেও এড়িয়ে গিয়েছিল কেন। কেননা এদের তো উদ্দেশ্য কোনো পুরুষকে খোঁজার ছিলই না, ছিল তো সেই মেয়েকে খোঁজার।
কথাটা শুনে এক মুহূর্তের জন্য নিজের প্রাণের জন্য তৃপ্তি পেলেও, সেই মেয়েটির জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল। এরা সেই বেচারির সঙ্গে কি কি করার নিয়ত রেখেছে, তা একমাত্র আল্লাহ্ জানেন। কিছুক্ষণ আগেই যাদেরকে মেরে ফেলার জন্য নিজের মনকে রাজি করেছিলাম, তাদের মারার প্রতি আগ্রহ কমে গিয়েছে। ঠিক এভাবেই আমার মানসিক দুর্বলতা আমাকে কখনও জীবনে আগে বাড়তে দেয়নি। কারণ লক্ষ্য তো জীবনে অনেক ছিল, কিন্তু তা পূরণ করার মতো আত্মবিশ্বাস আমার মধ্যে আদৌ বিদ্যমান নেই।
কিন্তু একজন নিরীহ ব্যক্তি একই ট্রেনে উপস্থিত রয়েছে, তাও আবার একটি মেয়ে; শুনে আমার টনক নাড়া দিয়ে উঠল।
মনের ভেতর দিয়েই আওয়াজ আসলো, "আজ হয় এই মেয়েকে বাঁচাবো, নাহয় এর লজ্জায় মরে যাবো। যেমনিই হোক, তাকে যেকোনো অবস্থায় আজ বাঁচাতেই হবে।"
যেই ফাঁদ তৈরী করেছিলাম নিজের জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে, সেই ফাঁদ ব্যবহার করে এখন আরেকজনকে বাঁচানোর চেতনা মনের মধ্যে জেগে উঠল। তারা তখনও সেই স্থানেই দাঁড়িয়ে ছিল। এই সুযোগ দেখে, আমি রেকেটের সুইচ চাপ দেয়ার উদ্দেশ্যে হাত দিয়ে রেকেট কষে ধরলাম। ঠিক তখনই দেখি তাদের একজন বলে উঠল, "ওস্তাদ! মেয়েটাকে দেখতে পেলাম। ঐযে ওখানে।" বলেই ট্রেনের পেছনের দিকে দৌড় দিল। তার সহকর্মীরা তার পেছনে পেছনে দৌড় দিয়ে, মেয়েটার মুখ চেপে, ধরে নিয়ে আসলো। মেয়েটি ছোটার জন্য অনেক নাড়াচাড়া করছিল। মেয়েটির অবস্থা দেখে, তাদের উপর প্রচুর জিদ চড়ছিল আমার। মন চাচ্ছিল তাদের এখনই মেরে ফেলি। কিন্তু মেয়েটি তাদের সংস্পর্শে ছিল। তাই এমতাবস্থায় কিছু করলে, মেয়েটাও সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি কিছুক্ষণের জন্য চুপসে বসে রইলাম। তারা মেয়েটির ব্যাগের মধ্যে তার ফোন খুঁজছিল। সেই মুহুর্তে আমার চোখ পড়ল তার চেহারায়। খুবই মায়াবি চোখ ছিল মেয়েটার। এমন মায়াবি চোখ বিশিষ্ট মেয়েকে কেমন অযত্নে ধরে রেখেছিল তারা! দেখে তো তাদের প্রতি আমার ক্রোধ অত্যাধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েই যাচ্ছিল। তখন আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এলো। এমন বুদ্ধি মূলত আমার নয়। এ বুদ্ধি আমি শিখেছিলাম অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছ থেকে।
আমি প্রথমে আমার পরিচিত লোকটাকে ডেকে জিজ্ঞাস করলাম, "আচ্ছা ভাই, অ্যাডভোকেট সাহেব তো শুধু এর মোবাইল চান। শুধু ঐটা নিয়ে উনার কাছে পৌঁছে দিলে চলবে না?"
