আমি হলাম রাফি। পুরো নাম; রাফি আল মাহমুদ। বয়স তেইশ বছরের কাছাকাছি। কিছু মাস হলো যশোরের বাড়ি ছেড়ে ঢাকা শহরে আসার।
আমার ঢাকায় আসার গল্প ছিল কিছু এইরকম;
এসে গুলিস্থান থেকে আরেকটি বাস ধরে সোজা গেলাম নদীর ওপার কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন নামের স্থানে। এখনও মনে আছে, সেদিন বাসের মধ্যে দুজন বেশ শিক্ষিত যুবক যাচ্ছিল আমার ঠিক সামনের সিটে বসে। সেই দুজন কোন এক সিনেমা দেখার জন্য নাকি টিকেট কিনে আনল। তাদের মধ্যে একজন টিকেট নিয়ে টানাটানি করাতে আরেকজন চিৎকার করে উঠেছিল, "এমন করিস না তো! ছিড়ে গেলে ছয় শত টাকা পানিতে।" এই কথাটা শোনার পর এই শহরের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা হয়ে গেল। আমি সেই বাসের সিটে বসে হিসাব নিকাশে লেগে পড়লাম। মা আগেই বলেছিল, ঢাকা কিন্তু যশোরের মতো না। তাও আমি কোনোভাবেই বুঝতে পারছিলাম না, কীভাবে করে কেউ ছয় শত টাকা দিয়ে একটা চলচ্চিত্র দেখতে যায়। অদ্ভুত ব্যাপার লাগল আমার কাছে! বেশ অদ্ভুত! এই হিসাব নিকাশ করতে করতে পৌঁছে গেলাম কেরানীগঞ্জ। বাড়ির ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে মাথায় সেই একই হিসাব নিকাশ চলছিল। সেই এলাকার এক মুদি দোকানিকে অ্যাডভোকেট সাহেবের বাসার ঠিকানা জিজ্ঞাস করাতে চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে, স্পষ্টভাবে পথ দেখিয়ে দিল। আমি সেই অনুযায়ী চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম সেই ঠিকানায়। বাড়ির দরজায় ঠকঠক করায় একজন বেশ বৃদ্ধ লোক দরজা খুললেন। উনার চেহারা দেখে বয়স প্রায় সত্তর-পঁচাত্তর মনে হচ্ছিল। লোকটা আমার দিকে কিছুক্ষণ ভাল করে তাকিয়ে বললেন, "যশোর থেকে এসেছেন নাকি?"
"হ্যাঁ।"
“নাম কি?"
"জি, রাফি।"
"হুম! ভেতরে আসো।"
আমি ভেতরে প্রবেশ করার সাথে সাথে আমার কাঁধের ব্যাগটা রেখে, জুতো জোড়া খুলে, জুতোর তাকের উপর রাখার সময় কিছু অদ্ভুত খেয়াল করলাম। এত বিশাল বাড়ির মালিক হবার পরও তাকের মধ্যে অ্যাডভোকেট সাহেবের একটা জুতোও দেখতে পারছিলাম না। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ সেখানেই তাকিয়ে ছিলাম। আমার এইভাবে মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকা অবস্থা দেখে সেই বৃদ্ধ লোকটা খিটখিটে স্বরে বললেন, "কি হলো? এভাবে হা করে কি দেখছ?" আমি চমকে উঠলাম এবং তৎকালীন সময়ে উত্তর স্বরূপ বললাম, "জি, কিছু না।" তারপর একটু সামান্য নীরবতার পর জিজ্ঞাস করলাম, "আচ্ছা, অ্যাডভোকেট সাহেব কি বাসায় নেই?"
বৃদ্ধ লোকটি আমার প্রশ্নটা শুনে কেমন বিস্মিত হয়ে আমার চেহারার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলেন, "তুমি কি সেই খালি জুতোর তাক দেখে এই প্রশ্নটা করেছ, বাবা?" লোকটার কথার মধ্যে কেমন এক আজব ভাবভঙ্গি লক্ষ করলাম। প্রশ্নটা করা বোধহয় আমার অপরাধ হয়েছে। তবুও জানার কৌতুহোলের কারণে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, "জি!"
বৃদ্ধ লোকটা এক মুচকি হাসি দিয়ে চুপচাপ বাসার ভেতরের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। আমি এই আচরণটা দেখে খুবই অবাক হলাম। কিন্তু কোন কিছু না বলেই উনার পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগলাম। বাসাটা বাহির থেকেই এত বিশাল, ভেতর দিয়ে তো আরো বিশাল জায়গা রয়েছে। এখানে প্রতিদিন কমপক্ষে দশ বার হাঁটাহাটি করলেও একজন ডায়াবেটিস রোগীর আর কোনো চিন্তাই থাকবে না। তবে জমিনের দিকে তাকালে দেখতে পাই খুবই লম্বা লম্বা দুটো রেখা যা পরস্পরের চেয়ে সমান রয়েছে। দাগগুলো দেখতে অনেকটা সাইকেলের চাকার দাগের মতো। কিন্তু প্রশ্নের বিষয় হলো, বাসার ভিতরে দুটো সাইকেল কে চালাবে?
এই কথা চিন্তা করতেই না করতে এসে হাজির হলাম অ্যাডভোকেট সাহেবের সামনে, আর উনাকে দেখার পরে আমার মনে তৎকালীন জাগ্রত সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম।
অ্যাডভোকেট সাহেব দুটো হাত দুপাশে ছড়িয়ে, রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে রয়েছেন। উনি বসেছিলেন একটি হুইলচেয়ারে। উনার পা এর দিকে তাকিয়ে অনুমান করলাম, এটা নিশ্চয়ই কোনো দুর্ঘটনার ফল। কেননা জন্মগত পা না থাকা লোকের পায়ের গঠন কিছুটা ভিন্ন হয়। রুমে প্রবেশ করার আগেই অ্যাডভোকেট সাহেব আমাদেরকে হাত দিয়ে ইশারা করে, থেমে যেতে বললেন। তারপর সেই বৃদ্ধ লোককে উদ্দেশ্য করে আরেকটি অদ্ভুত ইশারা করলেন। ইশারা দেখে খুবই অবাক হলাম, কিন্তু কিছু জিজ্ঞাস করার সাহস পেলাম না। ইশারা পেয়ে, কোনো কথা না বলেই, চুপচাপ সেই বৃদ্ধ লোকটা আমাকে নিয়ে গেল বাথরুমের কাছে। সেখানে আমাকে বললেন, "তুমি মাত্র এত বড় একটা সফর কেটে এসেছ, তাই উকিলবাবু তোমার সঙ্গে এই অবস্থায় দেখা করবে না। উনি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন। তাই তোমাকে আগে গোসল করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে।" এটা শোনার পর কিছুক্ষণ অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। অতঃপর উনি জিজ্ঞাস করলেন, "কি হলো বাবা? কি চিন্তা করছ? বুঝতে পারনি আমার কথা?" আমি সাথেসাথে নাবোধকভাবে মাথা নাড়িয়ে বললাম, "না! বুঝতে পেরেছি।" এরপর গোসল করে, কিছুক্ষণের মধ্যে অ্যাডভোকেট সাহেবের সামনে উপস্থিত হলাম। উনার রুমের বাহির থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম, উনি একটা পুরাণ আমলের সাদাকালো চলচ্চিত্র দেখছেন। ছবির মান দেখে তো মনে হচ্ছিল, সিনেমাটির বয়স প্রায় সত্তর বছর তো হবেই। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব ইশারা করে আমাকে কাছে ডাকলেন। কাছে যাওয়াতে আবার ইশারা করে আমাকে উনার বাম পাশের সোফায় বসতে বললেন। সোফাটা দেখতে সামান্য সোফার মতো হলেও, বসার সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছিল আমি বাতাসের উপর বসে আছি। সোফাটার দামও নিশ্চয়ই তেমন মোটা অংকেরই হবে। অ্যাডভোকেট সাহেব ইশারা করে কাছে তো ডাকলেন ঠিকই, কিন্তু চুপচাপ টেলিভিশনের বিশাল পর্দার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। উনি এখন পর্যন্ত আমার চেহারা দেখেছেন কি না, সন্দেহ। অবশ্য, আমরা উভয়ই একে অপরের চেহারা দেখেছিলাম ছবির মাধ্যমে। ছবিতে অ্যাডভোকেট সাহেবের দেহের উপরিভাগটুকুই দেখা যাচ্ছিল, তাই কল্পনাও করতে পারিনি এমন কিছু দেখব। উনি তৎকালীন যে সিনেমাটা দেখছিলেন, সেটার মধ্যে খুবই অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলাম। সেখানে দেখলাম; একজন অত্যন্ত লম্বা ব্যক্তি খুবই আজব ভঙ্গিতে হাঁটছিল আর সেটা দেখতে আশেপাশের সবাই আতঙ্কে পালাচ্ছিল। সেখানে আরও দেখলাম; একজন চিকন মহিলা, দেখতে খুবই উদ্ভট, চুল উঁচু করে দাঁড়া করানো, সেই চুলের দুই পাশের দুটো অংশ সাদা। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ হাস্যকর মনে হলো বলে মুখ থেকে অল্প একটু হাসি বেড়িয়ে গেল। সেই মুহূর্তে নিজেকে থামাতে পারিনি। তবে মুখে চাপ দিয়ে হাসি থামানোর চেষ্টা করেছিলাম ঠিকই।
সিনেমা দেখা শেষ হবার পর টেলিভিশন বন্ধ করে আমাকে ইশারা করে দাঁড়াতে বললেন। আমি চুপচাপ দাড়িয়ে রয়ে গেলাম। অতঃপর একটু কাশি দিয়ে, গলা পরিষ্কার করাতে এই প্রথম উনার কন্ঠ শুনতে পেলাম। কি স্বর ছিল সেই কন্ঠের! সেই একটুকু শুনেই সিংহের গর্জনের কথা মনে পড়ে গেল। বাবা আসার আগেই বলেছিল উনার তুখোড় কণ্ঠস্বরের ব্যাপারে। বলেছিলেন, "অ্যাডভোকেট সাহেব যখন বিতর্কে নামেন, তখন যুক্তিও কান পেতে শুনে। আর উনার দক্ষতা এতটাই, যে চাঁদও যদি সূর্যের বিরুদ্ধে চুরি করা আলোর দাবি করে আদালতে মামলা করে, আর সেই মামলা যদি অ্যাডভোকেট সাহেব লড়েন, তাহলে সেই মামলাও অ্যাডভোকেট সাহেব মূহুর্তের মধ্যে জিতে যাবেন আর সূর্য নিজের আলো চাঁদকে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হবে।" বাবার কথাগুলো তখন তো বেশ হাস্যকর মনে হচ্ছিল, কিন্তু আজ সেই কথাগুলোই সত্য বলে মনে হচ্ছে। অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে প্রায় দশ মিনিটের মতো সেখানে দাঁড়া করিয়ে রাখাতে আমি আর সহ্য করতে না পেরে, হঠাৎ জিজ্ঞাস করে বসলাম, "অ্যাডভোকেট সাহেব, সারাদিন কি এভাবেই দাড়িয়ে থাকবো?" আমার প্রশ্নটি শুনে, মুখে এক মুচকি হাসির সঙ্গে বললেন, "খুবই অবাক করার মতো বিষয়, তাই না? কেউ দশ মিনিটও দাড়িয়ে থাকা সহ্য করতে পারে না, আর কেউ দশ বছরেরও বেশি সময় যাবত বসেই আছে। আমারও একসময় এই দাড়িয়ে থাকাটা বেশ বিরক্তিকর লাগত, কিন্তু এখন সেই বিরক্তি যেমন এক চাহিদায় পরিণত হয়েছে। উনার এই কথাগুলো শুনে, পুরোপুরিই নীরব হয়ে গিয়েছিলাম।
কিছু সেকেন্ডের সামান্য বিরতির পর হঠাৎ একজন কবির মতো করে, কবিতা আবৃত্তি শুরু করে বলতে লাগলেন, "অদ্ভুত এই অনুভূতি, অদ্ভুত এই বিরক্তি, অদ্ভুত এই জগৎ!