খুবই অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন, "মাথা ঠিক আছে তো? মেয়েকে এমনিই ছেড়ে দিলে তো সে সবাইকে সবকিছু বলে দিবে।"
"কিন্তু সে হঠাৎ করে গুম হয়ে গেলে, এর সন্দেহ তো সর্বপ্রথম অ্যাডভোকেট সাহেবের সেই মক্কেলের উপরেই আসবে। তো এখন আপনিই ভেবে দেখুন, কি করা উচিত।"
"উকিল সাহেব থাকতে চিন্তা কিসের? আমাদের কাজ তো শুধু উনার আদেশ পালন করা।"
"আরে ভাই, এটা কোনো কথা বললেন? উনিও তো একজন মানুষ, তাই না? ভুলত্রুটি তো উনার দ্বারাও হতে পারে।"
"কেমন ভুলত্রুটি?"
"এই যে, আপনারা এখন মেয়েটিকে মেরে ফেললেন, তারপর লম্বা তদন্ত হলো, জানা গেল যে মেয়েটা ট্রেনে করে যাচ্ছিল, ট্রেনে উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু নামেনি। এগুলোর বড়সড় তদন্তে ধরা পড়বে সেই মক্কেলটা, আর তার ঠিক পর আপনারা।"
"আমরা কেন? আমরা তো মক্কেলের আদেশে এগুলো করিনি।"
"ঠিক! কিন্তু মামলার তদন্তে অ্যাডভোকেট সাহেব আপনাদের সঙ্গে কথোপকথনের ব্যাপার যদি পুরোপুরি অস্বীকার করে দেন, তবে কি আদৌ কিছু করতে পারবেন? নিজের সঙ্গে উনার পরিচয় প্রমাণের কোনো উপায় আছে?"
আমার প্রশ্নটা শুনে লোকটা বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। তখনই আমি বুঝতে পারলাম, আরেকটু বারি দিলেই লোকটা পুরোপুরি মেনে নিবে। আমি আর সময় অপচয় না করে বললাম, "দেখুন। আপনার কোনো ধরনের উত্তর আইনের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই আমি বলছি, মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখতে। পরবর্তীতে একে পাগল প্রমাণ করে, মামলাটা অন্যভাবে জিতা সম্ভব হবে।"
লোকটা কিছুক্ষণ ভেবে, আমার দিকে চেয়ে, হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে, বললো, "হুম! তোমার কথায় যুক্তি আছে। এই মেয়েকে এত সহজে মেরে ফেলাটা বোকামি হবে।"
আমি মুচকি হেসে বললাম, "তাহলে মেয়েটিকে আমার সিটের পাশে বসিয়ে দেন। আমি তাকে পাহারা দেই।"
"কিন্তু তার মুখ ছেড়ে দিলে তো সে চিৎকার মেরে উঠবে।"
আমি বাম হাত আগে করে, ইশারার মাধ্যমে, আমার পাশের লোকটার চাকু চেলাম। সে আমার ইশারা বুঝতে পেরে, আমার হাতে চাকুটা দিল। আমি সেই চাকু হাতে নিয়ে বললাম, "সে চিৎকার করলে, আমি তার গলায় আঘাত করবো। চিন্তার কোনো বিষয় নেই।"
"কিন্তু তাকে তো মেরে ফেলা যাবে না।"
"গলায় আঘাত করবো তার কণ্ঠনালীতে। তাহলে সে অন্তত চিৎকার দিতে পারবে না। বাকিটা পথ তার রক্তঝরা স্থানে চাপ দিয়ে নিয়ে গেলে, সে নিঃসন্দেহে বেঁচে যাবে।"
"পরে তার চিকিৎসা করতে গেলে কি বলবো?"