অদ্ভুত নদ-নদী, অদ্ভুত এই মানবজাতি, অদ্ভুত পাহাড় পর্বত।"
সেই লাইনগুলি অন্য কেউ আবৃত্তি করে থাকলে এতো মর্মান্তিক অনুভূতি কখনওই অনুভব করতে পারতাম না। শুধু উনি বলেই; সেই কন্ঠের ভার, সেই বলার রাজকীয় ভঙ্গি, সেই নিখুঁত উপস্থাপনা। এ সকল কিছুর একটির উপস্থিতিও না থাকলে, খুব একটা আবেগাপ্লুত হতাম না, কিন্তু এই সকল উপাদান আমাকে সেসময়ে বাধ্য করেছিল।
এ বিষয়ে কথা যেহেতু শুরু হয়েই গেল, তখন আর চুপ থেকে তো লাভ নেই। তাই সাহস করে জিজ্ঞাস করে উঠলাম, "জি, আপনার পায়ের এই দুর্দশা হলো কি করে?"
আবার একটি মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "খুশিতে। অতিরিক্ত মাত্রার খুশিতে।"
শুনে অবাক হলাম। সাথে সাথে আবার জিজ্ঞাস করলাম, "কি?"
"কাহিনীটা বেশ বড়। শুনতে হলে অধিক পরিমাণের মনোযোগের প্রয়োজন হবে। পারবে তো?"
"জি! অবশ্যই!"
"ঘটনাটি এখন থেকে প্রায় বারো বছর আগের। গ্র্যাজুয়েশন পার করে মাত্র আইনজীবী হলাম। সেই উপলক্ষে আমি এবং আর ল কলেজের সহপাঠীরা সবাই মিলে রাতে পার্টি করছিলাম। দারুণ মজা হচ্ছিল। যে মেয়েটাকে পছন্দ করলাম, তারই সঙ্গে সারাটা রাত নাচলাম। মেয়েটার নাম ছিল মারজিয়া।"
"বাহ! কি সৌভাগ্য আপনার!"
"হূ!"
"মেয়েটাকে আপনার মনের কথা বলেননি?"
"বলেছিলাম। সে বলছিল, সেও নাকি আমাকে অনেক আগ থেকেই পছন্দ করত।"
একটা মুচকি হাসি দিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "তারপর কি হয়েছিল?"
উনি ও একটা মুচকি হাসি দিয়ে আবার বলতে লাগলেন, "হায়, কি পরিমাণের মদ পান করলাম না সেই রাত! আহাহা! বলার বাইরে! নেশাও চড়েছিল প্রচুর পরিমাণের।"
"আপনি মদও খান?"
উনি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালেন।
আমি জিজ্ঞাস করলাম, "তারপর কি হয়েছিল?"
"তারপর আর কি হবার? যা কপালে ছিল, সেটাই হলো। মারজিয়ার সঙ্গে তিনটা ঘণ্টার মতো নাচার পরে বাসার জন্য বেল হলাম। সেই নাচটা কখনওই ভোলার মতো না রে! জীবনের শেষ নাচ ছিল। এখন শুধু চিন্তা করি, পা দুটো যদি শেষ পর্যন্ত নাচানাচির কাজে না লাগাতাম! এখন তো সারাজীবন এই সত্যটা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে।"
"আপনে তো তাও আপনার পছন্দের কাজটা করেই পা হারালেন, তাই না? অন্তত সেই স্বপ্নটা তো পুরণ হলো।"
"তা তো আছেই! তবে সারাটা জীবন হাঁটাচলার তুলনায় এই তিন ঘণ্টার নাচানাচি কিছুই না।"
"তা তো অবশ্যই! তারপর কি হয়েছিল, বলুন?"
"বাসার জন্য যখন বের হলাম, তখন মাথাটা প্রচুর টাল হয়েছিল। এত রাতে নেশা নামানোর জন্য লেবুও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সেই রাত বৃষ্টি হয়েছিল। রাস্তাঘাট বেশ পিচ্ছিল ছিল। আমি এত অন্ধকারের মধ্যে পায়ে হেঁটে সড়ক পার করতে গিয়ে, পা পিছলে, পিঠের উপর পড়ে গেলাম। ঠিক সেই সময়ই একটা বিশাল ট্রাক সেই সড়ক দিয়ে যাচ্ছিল। ট্রাকটার চাকা গেল আমার পায়ের উপর দিয়ে। সেখানে আশেপাশের কিছু লোক এই কাণ্ড দেখে দ্রুত ট্রাককে থামায় এবং আমাকে নিয়ে যায় নিকটবর্তী হাসপাতালে।"
“কপালটা বড়ই খারাপ ছিল আপনার।"
"তা তো ছিলই। ছয় ঘণ্টা অপারেশনের পরে জ্ঞান ফিরে পেয়েছিলাম। জ্ঞান ফেরার পরে উঠে প্রথমেই যা দেখলাম, তা দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।"
"বড়ই কষ্টের ব্যাপারটা।"
"কিন্তু তার চেয়েও বেশি কষ্ট লাগল, যখন দেখলাম সেই মেয়েটিই আমাকে দেখতে আসল না, যার প্রেমে এত মদ খেয়ে মাতাল হয়ে এই কাণ্ডটা ঘটালাম।"
"ফোন করেও জিজ্ঞাস করেনি?"
"কীসের! উল্টো যখন আমি তার খবর নিতে ফোন দিলাম, তখন আমাকে কত আজেবাজে কথা শোনাল।"
"সত্যি?"
"তোমার কাছে মিথ্যা বলে আমার কোনো লাভ আছে?"
"সেটা না। আমি ভীষণ ঝটকা খেলাম কথাটা শুনে। এত জঘন্য কেউ হতে পারে? তাও আবার একটা মেয়ে! এতটাই নিষ্ঠুর! আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না।"
"হুম! অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্য।"
"আপনি পাল্টা কোনো জবাব দেননি?"
"না!"
"কেন? সে আপনাকে অপমান করেই গেল, আর আপনি শুনেই গেলেন!"
"হ্যাঁ! ছোটবেলায় বাবা শিখিয়েছিলেন, শিক্ষকদের কখনও পাল্টা জবাব দিতে হয় না।"
আমি এই কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "মেয়েটা আপনার শিক্ষিকা ছিল?"
"হ্যাঁ! কিন্তু পড়া লেখার জগতে নয়, বরং জীবনের।"
"মানে বুঝলাম না!"
"আরে বাবা, শিক্ষকেরা তো সাধারণত পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান দিয়ে থাকে, সেখানে তাদেরও যদি কোনো কথার পাল্টা জবাব দেয়া উচিত না, তাহলে তো যেই শিক্ষিকা জীবনের এত বড় একটা শিক্ষা দান করেছে, তাকে কি করে পাল্টা জবাব দেয়া যায়? সেই তো সেরা শিক্ষা দান করেছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই শিক্ষাই কাজে আসবে। ঐ পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান সবই এর সামনে তুচ্ছ।"
"হুম! বুঝতে পেরেছি।"
"তবে একটা কথা না বললেই নাই।"
"সেটা কোনটা?"
"আমার জীবনের প্রথম মামলা লড়েছিলাম সেই ট্রাক ড্রাইভারের বিরুদ্ধে। ঘটনাটা ঐতিহাসিক হয়ে রয়ে গেল।"
"বাহ্! এভাবে তো ভেবে দেখিনি।"
"সেটাই! জীবনে ঘটা প্রত্যেকটি মুহূর্তের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে কিছু অমৃত স্মৃতি। অনেকেই তা অবহেলা করে এড়িয়ে যায়।"
"আপনি কি সেই সকল কিছুই স্মরণ করেন?"
"না! তবুও অনুভব করতে পারি।"
"বাবা আপনার সম্বন্ধে যা কিছু বলেছিলেন, সবই দেখি সত্য।"
একটি মুচকি হাসি দিয়ে আমার চেহারার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাস করলেন, "কেন? তুমি কি মিথ্যে মনে করছিলে?"
"ব্যাপারটা ঠিক তা না। কিন্তু অন্য কারো সম্বন্ধে এত প্রশংসা উনার মুখে খুবই কম শুনেছি। তাই অনেকটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল আমার কাছে।"
"আচ্ছা? এমন কি বললেন আমার ব্যাপারে?"
"বলছিলেন; আপনি নাকি এতই জ্ঞানী এবং দক্ষ, যে সূর্য থেকেও আলো হস্তক্ষেপ করে চাঁদকে দিয়ে দিতে পারবেন।"
"হা হা হা! কথাটা কিছু ঘুলিয়ে ফেলেছ, বাবা। কথাটা একটু অন্যরকম ছিল। আর এটা তোমার বাবা সর্বপ্রথম বলেননি, এটা আমাকে জাপানে এক থেকে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সেখানের খুবই বিখ্যাত একজন বিতর্ককারী আমার কাছে হারার পর বলেছিলেন। সেই উক্তিটাই তোমার বাবা টেলিভিশনে দেখার পর আমাকে সেটার বাংলা অনুবাদ জিজ্ঞাস করেছিলেন। আমি সেটাই উনাকে অনুবাদ করে বলেছিলাম।"
"ওহ্! বুঝতে পেরেছি।"
"এবার নিজের সম্পর্কেও কিছু বলো।"
"আমার নাম রাফি। নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। পড়াশোনা ছাড়ার কিছু বছর গেল।"
"এর মাঝের কয়টা বছর কি করলে?"
"জি, এলাকার রাজনীতিতে ঢুকেছিলাম। মিছিল-টিছিলে যেতাম। বক্তৃতাগুলোতে হাজিরা দিতাম। আর মাঝেমধ্যে চাঁদাবাজি করে বেড়াতাম। বাস! এতটাই।"
"এতটাই? অনেক কিছুই তো করেছিলা! পদ পাওনি কোনো?"
"না! সেটার জন্য তো অনেক সময় লাগে। আর রাজনীতিতে বড় কোনো আত্মীয় না থাকলে তো সারাজীবন পদ ছাড়াই থাকা লাগে।"
"ওহ্! ওদের সঙ্গে অন্য কোনো ধরনের অন্যায় কাজে জড়াওনি তো?"
"অনৈতিক বলতে?"
"খুনখারাবি, লুঠপাট, ধর্ষণ ইত্যাদি ইত্যাদি।"
"তেমন কিছু না। কিন্তু যে নেতার অধীন কাজ করতাম, সে একটা খুন করেছিল। সেই খুনের সহায়ক হিসেবে একটা ছোট্ট ভূমিকা পালন করেছিলাম আমি।"
"কেমন ভূমিকা?"
"আমি গেটের বাহিরে দাড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলাম।"
"এটিকে ছোট ভূমিকা বলছো, মিঞা! এটা তো একটা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছ।"
"আমি জানতাম না, তারা যে খুন করে ফেলবে।"
"যাক! অনেক কথাই হলো। আজকের জন্য এইটুকুই। বাকি কথা বলার জন্য অনেক সময় পড়ে আছে। এবার গিয়ে বিশ্রাম করো। কাল থেকে তো তোমার কাজ শুরু।"
"জি!" এটা বলেই আমি উনার রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলাম।"
সেদিন আমাদের মাঝে এতটাই কথা হলো। বাকিটা সময় কাটল নীরবতার মাঝে। পরের দিনই বৃদ্ধ লোকটি অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাড়ির জন্য বের হলেন। সেদিন থেকেই মূলত আমার কাজ করার দিন শুরু হলো। অ্যাডভোকেট সাহেবের মক্কেলরা প্রায় প্রতিদিনই দেখা করতে আসতেন। অনেকে আসতেন পরামর্শ করতে, আবার অনেকে আসতেন নতুন কোনো মামলার প্রস্তাবনা নিয়ে। অনেক বড় বড় রাজনৈতিক দলীয় নেতাদের সঙ্গেও উনার বেশ ওঠাবসা ছিল। উনার দেখা করার সময় নির্ধারিত ছিল সকাল এগারোটা হতে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। এর মাঝেই দু ঘণ্টার বিরতি নিতেন খাবার এবং বিনোদনের জন্য। আমি প্রথম যেদিন এসেছিলাম, সেদিন ঠিক উনার বিরতির সময়টায়। কি ভাগ্য আমার! প্রথম দিনেই এলাম বিরতির সময় আহাসা! তবে বিকেল পাঁচটার পর যে উনার সকল কাজ শেষ হয়ে পড়ে, ঠিক তাও না। উনি বাকিটা সময় বিশেষ কিছু মামলার দলিলপত্র যাচাই করেন এবং বাকিটা রাত একা একা শান্তিপূর্ণভাবে আরাম করেন। শুধুমাত্র রাত দশটার দিকে খাবারের সময় উনাকে ডাক দেয়া যাবে, তার আগে বা পড়ে হলে খবর আছে।
এক বিশেষ সন্ধ্যা; অ্যাডভোকেট সাহেবের সঙ্গে উনার অফিস রুমে বসেছিলাম। হঠাৎ করে দরজা জোড়ে জোড়ে ঠকঠক করার শব্দ আসছিল। মনে হচ্ছিল যেমন দরজাটা ভেঙেই ফেলবে। আমি তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে দেখলাম দুজন বেশ লম্বা এবং মাস্তান প্রকৃতির লোক। তাদের মধ্যে একজন পড়েছিল সাদা একটা পাজ্ঞাবী, স্বর্ণের মোটা একটা চেইন এবং হাতে একটি স্বর্ণের হাতঘড়ি। দেখে বোঝাই যাচ্ছিল কোনো এক নেতা হবে। তার সাথের জন বেশ সাদাসিধে কাপড়ে ছিল, তবে চেহারার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝাই যাচ্ছিল সে যে একটা নিতান্ত চামচা। আমি তাদের জিজ্ঞাস করলাম, "জি, কাকে চাই?"
দুজনের মধ্যে চামচা প্রকৃতির লোকটা আমাকে জিজ্ঞাস করলো, "উকিল সাহেব বাসায় আছেন?"
"জি আছেন! আপনারা কারা?"
তখন নেতা প্রকৃতির লোকটা উত্তর দিল, "আমি তার অনেক পুরনো মক্কেল। নাম; দীপু।"
"জি, ভিতরে আসুন। উকিল সাহেব অফিস রুমে আছেন। আমি ডেকে আনি।"
"না থাক্! আমরা অফিসের কাজেই এসেছি।" এ বলে তারা আমার দুপাশ দিয়ে অফিস রুমের দিকে চলে গেল।
অ্যাডভোকেট সাহেব তাদেরকে অফিসের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখে, চিৎকার করে আমাকে ডাক দিলেন। আমি দৌড় দিয়ে সেখানে হাজির হলে আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, "তুমি কি মনে করে এদেরকে ভেতরে আসতে দিলা? দেখতে পারছ না আমি ব্যস্ত আছি?"
আমি কিছু বলার আগেই দীপু নামক ব্যক্তিটি বলে উঠলেন, "উকিল সাহেব, অনেক জরুরি কাজ ছিল। হাতে একটুও সময় ছিল না।"
"কি হয়েছে এবার? কাকে খুন করে এসেছ?"
"আরে, এবার আমি কিছু করিনি।" বলে লোকটা নিজের সাথের লোককে উদ্দেশ্য করে বললেন, "এই আমার খুব কাছের এক ছোট ভাই, নাম; নয়ন।"
"হ্যাঁ! তারপর?"
"এলাকার মধ্যে একটা ছোটখাটো গণ্ডগোল হয়েছিল জমিনের ব্যাপারে।"
"সরি! আমি জায়গা-জমিনের মামলা লড়ি না। অন্য কারো কাছে যাও।"
"আরে ভাই, কথাটা তো আগে ঠিকমতো শুনেন!"
"আমার কাছে এতো গল্প শোনার সময় নেই। অনেক কাজ বাকি আছে। যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।"
"ঠিক আছে! ঠিক আছে! আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে গিয়ে; সেই গণ্ডগোলের মধ্যে এই বেচারাটা একটু মারধর করে বসল একজনকে। সে এটা রাগের মাথায় করেছিল। একটা শয়তান ছেলে, সেটার ভিডিও রেকর্ড করে অনলাইনে ছেড়ে দিল। তারপর সে ঐ ছেলেটিকে বোঝাতে গেলে ছেলেটা বেয়াদবি করে বসাতে সে ছেলেটাকে শাসন করে। শাসন করতে গিয়ে ছেলেটা ভুলবশত মারা যায়।"
অ্যাডভোকেট সাহেব রাগান্বিত সরে বললেন, "আপনা কথাগুলো শুনলাম। এবার জান। এই কেস আমি লড়তে পারব না।"
"উকিল সাহেব, আপনার কাছে অনুরোধ করছি। আমাকে তো একবার সাহায্য করেছিলেন, এর বেলায়ও একটু দেখেন না!"
"তোমার বেলায় তোমার বিরুদ্ধে এত মজবুত মজবুত দলিল ছিল না। এর তো মারধর করার ভিডিও অনলাইনে রয়েছে। আর যে আপলোড করেছিল, তাকেই মেরে ফেলল! শালা গাধা কোথাকার! নিয়ে যাও একে এখান থেকে। গেট লস্ট!"
অতঃপর সেই চামচা প্রকৃতির লোকটা রেগে, চিৎকার করে, অ্যাডভোকেট সাহেবকে বললো, "বাস! অনেক শুনে ফেললাম। কখন থেকে দেখছি, যা মনে আসছে বকেই যাচ্ছেন। আমাকে যা বলেন না বলেন, দীপু ভাইকে উল্টাপাল্টা কিছু বললে কিন্তু আমি সহ্য করব না।" এই দৃশ্যটি দেখে, সেই নেতা প্রকৃতির লোকটা তাকে থামানোর প্রয়াসে, তাকে ধরে অফিস থেকে বের হতে লাগল। তবুও সেই চামচা প্রকৃতির লোকটা চিৎকার করে বলছিল, "শালা লুলার বাচ্চা, জেলে যেতে হলে তোর খুনটাও করেই যাব।"
এটা শুনে অ্যাডভোকেট সাহেব ভ্রূ কুচিয়ে বললেন, "আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি কেসটা লড়তে রাজি।" এটা শুনে তারা উভয়ই অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়ে গেল। তাদের কিছু বলার আগেই উনি আরো বলে উঠলেন, "কিন্তু একটা শর্ত রয়েছে।"
"কি শর্ত?" জিজ্ঞাস করলেন নেতা প্রকৃতির লোক।
"এই লোককে আমার কাছে কালকে এসে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।"
"উকিল সাহেব, কালকে কেন, এখনই সে ক্ষমা চাবে।" বলে তার চামচাকে বললেন, "এই এক্ষুনি ক্ষমা চাও উকিল সাহেবের কাছে, বেয়াদ্দব। এখনই ক্ষমা চাও।" এই কথাটা শুনে সেই চামচা প্রকৃতির লোকটা অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছে ক্ষমা চাওয়া শুরু করলো।
এই দৃশ্য দেখে অ্যাডভোকেট সাহেব বললেন, "এখানে আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে কোনো লাভ নেই। তুমি আমাকে এইমাত্র 'লুলার বাচ্চা' বলে গালি দিয়েছ। অর্থাৎ, এখানে তুমি মূলত আমার বাবাকে গালিটা দিয়েছ। তাই আমি চাই, কালকে দুপুরে তুমি আমার বাবার কবরের কাছে এসে, উনার কাছে ক্ষমা চাও।"
এটা শুনে নেতা প্রকৃতির লোকটা বলে উঠল, "ঠিক আছে! ঠিক আছে! সে কালকে দুপুরে সেখানে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিবে।"
"ঠিক আছে। তাহলে এবার তোমরা যেতে পারো।"
অ্যাডভোকেট সাহেবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নেতা প্রকৃতির লোকটা বললেন, "ধন্যবাদ, উকিল সাহেব। অনেক অনেক ধন্যবাদ।" এরপর নিজের চামচাকে বললেন, "চলো! কাজ হয়ে গিয়েছে।"
তারা বাসা থেকে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর অ্যাডভোকেট সাহেব একজনকে ফোন করলেন। ফোনের লোকটাকে বলছিলেন, "শুনো, তোমাদের জন্য নতুন একটা কাজ আছে। করতে পারবা তো?" আমি দূর থেকে শুধু এইটুকুই শুনতে পেরেছিলাম। পরবর্তীতে রাতে, খাবারের টেবিলে উনাকে জিজ্ঞাস করলাম, "আপনি কি আসলেই কেসটা লড়বেন? লোকটার বিরুদ্ধে তো অনেক বেশি পরিমাণের প্রমাণ রয়েছে।" আমার প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট সাহেব একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "আগে শর্তটা তো পূরণ হতে দাও রে, বাবা!"