"বলবো, এই পাগল মেয়েটা নিজের কণ্ঠনালী কেটে ফেলেছে।"
"হা হা হা! বেশ! বড়ই চতুর একজন ব্যক্তি তুমি।"
"হা হা হা! সব অ্যাডভোকেট সাহেবেরই শিক্ষা।" বলে আমি মেয়েটাকে আমার পাশে এনে বসালাম। ভয়ে তার শরীর কাঁপছিল। আর একটা মুহূর্তও অপচয় করার মতো ছিল না। আমি মেয়েটার কানের কাছে গিয়ে, ফিসফিস করে বললাম, "বাঁচতে চাইলে পা দুটো মেঝে থেকে উপরে তুলে নাও।" এটা বলেই চোখ মারলাম। মেয়েটি আমার ইশারা বুঝতে পেরে, পা দুটো তুলে, সিটের উপর বসে পড়ল। আমার পা দুটো আগ থেকেই কাঠের সিটের উপরে ছিল। তার পা দুটো ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি সুইচে চাপ দিয়ে দিলাম। আর প্রায় তিন থেকে চার মিনিট শুধু তাদেরকে এই বৈদ্যুতিক ঝটকা দিতে থাকলাম। যেই হত্যাকারীরা এতদিন অন্য মানুষদের হত্যা করে বেড়াতো, তারাই সেদিন আমার হাতে হত্যা হলো। কিন্তু এ দৃশ্য দেখে আমার পাশে বসা মেয়েটা অত্যাধিক মাত্রায় ঘাবড়ে গিয়েছিল। ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। হত্যা তো এমন কিছু না, যা একজন সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত দেখে থাকে। তার আতঙ্কিত চেহারা দেখে আমার নিজেরও খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু আবার মেঝেতে তাকিয়ে ভাবলাম, কিছু বলা উচিত। বেচারি এখন চমকে আছে। কিছু বললে হয়তোবা আতঙ্ক কিছুটা কমবে।
মন চাচ্ছিলো, সারাটা পথ তার চোখে তাকিয়েই কাটিয়ে দেই। কিন্তু পায়ের ঠিক সামনে যখন তিনটা তাজা লাশ পড়ে থাকে, তখন এসব আবেগ কতটা ক্ষণস্থায়ী হতে পারে তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
মেয়েটা বেশ সাহসী এবং নিষ্ঠুর ছিল। এই দুটি চরিত্র একে অপরের চাইতে এতটাই ভিন্ন যে এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া যার মধ্যে উভয় গুণ বিদ্যমান একপ্রকার অসম্ভব কাজ। খুবই সচরাচর হয় এমন প্রকৃতির স্ত্রীলোক। একটি স্ত্রীলোকের ব্যপারে ভাবতে গেলে সবচেয়ে প্রথমে মনে পড়ে যায় নিজের জীবনে উপস্থিত যত মহিলা আছে, তাদের কথা। তার মধ্যে সর্বপ্রথমেই মায়ের কথা মনে পড়ে, তারপর বোন, তারপর প্রেমিকা, তারপর পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যদের। কিছু কিছু মানুষের কাছে ধারাটা একটু ভিন্ন হলেও, আমার জীবনে যে সকল নারী রয়েছে, তাদের প্রাধান্য এভাবেই দিয়ে থাকি, এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই।
মেয়েটি মোটেও তাদের কারো কাতারে পরে না। মেয়েটা ছিল আমার জীবনে দেখা অদ্বিতীয় এবং তুলনাহীন।
মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে নিজের অশ্রু মোছার পর আমায় জিজ্ঞাস করে উঠল,
"আমাকে বাঁচানোর পেছনে আপনার উদ্দেশ্য জানতে পারি?"
"এখানে আমার নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য নেই।"
"তাহলে, কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই নিজের সুপরিচিত লোকদের মৃত্যুর ঘাট নামিয়ে দিলেন?"