শুনে অবাক লাগলেও, তখন এই ব্যাপারে বেশি একটা চিন্তা করিনি। শুধু অপেক্ষায় ছিলাম তার পরের দিনের দুপুরের।
পরের দিন সকালে অ্যাডভোকেট সাহেব তাদেরকে ফোন করে কবরস্থানের ঠিকানা জানিয়ে দিলেন এবং ছেলেটিকে একা পাঠাতে বললেন। আমরা দুপুরে ঠিক দুটার দিকে সেখানে অপেক্ষায়, কবরস্থানের ভেতরে দাড়িয়ে ছিলাম। অ্যাডভোকেট সাহেবের বাবার কবরের পাশেই দাড়িয়ে ছিলাম। খেয়াল করলাম ছয়টি বড় বড় গাছ কবরটিকে ছায়া দিচ্ছে। বেশ দারুণ একটি স্থানে ভদ্রলোকটিকে দাফন দেয়া হয়েছে। আশেপাশে মানুষ খুবই কম ছিল। হাতেগোনা কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছিল। অ্যাডভোকেট সাহেবের বাবার কবরটা খুবই ভিতরের দিকে অবস্থিত। এত নিরিবিলি জায়গায় কেউ মরে পড়ে থাকলেও কেউ দেখতে আসবে না। কারণ জায়গাটা ভীষণ বড় এবং আশেপাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই। এসব জায়গায় সহজেই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই হওয়ার প্রবণতা থাকে। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করার মতো ব্যাপার ছিল, যেখানে অ্যাডভোকেট সাহেবের বাবার কবরের পাশেই আরেকটা কবর খুদে রাখা। আমি এর সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাস করব আর এতক্ষণে সেই চামচা প্রকৃতির লোকটা এসে হাজির হলো।
"অপেক্ষার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত, উকিল সাহেব। রাস্তাঘাটে যেই জেম! তার উপর দিয়ে এখানে এসে শেষ মাথা খুঁজছিলাম। সরি! সরি!" সেই লোকটি বললো।
"আরে! কোনো ব্যাপার না। ইটস ওঁকে!" বলে অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের বাবার কবরের তরফ ইশারা করে বললেন, "এই হলেন আমার বাবা; মোঃ সিবলি ক্বারি। এনার কাছে ক্ষমা চাও।"
"জি, অবশ্যই।" বলে কবরের দিকে ঘুরে, হাত জোড় করে বলতে লাগল, "আমি অতিরিক্ত রাগের মাথায় আপনার ছেলেকে গালি দিতে গিয়ে ভুলবশত আপনাকেও গালি দিয়ে ফেলেছিলাম। আপনি পরকাল থেকে আমার ডাক শুনে থাকলে, আপনার কাছে অনুরোধ করছি, দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।" এটা বলা শেষ হবার সাথেসাথে অ্যাডভোকেট সাহেব উনার বন্দুকটি বের করে, সেই লোকটার দু পায়ের হাঁটুর মধ্যে গুলি করলেন। লোকটা সঙ্গেসঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল। এই দৃশ্যটি দেখে আমি চমকিত হয়ে পিছনে চেপে গেলাম। অতঃপর আশেপাশের যারা ছিল, তারা দৌড় দিয়ে আসলো। প্রথমে মনে করেছিলাম তারা অ্যাডভোকেট সাহেবকে থামাতে আসছে, কিন্তু না, তারা এসেছিল সেই চামচাকে ধরে রাখতে। তারা সবাই মিলে সেই চামচা প্রকৃতির লোককে ধরে মাটিতে শুয়িয়ে রেখেছিল। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব তার হুইলচেয়ার নিয়ে লোকটার গলায় চড়িয়ে দিলেন। হুইলচেয়ার এবং তার উপর বসে থাকা অ্যাডভোকেট সাহেবের পুরো ভাড়টা ছিল লোকটার গলার উপরে। লোকটার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এমতাবস্থায় সে একটি পানে থেকে বের হওয়া মাছের মতো ছটফট করতে লাগল। দম বের হতে তাড়াতাড়ি করতে, অ্যাডভোকেট সাহেব হুইলচেয়ার আগে-পিছনে করছিলেন। লোকটা অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করার পর শেষমেশ মারা গেল। পাশের সেই খালি কবরটির ব্যাপারটা তখন বুঝতে পারলাম। লোকটিকে মেরে ফেলার পরে বাকিরা তার লাশ সেখানে ফেলে দিল। গর্তের মধ্যে কিছু শুকনো পাতাও ফেলে, তার উপর কেরোসিন ঢেলে দিল। অতঃপর একটা ম্যাচের কাঠি ধরিয়ে সেখানে ফেলে দিল। লাশটি পুড়তে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। এই সময়টুকুর মধ্যে আরো কয়েকবার কেরোসিন ঢালা হলো। পুরোভাগে পোড়ানোর পরে তার উপর মাটি দিয়ে দিল। দৃশ্যটি দেখে অ্যাডভোকেট সাহেবের চেহারায় মুচকি হাসি দেখতে পাচ্ছিলাম। অ্যাডভোকেট সাহেবের মুখে সেই হাসিটা দেখে সেদিন ভীষণ ভয় পেলাম। সব শেষে তারা সবকিছু গুছিয়ে রেখে দিল। সবাই কলের পানি দিয়ে নিজের শরীর থেকে রক্ত পরিষ্কার করে নিল। আমি নিজ হাতে অ্যাডভোকেট সাহেবের হুইলচেয়ার এবং কাপড়ে লাগা রক্তের দাগ ধুয়ে দিলাম। রক্তের দাগ ধোয়ার সময় উনি আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, "আশা করি মুখটা পরবর্তীতেও এভাবেই বন্ধ থাকবে।" হঠাৎ উনার এই কথা শুনে চমকে জিজ্ঞাস করলাম, "জি! আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। মুখ বন্ধ বলতে?"
"থাক্! আপাতত বাসায় চলো। মাথায় এখন অনেক কিছু ঘুরছে তো। এখন সোজা কথাও বাকা মনে হবে। তার তুলনায় আমার কথা তো এমনিতেই বাকা।"
কিছু না বুঝেই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালাম। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব ড্রাইভারকে ফোন করে গাড়ি ডাকালেন এবং আমরা বাসার জন্য বের হলাম। গাড়িতে বসে পুরোটা সময় শুধু সেই হত্যার ব্যাপারেই ভাবছিলাম। চোখের সামনে সেই দৃশ্যগুলি ভাসছিল। কিভাবে লোকটা ছটফট করছিল, কিভাবে তার নাক-মুখ থেকে রক্ত বের হচ্ছিল, কিভাবে তাকে সবাই ধরে রেখেছিল- ওগুলোই বারবার মনে পড়ছিল। ঐ একজন লোক তো তার চোখের মধ্যে নিজের হাতের আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে দিয়েছিল। জানি, সেই লোকটাও একটা খুনি, তাও এমন নির্মমভাবে কারো হত্যা নিজের বিবেককে স্বাভাবিক রাখা যায় না। এই ব্যাপারে অবশ্যই গুরুতর অনেক কথাই ছিল অ্যাডভোকেট সাহেবের সঙ্গে। এটা চিন্তা করতে করতে আমরা বাসায় পৌছে গেলাম। বাসায় প্রবেশ করতেই না করতে অ্যাডভোকেট সাহেবের ফোন বেজে উঠলো। ফোন করেছিলেন সেই নেতা প্রকৃতির লোকটা। ফোনে অ্যাডভোকেট সাহেবকে জিজ্ঞাস করছিলেন তার সেই ছোট ভাইয়ের কথা। অ্যাডভোকেট সাহেব বলে দিলেন, "তোমার সেই ছোট ভাইয়ের জন্য তো আজ প্রায় তিন ঘণ্টার মতো সেখানে অপেক্ষা করছিলাম, সে তো আসেনি।" তার উত্তরে সেই লোকটা অবাক হয়ে বললেন, "কি বলেন, উকিল সাহেব? এটা তো অসম্ভব। সে তো সেখানে পৌছানোর পর আমাকে ফোনও করেছিল।"
"তাহলে সে গেল টা কোথায়?"
"আশ্চর্য! আপনার সাথেই তো দেখা করতে গিয়েছিল।"
"আমি বললাম তো, আমি সেখানে ছিলাম প্রায় তিন ঘণ্টার মতো। আমি তো তার কোনো দেখাসাক্ষাৎ পাইনি!"
"আপনি সিওর তো?"
"অবশ্যই! চাইলে আমার কাজের লোককে জিজ্ঞাস করতে পরো। সেও আমার সঙ্গেই ছিল।"
"কি বলেন এসব, উকিল সাহেব? আপনার উপর তো পুরো ভরসা রয়েছে। আমি তো চিন্তিত আছি অন্য বিষয় নিয়ে।"
"তা কি?"
"তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল নাকি! সেটা।"
"সেটা আমার চিন্তার কোনো বিষয় না। এবার কথাটা শেষ হয়ে থাকলে ফোনটা রাখো, এমনিতেই অনেক কাজ পিছিয়ে গিয়েছে এসব নিয়ে।"
"জি, উকিল সাহেব! অবশ্যই।"
এটা বলেই ফোনটা রেখে দিল। অ্যাডভোকেট সাহেব ফোনটা হাত থেকে রেখে, সেই হাত দিয়ে কপাল ধরেছিলেন। উনার ধরনের আন্দাজ দেখে মনে হচ্ছিল, উনার মাথা ধরেছে। উনার দলিলপত্রের কাজ শেষ হবার পর, সাহস করে উনার কাছে গেলাম সেই ঘটনা নিয়ে কিছু আলাপ আলোচনার জন্য। অ্যাডভোকেট সাহেব আমার কিছু বলার আগেই বললেন, "এসো! এসো! বসে পড়ো।"
আমি চুপচাপ বসে পড়লাম। অ্যাডভোকেট সাহেব আমার দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে দু-চারবার একটা মুচকি হাসি দেওয়ার খুব চেষ্টা করছিলেন। দেখে এমন মনে হচ্ছিল, যেমন উনি আমাকে কিছু বলতে দ্বিধা বোধ করছিলেন। ব্যাপারটা এত সাংঘাতিক না হলে সে মুহূর্তে হেসেই দিতাম। তবে অবশেষে বলেই ফেললেন, "আজকে তুমি নিজ চোখে যা কিছু দেখেছ, সেটা কখনওই তোমার স্মৃতি থেকে বের করা সম্ভব না। তবে, এটা মনে রেখেও নিজের বাকি জীবন কাটানো সম্ভব। কারণ যদি আমি এটা করতে পারি, তবে তুমিও অবশ্যই পারবে।"
আমি কোনো অতিরিক্ত বিষয়ে আলোচনা না করেই সরাসরি মূল কথায় এসে পড়লাম, "একজন জীবিত লোককে এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করাটা কি ঠিক হয়েছে?"