মেয়েটার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন ছিল। কারণ ছোট করে বলে দিলে, আমার সঙ্গে ঘটা বাকি সব ঘটনাই তাকে বলতে হবে। আর যদি ভাল করে বুঝিয়ে বলতে যাই, তাহলে মনে করতে পারে আমি নিজের প্রতিশোধের জন্য তাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছি। তাই মেয়েটার উত্তরের বেলায় অ্যাডভোকেট সাহেবের শেখানো একটা চালাকি খাটিয়ে বললাম,
"কি পৃথিবীর প্রত্যেক কাজের পেছনে কোনো উদ্দেশ্য থাকা জরুরি? কি একজন নারীকে কিছু কেনা গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচানো এতটাই অস্বাভাবিক একটা কাজ?"
মেয়েটা আমার উত্তরে যে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো, তার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। সে জিজ্ঞাস করলো,
"আপনি বোধহয় আমার প্রশ্ন ঠিকমতো বুঝতে পারেননি। আমি আপনার লক্ষ কি ছিল, তা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তারা শুধু যেকোনো গুণ্ডার দল ছিল না। তাদের সঙ্গে আপনার পূর্বের পরিচয় ছিল। তারা যার জন্য কাজ করতো, আপনি তাকেও জানেন। আর আপনাদের মধ্যে তো সম্পর্কও যথেষ্ট ভাল। তাহলে কি শুধু আমার মতো একজন অচেনা ও অপরিচিত কাউকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলেন?"
কিছুক্ষণ থমকে দাড়িয়ে থাকার পর পাল্টা প্রশ্ন করলাম,
"আপনি কি আমাকে আদৌ বিশ্বাস করতে পারবেন, যদি আমি বলি, হ্যাঁ?"
"করতেও পারি, কিন্তু না করার সম্ভাবনাও সমান মাত্রায় রয়েছে।"
"সেক্ষেত্রে আমি আপনাকে সেই কথাই বলবো যা ছোটবেলায় আমার দাদুকে টানা প্রশ্ন করে গেলে একসময় উত্যক্ত হয়ে বলতেন।"
"কি বলতেন আপনার দাদু?"
"জীবনে প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর হয় না। আর প্রত্যেক প্রশ্নের উত্তর সবার জানা থাকেও না। একটা প্রশ্নের উত্তর বের করতেই যদি সারাজীবন নষ্ট করে ফেলি, তাহলে জীবনে কখনওই আগে বাড়া সম্ভব না। সারাজীবন ঐ প্রশ্নের মধ্যেই আটকে থাকতে হবে।"
"বাহ্! খুব দারুণ। আপনার দাদু বেশ বুদ্ধিমান ছিলেন।"
"জানি। ধন্যবাদ।"
"কিন্তু আমার প্রশ্নটা কি আসলেই আপনার জন্য এতটাই জটিল, যে এক্ষেত্রে আপনি এই উক্তিটি ব্যবহার করলেন?"
"ব্যাপারটা ঠিক তা না।"
"তাহলে কি?"
"আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না, কিন্তু আমার এসব করার পেছনে কারণ বোঝার মতো ক্ষমতা মনে হয় না আর কারো মধ্যে আছে। তাই আপনাকে উত্তর না দেয়ার ফলে আমি আপনারই কষ্ট কমাচ্ছি।"
এতটা কথা বলার মধ্যে যেন মেঝেতে পড়ে থাকা লাশগুলোর কথা মনেই ছিল না। মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটাকে বললাম, "এই দেহগুলি এখানে পড়ে থাকলে সমস্যা হতে পারে। কেউ এসে দেখার আগে এদের কিছু ব্যবস্থা নেয়া উচিত।"
"জি।"
মেয়েটা নিজেকে অনেক শান্তভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। তার এমন পরিস্থিতির মধ্যে এত হালকা থাকাটা আমার জন্যই বেশ সুবিধার হলেও, মনের কোনো এক অংশ চাচ্ছিল তাকে একটু নিরীহ অবস্থায় দেখতে। জীবনে অনেক সিনেমার মধ্যে দেখেছি একটা মেয়ে কীভাবে একটা ছেলের উপর নির্ভর করে থাকে। সেখানে দেখায়; কীভাবে একটা অসহায় মেয়েকে তার বিপদের সময় আশ্রয় দিয়ে, তার চোখে অতুলনীয় এক সত্তা হয়ে উঠে।
আমারও ইচ্ছে ছিল, কোনো মেয়ের কাছে এতটাই অতুলনীয় হয়ে উঠা, যে সে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমায় ছাড়া কাউকে ভালবাসার চিন্তাও করতে পারবে না। কিন্তু আজ এই সুযোগ পাওয়ার মতো সকল পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও, তা হচ্ছে না। কারণ মেয়েটা সেই সিনেমার নায়িকাদের মতো কোমল ফুলের পাপড়ি নয়। এই মেয়েটা জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন একজন নারী।
মেয়েটিকে নিয়ে এই চিন্তায় মাতাল ছিলাম, এমতাবস্থায় মেয়েটি বলে উঠল, "তো... কি ব্যবস্থা নেয়া যায়, কিছু পেলেন?"
আমি হালকা একটু থতমত খেয়ে বললাম, "জি, পেয়েছি।"
"কি করতে হবে, বলেন?"
"আপনি একটা কাজ করেন। আপনি একটু উঁকি দিয়ে এক ঝলক দেখে আসেন, কেউ আসছে কি না। আর তারপর আবার সামনের দিকে এগিয়ে দেখে আসেন, ওখানে কোনো যাত্রী উপস্থিত আছে কি না।"
"আচ্ছা, আপনি এতক্ষণ কি করবেন?"
"আমি লাশগুলো আলাদা করে সাজাবো, যাতে কেউ এসে দেখলেও যেন মনে হয়, মদ খেয়ে টাল হয়ে পড়ে আছে।"
"ঠিক আছে। আমি ঝটপট গিয়ে দেখে আসি।"
"ঠিক আছে। সাবধানে যান।"
মেয়েটা উভয় পাশে দেখে এসে আমাকে বললো, "পেছনের দিকে যেগুলো যাত্রী আছে, তার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আর সামনের দিকে শুধু দুজন বৃদ্ধ অন্ধ লোক বসে আছে। খুব সম্ভবত বিবাহিত।"
"তারা অন্ধ, এটা বুঝলেন কি করে?"
"চোখে অন্ধদের মতোই কালো চশমা পড়ে ছিল এবং চলার লাঠিও পাশে রাখা ছিল।"
"তারা কি ঘুমিয়ে পড়েছে, নাকি সজাগ আছে?"
"তারা একসঙ্গে গল্প করছে।"
কিছুক্ষণ ভেবে দেখলাম, অন্ধদের শ্রবণশক্তি সাধারণ মানুষদের চেয়ে ভাল হয়ে থাকে। কারণ চোখের পরেই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ইন্দ্রিয় হলো কান। তাই এমন ভারি ভারি লাশ তাদের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া অনেকটা কঠিন হবে। এমন কিছু করতে হবে যা তাদের কান ব্যস্ত রাখতে পারবে। তখনই মাথায় বুদ্ধি এলো।
"আচ্ছা, তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য আপনাকেই কিছু করতে হবে।"
মেয়েটি অনেকটা চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞাস করলো, "মানে? বুঝতে পারলাম না!"
"মানে হলো, আপনাকে কিছুক্ষণের জন্য তাদের ধ্যান অন্যদিকে এড়াতে হবে।"
"তা কীভাবে করা যাবে?"
"আপনি গান গাইতে পারেন?"
"জি, কিছুটা পারি। কিন্তু কন্ঠ তেমন ভাল না।"
"একটা গান শোনান তো দেখি।"
ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলো, "আপনার উদ্দেশ্যটা একটু বোঝাবেন?"
"আপনি এতক্ষণ যা কিছু দেখলেন, তারপরও আপনার সন্দেহ হচ্ছে?"
"সন্দেহ না করি কি করে, আপনিই বলেন?"
"আচ্ছা, তাহলে এরা এখানে, এভাবেই পড়ে থাক। তাহলে চলবে?" বলে উঠলাম রাগান্বিত স্বরে।
"রাগ করছেন কেন? এমন একটা সময়ে আমাকে গান গেয়ে শোনাতে বলছেন! আমাকে অন্তত কারণটা তো বলবেন?"
"আমি তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য আপনার কন্ঠ ব্যবহার করব যাতে তারা এই লাশগুলো ঘষে ঘষে নিয়ে যাবার কোনো আওয়াজের দিকে তাদের ধ্যান না যায়। তাই আপনাকে দিয়ে তাদেরকে গান শোনাবার কথা ভাবছি।"
"আপনি কি নিশ্চিত, এই বুদ্ধিটা কাজ করবে?"
"আপনার কাছে এর চাইতে ভাল কোনো বিকল্প থাকলে অবশ্যই বলুন।"
"আমার কাছে কোনো বিকল্প নেই।"
"তাহলে যেমন বলছি, তেমনটা করেন।"
"ঠিক আছে।" বলে নিজের মধুর কন্ঠে একটি গান শোনাল। তার কন্ঠে এক আলাদাই মাধুর্য ছিল। গানের সুর কিছুটা এদিক-সেদিক হলেও, কণ্ঠটা সেই ফাঁকা স্থানটুকু পূরণ করে দেয়। মেয়েটা তো নিজের কন্ঠকে দোষারোপ করছিল। কিন্তু তার কন্ঠই তার গান সহ্য করবার যোগ্য করে তুলে। মেয়েটা এমন সুন্দর কন্ঠের অধিকারী না হয়ে থাকলে, তাকে দিয়ে এই কাজটা করানো কোনোভাবেই যৌক্তিক হতো না।
তার গান গাওয়ার শেষে তাকে বললাম, "এবার এভাবে করেই তাদের সামনে গিয়ে একটা গান গেয়ে শোনাতে থাকেন। আর তখন পর্যন্ত থামবেন না, যখন পর্যন্ত আমি সবগুলো লাশ বাহিরে ফেলে না দেই। বুঝতে পেরেছেন?"
"জি, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তারা আমার গান শুনতে রাজি হবেই বা কেন?"
"তাদের কাছে বেশি একটা উপায় নেই। আপনি তাদের কানের পাশে, গলা ফাটিয়ে, চিৎকার মারলেও তাদের করার কিছুই নেই।"
"এ কেমন কথা বললেন?"
"কেমন কথা, মানে?"
"এমনি গিয়ে হুট করে গাওয়া শুরু করে দিব! তারা কি না কি ভাববে আমার ব্যপারে!"
"তাহলে গিয়ে এমন কিছু করেন যাতে তারাই আপনার গান শোনাবার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে। আর তা না পারলে জোর করে গান শোনাতে থাকবেন।"
"আচ্ছা, আমি চেষ্টা করে দেখি।"
মেয়েটার মাথায় এমন সময়ও একই কথা চলছে; "লোকে কি বলবে?" কিই বা বলবে ওরা? কিই বা ভাববে? তাদের সঙ্গে তো আর জীবনে দেখাও হবে না। এটাই প্রথম এবং এটাই শেষ দেখা। তাহলে তাদের মন্তব্য নিয়ে এত চিন্তিত হবার কি আছে এমন?
আসলে, এটা মূলত একটা মানসিক সমস্যা। ছোটবেলা থেকে যদি অন্যের মন্তব্যকে শ্রেয় ভাবার শিক্ষা না দেওয়া হতো, তাহলে আজ এই অবস্থা হতো না।
মেয়েটা যাওয়ার সময় হঠাৎ করে মাঝপথে থেমে গেল। থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলো, "আচ্ছা, যদি কোনোভাবে আমার গান গাওয়ার মধ্যে দিয়েও তারা এই লাশগুলো ঘষে নিয়ে যাবার শব্দ শুনতে পারে, তাহলে কি করবেন?"