অ্যাডভোকেট সাহেব আমার প্রশ্নটা শুনে কিছুটা অবাক হলেও, উনার চেহারা দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল; এটা উনার প্রথমবার নয়। উনি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "সেই লোকটা একজন খুনি ছিল, সেটা মনে আছে তো?"
"জি! অবশ্যই। কিন্তু তার জন্য তো আইনি ব্যবস্থা আছে, তাই না?"
"হা হা হা! কোন যুগে বসবাস করছ, বাবা? আইন কি আর আগের অবস্থায় আছে?"
"না থাকলেই বা কি? একজন আইনজীবী হিসেবে কি আপনার কোনো নৈতিক দায়িত্ব নেই?"
"আমার নৈতিক দায়িত্ব সর্বপ্রথম আমার নিজের জন্য। আর আমি না মারলে, সে কিছুদিন পর এমনিতেও মারা যেত। তার বিরুদ্ধে খুবই মজবুত দলিল ছিল। আমি এমন কোনো কেস লড়ি না, যেটা নিঃসেন্দহে হেরে যাবো।"
"আপনি তো তাদেরকে একবার মানা করেছিলেনই, আবার হ্যাঁ বলে এসব করার কি দরকার ছিল?"
"আরে বাবা, তুমি তো শুধু এই একটা ঘটনা দেখলে। আরো কত যে এমনই অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। কিছুদিন আমার সঙ্গে থাকলে এসবের অভ্যাস হয়ে যাবে।"
"আমি তো এসবের অভ্যাস লাগাতে চাই না।"
"তাহলে চাও টা কি, হ্যাঁ? বাহিরে গিয়ে সবাইকে বলে ফেলতে চাও? এতটা মনে রেখ, তুমিও আমার সঙ্গে ছিলে, একথা কিন্তু দীপু ভাল করে জানে। কোনো ধরনের মামলায় আমি পড়লে, সেখানে তোমার নামও অবশ্যই আসবে। আর আমি নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে সহজেই ছুটে যেতে পারব।"
"আমি তো সেই লোকটাকে কখনও হাতও লাগাইনি। আমাকে তো কোনোভাবেই দোষী প্রমাণ করতে পারবেন না।"
"হা হা হা! সেটা তো একদম যৌক্তিক একটা কথা বলেছ। আমি তো কোনোভাবেই তোমাকে দোষী প্রমাণ করতে পারব না। তবে এখানে প্রমাণে ততটা প্রয়োজন নেই, যতটা দরকার যুক্তির।"
"ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।"
"নিজের বাবার কথাগুলো মনে করলে সবই বুঝতে পারবা।"
"বাবার কোন কথাগুলো?"
"আরে বাবা, যে ব্যক্তি সূর্যের আলোর প্রকৃত অধিকারী হিসেবে যদি চাঁদকে প্রমাণ করতে পারে,সেই ব্যক্তি কি এমন একটা হত্যার আসামি হিসেবে তোমাকে দোষী প্রমাণ করতে পারবে না? এটা কি কখনও হতে পারে, বলো?"
"দেখুন, আমি কখনওই আপনার বিরোধিতা করার কথা বলিনি। আমি শুধু সহজ একটা প্রশ্ন করেছিলাম।"
"সেটার উত্তর কি আমি দেইনি?"
"দিয়েছেন, কিন্তু আংশিক; পুরোপুরি এখনও দেননি।"
"সেই প্রশ্ন নিয়ে আমরা সারাটা রাত আলোচনা করতে পারি, কিন্তু সেই আলোচনার মাধ্যমে না সেই লোকটা ফিরে আসবে যাকে আমি খুন করেছি, আর না সেই লোকটা ফিরে আসবে যাকে সে খুন করেছিল। তাই সর্বোত্তম কাজটা হলো এই ব্যাপারে আর কোনো কথা আগে না বাড়ানো।"
"ঠিক আছে! যেভাবে আপনি ভাল মনে করেন।"
"এই তো! শাবাশ! বুঝতে পেরেছ এতক্ষণে।"
"তবে আমার একটা বিষয় নিয়ে বিশাল কৌতূহল ছিল।"
"হ্যাঁ! বলো।"
"সেই লোকজনকে দিয়ে যে এত কিছু করালেন, তারা কি আদৌ নিজের মুখ বন্ধ রাখতে পারবে?"
"অবশ্যই পারবে! তাদের কাজই এটা। তারা হলো আমার ব্যক্তিগত সুইপারের মতো। তাদেরকে দিয়েই নিজের জীবন থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করি।"
"খরচও তো নিশ্চয়ই বড় মাপের হওয়ার কথা।"
"সেটা তো আছেই। প্রত্যেকটা কাজের জন্য এক লক্ষ করে দেই প্রত্যেককে। আজকাল তো টাকা ছাড়া পোষা কুকুরও পাশে থাকতে চায় না, এরা তো তাও রাস্তার কুকুর।"
"হুম! বুঝতে পেরেছি।"
"তবে, এই হত্যাগুলো না করলেই হয় না? তাহলে তো আর এত টাকাও খরচ করতে লাগত না।"
"আরে বাবা, যেদিন জীবনে শীর্ষ কোনো পর্যায়ে পৌছাবা, সেদিন বুঝতে পারবা; দুনিয়ার সামনে নিজের সম্মান কীভাবে নিজের জীবনের চাইতেও মূল্যবান হয়ে ওঠে। সেদিন মৃত্যুর চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর হবে অপমান।"
আমি একটু মাথা নিচু করে, আবেগাপ্লুত হয়ে বললাম, "এমন কোনোদিন দেখা কপালে আছে কি না, তা জানি না। তবে আপনার কথাগুলো শুনে সেই জগৎটা দেখার অনেক ইচ্ছা আছে। কিন্তু সেটার জন্য দরকার আপনার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা এমং কর্মদক্ষতার, যা আমার মধ্যে বিদ্যমান না।"
"সেটা থেকে একটা কথা মনে পড়ল। তোমার বাবা বলেছিলেন, তুমি নাকি ছোটবেলায় অনেক মেধাবী ছাত্র ছিলে, নবম শ্রেণীতে ফেল করলে কি করে?"
আমি ভীষণ লজ্জার সঙ্গে বললাম, "আসলে, ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়।"
"মানে?"
"মানে হলো গিয়ে, আমি নবম শ্রেণীতে ফেল করিনি। তবে পাশ করার সুযোগও পাইনি।"
"কেন? কি হয়েছিল?"
"কাহিনীটা বেশ একটা বড় না হলেও, আমার জীবন বিশাল প্রভাব ফেলেছে। আমি তো পড়তাম একটা সরকারি স্কুলে। আপনার তো জানার কথা, সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সুন্দরী এবং জুয়ান কর্মী দেখা খুবই সচরাচর। তাই একটা শিক্ষিকাও যদি অল্প সুন্দরীও হয়, তাও সবাই তার প্রতি সর্বোচ্চ আগ্রহ প্রদর্শন করে। আমার বেলায়ও সেটাই ঘটেছিল। একদিন ক্লাসে বসে সবাই গণিত ক্লাস শুরুর অপেক্ষা করছিলাম। সেদিন নতুন একজন শিক্ষিকা আমাদের স্কুলে যোগদান করলেন। ধবধবে ফর্সা ত্বক, কোমল গোলাপি ঠোঁট, ঘন কালো চুল, চিকন দেহের আকৃতি এবং সেই সুন্দর দেহের উপর সাদাকালো শাড়ি। উনার চলার ধরন তো ছিল টেলিভিশনের নায়িকাদের মতো। আমি তো প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে আহত হয়ে গেলাম। নতুন ম্যাডাম নিজের পরিচয় দেয়ার পরই পড়ানো শুরু করলেন। সেদিন জ্যামিতি পড়াচ্ছিলেন। চিত্র আঁকতে বোর্ডের দিকে ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে উনার পিঠের দিকে আমার নজর পড়ল। নজর পড়তেই আমার মুখ থেকে শিস বেজে উঠল। আমি মাঝারি সারিতে বসেছিলাম, তাই আমাকে প্রথম দেখায় খুঁজে পাননি। কিন্তু তার কিছুক্ষণ পরই, চিত্র আঁকা শেষ করে একটা ঘোষণা করলেন। একটা মিষ্টি হাসির সঙ্গে পুরো ক্লাসকে জিজ্ঞাস করে উঠল শিসটা কে মেরেছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক, আমি স্বীকার করিনি। তবে উনার ছলনা হতে আর কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারতাম? উনি আরেকবার মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, উনার নাকি শিসের শব্দ বেশ পছন্দ এবং উনি নাকি তাকে পুরস্কার দিতে চান, যে শিসটা বাড়িয়েছিল। আমি তো সেই কোমল কোমল গোলাপি ঠোঁটের হাসি দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পুরস্কারের কথা শুনতেই মনের মধ্যে অসংখ্য লাড্ডু ফোটা শুরু হলো এবং আমি দাড়িয়ে স্বীকার করে নিলাম শিসটা যে আমিই মেরেছিলাম। এটা স্বীকার করার কিছুক্ষণের মধ্যে আমি নিজেকে পাই মাননীয় অধ্যক্ষের, ভয়াবহ কক্ষে। কয়েকটা চর-থাপ্পড় খেলাম, বকাঝকা শুনলাম। পুরস্কার নেওয়ার আশায় দাঁড়িয়েছিলাম, তিরস্কার নিয়ে বেড়িয়েছিলাম। অনেক হাত-পা জোর করার পর তারা বাসায় না জানানোর জন্য রাজি হলো। আমি বাসায় গিয়ে বলেছিলাম, বার্ষিকী পরীক্ষায় কোনো এক বিষয়ে ফেল করলেও স্কুল থেকে বের করে দিবে। পরবর্তীতে সেই অজুহাত বাস্তবায়নের জন্য পরীক্ষার বাহানা করে, স্কুলের পাশের গলির মধ্যে টঙের বেঞ্চে বসে বসে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতাম। পরীক্ষার ফলাফলের দিন বাসায় বলে দিলাম ফেল এসেছে বলে টি সি। এভাবেই শেষ হলো আমার শিক্ষাগত জীবনযাত্রা।"
অ্যাডভোকেট সাহেব আমার কাঁধে নিজের ডান হাত রেখে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "তোমাকে তো বড়ই সহজ সরল ভাবছিলাম। তুমি তো মিঞা জিনিস একটা। পরিবার জানলে কষ্ট পাবে বলে, হাত-পা জোর করলা! আমি তো কখনওই এত ধৈর্য ধরে রাখতে পারতাম না।"
আমিও সামান্য হেসে বললাম, "অ্যাডভোকেট সাহেব, আপনার সঙ্গে আমার তুলনা হয় নাকি?" ডান হাত দিয়ে উপরে ইশারা করে বললাম, "কোথায় আপনি!" এবং বাম হাত নীচের দিকে ইশারা করে বললাম, "আর কোথায় আমি!"
অ্যাডভোকেট সাহেব জোড়ে একটা হাসি দিয়ে বললেন, "হা হা হা হা হা! ঠিকই বলেছ, বাবা! তোমার দু পা জমিন স্পর্শ করতে পারছে, কিন্তু আমি জমিনে থাকা সত্ত্বেও জমিনকে স্পর্শ করার মতো একটি পাও নেই। আমি ভাল করে জানি তুমি কি বুঝাতে চেয়েছ, তবে আমার এসবের প্রতি তেমন একটা রুচি নেই। কারণ লোকে তো বহু প্রশংসা করবে, কিন্তু দিন শেষে সেই প্রশংসাগুলোর কোনো মূল্য নেই। যদি থাকতো, তাহলে কারো প্রশংসার আর কোনো দরকারই পড়ত না।"
আমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করে বসলাম, "জি, প্রশংসার মূল্য থাকলে প্রশংসার দরকারই পড়ত না! কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।"
"সেটা এখন বুঝতে পারবাও না। এই জিনিসটা বুঝতে বুঝতে এতগুলি চুল পেকে গেল। তোমাকে যদি সহজ ভাষায় বলেই দেই, তাহলে সেটা শিক্ষণীয় নয় বরং প্রশিক্ষণীয় হবে।"
অ্যাডভোকেট সাহেবের অধিকাংশ কথাগুলো মাথার উপর দিয়ে গেল বললেই চলে। তবে কথাগুলো স্মরণে রাখতে চেষ্টা সর্বদাই। আমাদের কথার শেষে আমি আমার রুমে ফিরলাম। রুমে ফেরার কিছুক্ষণ পরই আবার মনে পড়ল সেই দুপুরবেলার ঘটনা। মনে পড়াতে নিজেই অবাক হলাম নিজের উপর। এত বিশাল ঘটনা কি সুন্দরভাবে ভুলে গেলাম কিছু মজাদার মজাদার গল্পের মাঝে! মা আসলে ঠিকই বলেছিল। আমার মাথায় আসলেই কিছু সমস্যা আছে। তবে ঘটনাটা যতক্ষণ ভুলে গিয়েছিলাম, ততক্ষণ প্রচুর শান্তিতে ছিলাম। আসলে, ব্যাপারটা একটু নতুন নতুন মনে হলেও, আমার জন্য প্রথম না। কারণ অ্যাডভোকেট সাহেবের সঙ্গে যতক্ষণ গল্প চলছিল, ততক্ষণ উনি আমার কথাগুলো বেশ গুরুত্ব দিয়ে শুনছিলেন। উনার চেহারার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝাই যাচ্ছিল উনি আরো শুনতে আগ্রহী। এমন দীর্ঘ আগ্রহ দিয়ে আমার কথা গতবার শোনা হয়েছিল সেদিন, যেদিন বাসায় এসে সবাইকে বলেছিলাম; আমাকে স্কুল থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সেদিনই আমার কথাগুলো সর্বোচচ গুরুত্ব, আগ্রহ এবং নিন্দা পেয়েছিল। তার আগে কখনও স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারিনি, এমন হতে পারে। ছোট থেকে বড় হলাম এ মনে করে, গুরুত্ব কখনও নিন্দনীয় বস্তুর প্রতি দেয়া যায় না। কিন্তু স্কুল থেকে বের হবার পর সেই শিক্ষাও পেয়েই গেলাম। সেদিন যা ঘটেছিল, তাকে স্বপ্ন বলে ভুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই মানসিকতা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে, নাহলে দুনিয়াতে আরো অনেক অজানা রহস্যই আছে যা মানুষের না জানাটাই উত্তম। এসব গভীর চিন্তা শেষে ঘুমোতে গেলাম। চোখ বন্ধ করার কিছু সময়ের মধ্যেই সেই লাশটি চোখে ভেসে উঠছিল। সাথে সাথে চমকে উঠে বসে পড়লাম। এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল দম আটকে গিয়েছে। নিশ্বাস ফেলতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছিল। সেই রাত আরো কয়েকবার এমন হবার পর সিদ্ধান্ত নিলাম জেগে থাকার। তবে এই সিদ্ধান্তে আসার কিছুক্ষণ পর পানি পান করতে গেলাম রান্নাঘরের দিকে। তখন বুঝতে পারলাম আমিই একমাত্র ব্যক্তি নয় যার ঘুমোতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। অ্যাডভোকেট সাহেবের রুমের বাতিটা জ্বালানো ছিল। দরজা লাগানো থাকার কারণে, আস্তে করে, দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে, উঁকি মেরে দেখলাম। দেখলাম উনার রুমে টেলিভিশন চালু আছে এবং অ্যাডভোকেট সাহেবের হুইলচেয়ারটির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম; উনি টেলিভিশনের ঠিক বিপরীত দিকে ঘুরে আছেন। আমি দেখে খুবই অবাক হলাম। একটা লোক টেলিভিশন চালু রেখে কেনই বা তার ঠিক উল্টো পাশে ঘুরে থাকবেন? ব্যাপারটা খুবই অযৌক্তিক ছিল। কিন্তু তখনই রুমের ডান পাশ দিয়ে দেখি দুটো পা হেঁটে, হুইলচেয়ারের দিকে আগে বাড়ছে। আমি "চোর! চোর!" বলে চিৎকার দেবার আগেই খেয়াল করে দেখলাম পা দুটো মোটেও স্বাভাবিক নয়। বরং আরো ভাল করে নজর দেওয়াতে বুঝতে পেলাম পা দুটো তো আলাদা পা। একবার একটি পত্রিকার খেলার পাতায় দেখেছিলাম এমন পা। সেখানে একজন পা বিহীন মেয়ে সেটার মাধ্যমে একটি বিশ্বসেরা দৌড় প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করেছিল। ইহার নাম ঠিক মনে নেই, তবে বাস্তবে দেখার অনেক আগ্রহ ছিল। কিন্তু আগ্রহ তো তখনই পুরণ হবে, যখন জীবনটা বাকি থাকবে। আমি সেখানে চোরের মতন লুকিয়ে লুকিয়ে দৃশ্যগুলো দেখার কারণে মনে এক বিশাল দুশ্চিন্তা কাজ করছিল। যদি ধরা খেয়ে যাই? যদি আমাকে চোর মনে করে, আমাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেন? যদি আমার এই আচরণে অ্যাডভোকেট সাহেব আমার উপর অসন্তুষ্ট হন? আরো অনেক দুশ্চিন্তা তখন মাথার ভেতর ঘুরঘুর করছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে হৃৎপিন্ডের গতি তো বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়ে ফেলার মতো অবস্থা হয়ে যায়। সেই অত্যন্ত জটিল একটি পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছিল আমার হৃৎপিন্ডের শব্দ আমি জোরে জোরে শুনতে পাচ্ছিলাম। মানুষ এমতাবস্থায় নিজেরই হৃৎপিন্ডের শব্দ শুনে আরো বেশি ঘাবড়ে যায়। তখন তার সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান করণীয় হয়ে পড়ে সেখান থেকে পালানো। ভাগ্যবশত, টেলিভিশনের শব্দের কারণে আমার হৃৎপিন্ডের কোনো শব্দ ভেতরে শোনা যাচ্ছিল না। একদিক দিয়ে চিন্তা করছিলাম রুমে ফিরে যাওয়ার, আরেকদিকে মনের সেই দৃঢ় আগ্রহ বলছিল; সেখানে বসে থেকে আরো দেখতে। কিন্তু আমি এত সহজে নিজের মনের ফাঁদে ফাঁসার লোক না। আস্তে করে সেখান থেকে উঠলাম এবং খুবই সাবধানে নিজের রুমের দিকে ফিরে গেলাম। রুমে ফেরার পর বড় একটা দম ছাড়লাম। তৎকালীন অনুভূতিটা অতি ভয়ঙ্কর হলেও, রুমে ফেরার পর বেশ তৃপ্তি পেয়েছিলাম। আসলে, তৃপ্তি না বলে এটাকে এক বিশেষ ধরনের আনন্দও বলা যেতে পারে। একটি বিপদ থেকে বেঁচে থাকতে পারাটা যেমন সৌভাগ্য, বিপদে পড়ে আবার ঠিকঠাক অবস্থায় ফিরে আসাও একটি অন্যতম প্রাপ্তি।
পরের সকালে ঘটল বেশ সাংঘাতিক এক ঘটনা। সকালে প্রায় নয় ঘটিকায় কলিং বেল বেজে উঠল। সাধারণত এত সকালে তো কেউ আসে না। আমি দরজা খুলে দেখতে পাই কমলা রঙের শাড়ি পড়া একজন সুন্দরী মহিলা। উনার গলায় ঝোলানো ছিল একটি পরিচয়পত্র, ডান কাঁধে ঝোলানো ছিল একটি কালো রঙের হ্যান্ডব্যাগ এবং হাতে ছিল একটি বেশ উন্নতমানের ক্যামেরা। দেখে বুঝতে পারলাম উনি একজন সাংবাদিক। জীবনে অনেক তো সংবাদ এবং সাংবাদিক দেখলাম, তবে উনার সঙ্গে তাদের তুলনা হয় না। উনাকে জিজ্ঞাস করলাম, "জি, কে আপনি?" যাহার উত্তর না দিয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, "তুমিই নতুন কাজের লোক নাকি?" উত্তরে আমি বললাম, "জি! আপনি কি উকিল সাহেবের পরিচিত কেউ?" উনি সামান্য একটু বিরক্তির স্বরে জিজ্ঞাস করলেন, "আমি ওর কি হই না হই, এসব জেনে তুমি কি করবা?" উনার মেজাজ দেখে আমি সামান্য ঘাবড়ে গেলাম। এমন ঘাবড়ানো অবস্থায় বলে উঠলাম, "জি, আমি শুধু উকিল সাহেবের নির্দেশনা অনুযায়ী আপনাকে প্রশ্নটা করেছিলাম। আমাকে ভুল মনে করবেন না।" উনি কিছুটা মেজাজ ঠান্ডা করে বললেন, "ঠিক আছে! নতুন কাজের লোক তো, তাই ভুল মনে করে মাফ করে দিলাম। আগের থেকে যাতে এমন না দেখি, ঠিক আছে?"
"জি, অবশ্যই!"
"হুম! সাব্বির আছে বাসায়?"
"জি! উনি উনার রুমের ভেতর বসে সংবাদপত্র পড়ছেন। আপনি ওয়েটিং রুমে বসুম, আমি উনাকে দেকে নিয়ে আসি।"
"না, থাক্! আমি যাই ওর কাছে।"
আমি উনার সামনে গিয়ে থামানোর চেষ্টা করতে লাগলাম আর বললাম, "ম্যাডাম! ম্যাডাম! ম্যাডাম! উনার রুমে বিনা অনুমতি কারো প্রবেশ করার অনুমতি নেই।"
কিছুটা রেগে বললেন, "আবার বেয়াদবি! কি বলেছিলাম একটু আগে?"