আমি এমন এক উত্তর দিলাম যার জন্য আমি নিজেই প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু আমি ছিলাম পরিস্থিতির শিকার। খুবই অসহায় অবস্থায় থেকেই একজন এমন কঠোর একটা কথা বলতে পারে।
আমি উত্তরে আমার পাশে রাখা চাকুটা হাতে তুলে বললাম, "এই চাকুটা দেখতে পারছেন? তারা কোনোভাবে টের পেয়ে থাকলে, তাদের সেখানেই মেরে ফেলব।"
মেয়েটা চোখ বড় করে তাকিয়ে বললো, "এসব কি বকছেন? পাগল হয়ে গিয়েছেন নাকি?"
"এতে পাগল হবার কি আছে?"
"আপনি দুজন নিরীহ অন্ধ লোককে খুন করে ফেলবেন!"
"আপনি তাদের ধ্যান এড়াতে সক্ষম না হলে এটা করতেই হবে। নাহলে তারা প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে আমাদের বিপরীতে সাক্ষী দিতে পারবে আর আদালত আমাদের ফাঁসিতে চড়িয়ে দিবে।"
"এর জন্য এত নীচ একটা কাজ করতে পারবেন?"
"কিছুক্ষণ আগেও আমরা একটা নীচ কাজ করে উঠেছি। একই কাজ আবার করাতে সমস্যাটা কি?"
"আপনি আমাকে কথা দেন যে আপনি তাদের কোনো ক্ষতি করবেন না।" বলে হাত পেতে আমাকে বলছিল, "এখনই চাকুটা আমার কাছে দেন।"
"দেখেন, আমি এসব শখ করে করছি না। যেমন আপনার এসব কষ্ট হচ্ছে, তেমন আমারও এসব বলতে ভাল লাগছে না।"
"তাহলে কেন এমন করছেন?"
"আমি নিরাপত্তার সঙ্গে বাড়িতে ফিরতে চাই। সেখানে আমার পরিবার অপেক্ষা করছে। তাদের জন্য এতগুলো টাকা নিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে এমন কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার অনেক কারণ আছে। আমার অনেক স্বপ্ন আছে, অনেক ইচ্ছা আছে যা পূরণ করতে হবে। হতে পারে আপনার কাছে দুজন বৃদ্ধ, অন্ধ লোকের জীবনের তুলনায় এসব কিছুই না। কিন্তু আমার বাকিটা জীবন নির্ভর করছে এই একটা কঠিন সিদ্ধান্তের উপর।"
"আপনার কিছু স্বপ্ন আছে বলে আপনি দুজন নিষ্পাপ ব্যক্তির হত্যা করে ফেলবেন?"
"কিছুক্ষণ আগে একজন নিষ্পাপ ব্যক্তির জীবন বাঁচালাম তিনজন পাপী ব্যক্তির জীবন নিয়ে। তার ঠিক কিছুক্ষণ পর সেই নিষ্পাপ ব্যক্তি একজনের গলায় পারা দিয়ে একটা পার করে বসল। আর এখন সেই পাপী ব্যক্তি আমাকে জেরা করছে।" এটা বলার পর কিছুক্ষণ নীরব ছিলাম। তারপর আরো বললাম, "আপনি যদি আসলেই চেয়ে থাকেন, তাদের কোনো ক্ষতি না হোক, তাহলে তাদের ধ্যান এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। তারা টের না পেলেই বেঁচে থাকতে পারবে। তাই নিজের কাজ ঠিকমতো করেন। আর আমাকে আমার কাজ করতে দেন।"

এ বলার পর মেয়েটা কোনো উত্তর না দিয়েই তাদের ধ্যান এড়াতে চলে গেল।

Comments