"আমার সব মনে আছে, ম্যাডাম। কিন্তু একটু বোঝার চেষ্টা করুন। এটার কারণে আমার চাকরি চলে যেতে পারে।"
"চাকরি চলে গেলে আমার বাসায় নিয়োগ দিয়ে দিব। এখন সড় আমার সামনে থেকে।"
"ম্যাডাম, একটু তো বোঝার চেষ্টা করুন। প্লিজ!"
আমি উনাকে অনুরোধ করেই যাচ্ছিলাম, এমতাবস্থায় অ্যাডভোকেট সাহেব এসে আমার পেছন থেকে বললেন, "আরে বাবা, তাকে আসতে দাও। সে আমার খুব পরিচিত একজন।" এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি উনার কাছে ক্ষমা চেয়ে, উনার রাস্তা ছেড়ে দিলাম। উনি আমার দিকে বেশ ক্রোধের দৃষ্টিতে তাকিয়ে অ্যাডভোকেট সাহেবকে জিজ্ঞাস করলেন, "সাব্বির! তুমি এই ছেলেটাকে আমার প্রসঙ্গে এর আগে কিছু বলোনি?"
উত্তরে অ্যাডভোকেট সাহেব সামান্য হেসে বললেন, "না! বলার সময়ই পাইনি। এত ব্যস্ততার মাঝে শুধু হাতেগোনা কয়েকজনের সাথেই পরিচয় করানো হলো।"
"অন্তত আমার কথাটা তো একবার উল্লেখ করে দিতা! জানো, এতক্ষণ ধরে কি আজগুবি আজগুবি প্রশ্নর সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমার?"
"হা হা হা! সাংবাদিকতার মাধ্যমে কয়জনের কাছে কতগুলো আজগুবি প্রশ্ন করেছিলা, সেটা মনে আছে তো? এই সামান্য কিছু প্রশ্ন সেগুলোর সামনে কিছুই না।"
"আমি কিন্তু মোটেও হাসিঠাট্টা করার মুডে নেই।"
"আরে সরি বাবা! ভুল হয়ে গিয়েছে।"
আমি মাঝখান দিয়ে বলে উঠলাম, "উকিল সাহেবের কোনো দোষ নেই। উনি সারাদিন কাজের ব্যস্ততার মাঝে মোটেও সময় খুঁজে পান না।" আমার উত্তরটি শুনে ম্যাডামের চেহারায় কেমন অবাক একটা ভাব এসে পড়ল। মুখে হাত দিয়ে, সামান্য একটি কাঁসি এবং তার সঙ্গে একটি হাসি দিয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "ঠিকই বলেছ।" আবার অ্যাডভোকেট সাহেবের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিম্ন স্বরে বললেন, "তার জীবনে কাজ ছাড়া আর আছেই টা কি!" এটা বলে এক মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে, নিচের দিকে চেয়ে, আবার আমার দিকে চেয়ে, আমার ডান কাঁধে নিজের বাম হাত রেখে বললেন, "সরি! দোষটা আমারই ছিল। মনে কিছু নিও না, ঠিক আছে বাবা?" বলে একটা মায়াবী হাসি দিলেন। এরপর তারা উভয়ই অ্যাডভোকেট সাহেবের রুমের দিকে এগোলেন। আমি নিজের স্থান থেকে মোটেও নাড়াচাড়া করিনি। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, "দুই কাপ গ্রিন টি নিয়ে আসো। একটার মধ্যে চিনি বেশি এবং অপরটা চিনি ছাড়া। আর দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যেও।"
আমি উনার কথা অনুযায়ী দরজা ভিড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলাম গ্রিন টি তৈরি করতে। গ্রিন টি বানানোর সময় সর্বদা আমার মাথায় একটি প্রশ্ন ঘুরপাক করতো; "এটা আগের থেকেই এত তিক্ত, স্বাদে আমি বিরক্ত; তবুও দেখি ইহা পান করেই যাচ্ছে অহরহ ব্যক্তিত্ব।" এটা ছিল আমার অবসর সময়ে কবিতা চর্চার ছোট্ট একটি নমুনা। অতঃপর গ্রিন টিও তৈরি হয়ে গেল। ট্রেতে করে তাদের উভয়ের জন্য গ্রিন টি পরিবেশন করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু রুমের কাছে যাওয়ার সময় শব্দ পেলাম তাদের ঝগড়ার। এত আপন মানুষ হয়েও, এত তীব্র স্বরে ঝগড়া! বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে তাদের নিয়ে। আমি প্রথমে রুমে প্রবেশ করার সাহস পাচ্ছিলাম না, তাই চা এর ট্রে হাতে নিয়েই, ভেড়ানো দরজাটার ঠিক বাহিরেই, কিছুক্ষণ দাড়িয়ে ছিলাম। আমাকে দরজার ফাঁক দিয়ে খেয়াল করতে পেরে, ম্যাডাম ভিতরে ডেকে জিজ্ঞাস করলেন, "কি হলো? এভাবে বাহিরে দাড়িয়ে ছিলা কেন?"
আমি ঘাবড়ে গিয়ে এক মোটা ঢোঁক গিললাম। সাহস করে উনার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম, "জি, আসলে হয়েছিলটা কি; আমি আসার সময় কিছু চিল্লাচিল্লির শব্দ শুনে থমকে গিয়েছিলাম। মনে করেছিলাম, এমন সময়ে হঠাৎ প্রবেশ করা উচিত না।"
কিছুটা চিন্তিত স্বরে, সন্দেহের নজরে আমার তরফ তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলেন, "কতক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছো এখানে এবং আমাদের কথাবার্তার কতটুকু শুনেছ?"
আমি উনার প্রশ্ন শুনে চমকে উঠে উত্তরে বললাম, "জি, আমি তো মাত্র আসলাম এবং কথাগুলো তেমন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না। তাই চিল্লানোর শব্দ শুনতে পেলেও, কিছুই বুঝতে পারিনি।"
"সত্যি তো?"
"জি, আপনার বিশ্বাস না হয়ে থাকলে, আপনি স্বয়ং দরজার বাহিরে দাড়িয়ে দেখতে পারেন।"
"আচ্ছা! এ কথা? ঠিক আছে! তাহলে দেখে আসি তো আমিও।" এটা বলেই উনি দরজার দিকে এগোতে লাগলেন। তখনই অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের বাম হাত দিয়ে উনার হাত ধরে উনাকে থামিয়ে বললেন, "এই! এসব কি শুরু করেছ? বসো তো। মাথা ধরে গেল তোমার এসব কান্ড দেখে। উফ্!" এটা বলেই নিজের ডান হাতটা নিজের কপালে রাখলেন।
অ্যাডভোকেট সাহেবের স্পর্শ পাওয়াতে; ম্যাডামের চোখে কেমন আজব এক ঝলমলে ভাব দেখা যাচ্ছিল। আমি দেখে বেশ অবাক হলাম। উনার চেহারায় তো নেতিবাচক কোনো মনোভাবের লক্ষণই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অ্যাডভোকেট সাহেব যেমন শুধু হাতই থামাননি, তারই সঙ্গে থামিয়েছিলেন উনার অত্যাধিক মাত্রার ক্রোধ। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি; একটি বড়সড় আগুন নিমেষেই নিভে গেল শুধু একটি সামান্য ফুঁয়ের মাধ্যমে। আমি তো সেখানেই দাড়িয়ে এই বিস্ময়কর দৃশ্য দেখছিলাম। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে বললেন, "এই রাফি, তুমি এখন যেতে পারো।" উনার আদেশ অনুযায়ী আমি রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমের দিকে ফিরলাম। তবে এই কৌতহলী মনকে সামলাতে পারছিলাম না মোটেও। মন তো চাচ্ছিলো; এক্ষুনি গিয়ে তাদের সকল কথাবার্তা কান পেতে শুনি। এমন একটা সময়ে মনকে বোঝানো বেশ কঠিন একটা কাজ। এমন কি অতি গুপ্ত আলাপ আলোচনা চলছিল তাদের মধ্যে, যে আমার এতই কঠিনভাবে প্রশ্ন করা হলো? এগুলো তো জানার পুরোপুরি অধিকার রয়েছে আমার। কেননা, আমি শুধু একজন কাজের লোক নই, আমি অ্যাডভোকেট সাহেবের জীবনের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশও। আমার কাছে কিছু লুকোনো উনার মোটেও উচিত না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম; যেভাবেই হোক, উনাদের কথা শুনেই ছাড়ব।
অ্যাডভোকেট সাহেবের রুম ছিল ঠিক রান্নাঘরের সাথে লাগানো। আমি খুব আস্তে আস্তে হেঁটে গেলাম রান্নাঘরের ভিতরে। সেখানে একটি কাচের গ্লাস নিয়ে তার প্রান্তের পাশটা রাখলাম সেই দেয়ালে যেটা সেই রুমের সঙ্গে জড়িত। ছোটবেলায় একটা সিনেমার মধ্যে এমন করে গোপন আলাপ শুনতে দেখেছিলাম। এখনও এই পদ্ধতি মনে রাখাটা এভাবে কাজে আসবে, কখনও চিন্তাও করতে পারিনি। নিজেকে কেমন গুপ্তচরের মতো লাগছিল। আমি গ্লাসের নিচের অংশটিতে নিজের বাম কান রেখে অপর কান আমার ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে বন্ধ করে রাখলাম। যেসব কথা হচ্ছিল তাদের মধ্যে, তা শুনে তো আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি শুনতে পারছিলাম; ম্যাডাম বলছিলেন, "চা বেশ ভালই হয়েছে। ছেলেটার মধ্যে চা সম্পর্কে ভালই জ্ঞান আছে।"
অ্যাডভোকেট সাহেব বলছিলেন, "তা তো আছেই! ট্রেইনার কে, বুঝতে হবে না? হা হা হা!"
"বাহ্! আজকাল এই কাজও নিজের ব্যস্ততার বাহানাগুলোর মধ্যে তালিকাভুক্ত করে ফেলেছ? সুন্দর তো!"
"করতেই পারি। অবসর সময় থেকে তো আমার এলার্জি আছে, এটা তো তুমি ভাল করেই জানো।"
"জানি দেখেই তো বেশি প্রশংসা করিনি।"
"প্রশংসা থেকে মনে পড়ল; গতরাতে তোমার উপহার ট্রায়াল দিয়ে দেখেছিলাম।"
"তাই? দুইটা বছর পর!"
"হ্যাঁ! সরি!"
"যাক্! কেমন লাগল?"
"ভালই! বেশ উন্নতমানের। আর এডজাস্ট করার ফিচারটি আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।"
"তোমার পায়ের উঁচু-নিচু গঠনের জন্যই এটা নিয়েছিলাম।"
"কত্ত খেয়াল রাখো আমার! কিন্তু আমি এটা ব্যবহার করবো না।"
"কেন? কি সমস্যা এটায়?"
"এটায় কোন সমস্যা নেই। সমস্যাটা মূলত আমার।"
"কি সমস্যা তোমার?"
"দেখো, ব্যাপারটা একটু জটিল হলেও, সহজ ভাষায় বলতে গেলে; এটা আমার জন্য লজ্জাজনক একটি বস্তু।"
"সেটা কিভাবে?"
"দেখো, আমি বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে থাকি। আমাকে ডাকার মূল কারণটাই হচ্ছে গিয়ে; আমি হাঁটতে অক্ষম, কিন্তু কথায় আমার দম। অচল হলেও, অসীম মর্যাদার অধিকারী। আমি এই হুইলচেয়ারের সাহায্য ছাড়া নিজের রুমেও প্রবেশ করতে পারি না, কিন্তু আমার সাহায্য নিয়ে অনেকে কারাগার থেকে বের হবার সুযোগ পেয়ে থাকে। এগুলো হলো এখনকার বিশেষ একটি চলমান ট্রেন্ড। আমাকে দেখে অসংখ্য মানুষ অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকে। আমার দেহের নিচ থেকে এই হুইলচেয়ার সরিয়ে ফেললে, আমার পরিচয়ের একটি ক্ষুদ্র এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই আমি নিজের সামান্য মানসিক তৃপ্তির উদ্দেশ্যে, অসংখ্য অসংখ্য মানুষের কাছে নিজের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে রাজি নই।"
"অসংখ্য অসংখ্য অজানা লোকের কথা চিন্তা করে শুধু নিজের নয়, আমার ইচ্ছাকেও মাটি দিচ্ছ।"
"তোমার ইচ্ছাকে শ্রদ্ধা করি বলেই এটা ট্রায়াল দিয়ে দেখেছিলাম। এবার তোমাকে অনুরোধ করছি আমার ইচ্ছাকেও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য।"
"বাহ্! অনেক সুন্দর একটু উত্তর তো! এত সুন্দর উত্তর কোথা থেকে শিখলে? আমিও শিখতে চাই।"
"হা হা হা! শিষ্যকে স্য়ং গুরুই প্রশ্ন করছে! মজা পেলাম।"
"মজা তো পাবেই! তোমার কাছ থেকে আর কি আশা করা যায়?"
"আশা করার কোনো সীমাবদ্ধতা আছে নাকি? আমিও তো তোমাকে নিয়ে কত আশা প্রত্যাশা করেছিলাম, তার সবই কি পূরণ হয়েছে? সেগুলোর কোনোটাই তো পূরণ হয়নি।"
"পূরণ হবে কি করে? তোমার অহংকার তো আর কমার নাম নেয় না।"
"আমার অহংকার!"
"জি!"
"তোমার বাবার দুর্ব্যবহার ভুলে গিয়েছ বোধহয়। একটু স্মরণ করিয়ে দিই?"
"কোন দুর্ব্যবহারের কথা বলছো তুমি?"
"আমাকে প্রথম দেখাতেই তোমার দিকে ঘুরে অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকানো, নাক সিটকানো, কথায় কথায় ঘরের চারপাশে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকানো। এগুলো কি শিষ্টাচার? আমাকে তো উনি মানুষ হিসেবে গণ্য করতেই রাজি না। এমন লোকের সঙ্গে কীভাবে ভাল আচরণ করা যায়?"
"উনি দেশের সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রাপ্ত একজন রিটায়ার্ড কর্নেল হয়েও, একমাত্র আমার অনুরোধে তোমার বাসায় প্রস্তাব নিয়ে আসলেন। তাও উনার ছোটখাটো কথাগুলো এভাবে ধরলে?"
"উনার চেয়ে বেশি মর্যাদা তো এখন আমারই। কিন্তু আমি তো এসব বৈষম্য থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছি। আমি তো মানুষের বাসায় গেলে এমন উদ্ভট আচরণ করি না।"
"তোমার এই মন-মানসিকতার জন্যই আজ আমাকে একজন এমন লোকের সঙ্গে সংসার করতে হচ্ছে, যে থাকেও দেশের বাহিরে, আর ফিরলেও সারাদিন-সারারাত বাহিরে কাঁটায়।"
"রাতটা কোথায় কাঁটায়? জুয়ার আড্ডায়? মদের আড্ডায়? নাকি পতিতালয়ে?"
"সে যেখানে খুশি সময় কাঁটাক! এতে আমার কিছু যায়-আসে না।"
"স্বামী তোমার, আর তোমারই কিছু যায়-আসে না? অদ্ভুত তো!"
"কিছু তো আর করার নেই। একা একাই রাত্রি যাপন করতে হয়।"
"সেই রাত্রিগুলো আমার সাথেই কাটাতে পারো। আমি তো তোমার জন্যই আছি।"
"তোমার মাথায় কি সারাটা দিন এসব ঘুরে?"
"মানে কি? তুমি তোমার সমস্যা আমার কাছে বললা আর আমি তার সমাধান বললাম। আমার এইসব পরামর্শের জন্য তো আমি অন্যদের কাছে টাকা চার্জ করি। ফ্রিতে পাচ্ছ বলে দাম দিচ্ছ না!"
"দাম কি শুধু তোমার পরামর্শের রয়েছে? আমার দেহের, আমার ভাবনার কোনো দাম নেই?"
"দাম আছে বলেই তো মূল্যায়ন করতে চাই।"
"এভাবে তুচ্ছ করে, যৌন হয়রানিমূলক কথাবার্তা বলে, মনের ভাব নিয়ে হাসিঠাট্টা করে মূল্যায়ন করতে চাচ্ছিলে?"
"বহুবছর আগেই এগুলো বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখন তোমার মাথায় সংসার করার ভূত চড়ে ছিল। তখন তো আদর্শ স্ত্রী হবার কথা বলেছিলে। সেগুলি আজ মনে করাচ্ছি তোমাকে বোঝানোর জন্য, তখন আমার মনটা কেমন করছিল।"
"তখন আমার আর কি করার ছিল, বলো? আমার পরিবার তো মোটেই রাজি ছিল না।"
"তোমার গর্ভে আমার সন্তান থাকলে তারা সবাই রাজি হতে বাধ্য হতো।"
"এসব নোংরা কথা ছাড়া অন্য কিছু বলার থাকলে বলো।"
"এতে নোংরামি কীসের? তুমি কি জন্মগ্রহণ করোনি? তোমার দুনিয়াতে আসায় কি তোমার মা নোংরা হয়ে গিয়েছিল?"
"আমার মা এসব বিয়ের পর করেছিল।"
"এটার আদৌ কোনো প্রমাণ রয়েছে তোমার কাছে? কোনো প্রমাণ আছে তোমার মায়ের কুমারীত্বের? কোনো দলিলপত্র, কোনো প্রমাণপত্র, কোনো ডাক্তারের মেডিক্যাল রিপোর্ট?"
"সেই একই যুক্তি তোমার মায়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।"
"আমি তো এমন কোনো দাবি করিনি।"
"এমন দাবি তো আমিও করিনি।"
"কুমারীত্বর দাবি কি আমার ছিল?"
"আমার মানে ছিল; বিয়ের পূর্বে এসবকে নোংরামিই বলা হয়।"
"সেক্ষেত্রে আমিও তো বলতে পারি; আমরা একটা কাজী অফিসে গিয়ে, পালিয়ে বিয়ে করে, এসব করতে পারতাম।"
"সেসময় তো পালিয়ে বিয়ে করার কোনো আগ্রহ পোষণ করোনি! হঠাৎ কেন?"
"সেসময়ও আমার মাথায় এটা ছিল, কিন্তু তুমি যখন ফোনে কেঁদে কেঁদে বলছিলে যে কোনোভাবেই কিছু সম্ভব না, কিছুই করার নেই, সবই শেষ হয়ে গিয়েছে, তোমাকে ভুলে যেতে; আর কি কি হাবিজাবি, তখন আমার মাথাও গরম হয়ে গিয়েছিল। তখন তো তোমার মুখ দেখবার জন্য প্রতিই রুচি চলে গিয়েছিল, ভালবাসা তো অনেক দূরের কথা। আমি মনে করেছিলাম অনেক বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছ, তাই আর জোরপূর্বক কিছু করাতে চাইনি।"
"বাদ দাও। এখন এসব কথার কোনো লাভ নেই।"
"লাভ আছে কি না, সেটা যদি বোঝার মতো জ্ঞান যদি তোমার থাকতো, তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না আমাদের। এভাবে রিপোর্ট নেওয়ার বাহানা করে ঘর থেকে বের হওয়া, আমার সঙ্গে এসে এই সামান্য কিছু সময় কাটানো, প্রতিটা রাত এই কষ্টে শুয়ে থাকা।"
"তাহলে তুমিই বলো এটার কি সমাধান রয়েছে? সেও আমাকে তালাক দিচ্ছে না, আর আমিও তার সম্মতি ছাড়া তালাক নিতে পারব না। সে বিদেশে কার কার সাথে কি কি করে বেড়ায় আর এখানে এসে দিনরাত কোথায় থাকে, সেসব নিয়ে আমার হাতে কোনো মজবুত প্রমাণও নেই। তাহলে কীভাবে কি করবো উকিল সাহেব? বলুন! একজন মক্কেল হিসেবে প্রশ্ন করছি আপনাকে। বলুন!"
"যদি মক্কেল হিসেবে প্রশ্নটা করে থাকেন, সেটার মূল্য অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। তা কি পারবেন?"
"আপনার সেবার মূল্যটুকু বলুন। সাধ্যে থাকলে অবশ্যই পারব।"
"সেক্ষেত্রে কাছে আসতে লাগবে।"
"জি, এতটা কাছে ঠিক আছে?"
"আরেকটু কাছে।"
"জি, এবার ঠিক আছে?"
"হ্যাঁ! এবার আমার কৃষ্ণবর্ণ গালে আপনার গোলাপি ঠোঁটের দ্বারা একটা ছাপ বসিয়ে দিন।"
"একটু বেশিই চড়া দাম চেয়ে বসলেন না?"
"এই দাম ছাড়া আমার সেবা প্রদান করা সম্ভব না।"
"তাহলে থাক, বাবা! অন্যথায় গিয়ে দেখতে হবে তাহলে।"
"আরে মিস, কোথায় যাচ্ছেন? আপনার পরামর্শ তো নিয়ে যান!"
"কমে দিলে দেন, নাহলে যাই।"
"ঠিক আছে, বাবা! ঠিক আছে! ইশশ! এত্ত ড্রামা!"
"এবার আসল কথায় আসি। কিছু করা যাবে এক্ষেত্রে?"
"তাকে খুন করা যেতো, কিন্তু তার ঠিক পরপর তোমাকে বিয়ে করলে আমরা সন্দেহের শিকার হতাম। আবার তাকে কোনো কেসে ফাঁসিয়ে, জোর করে তালাক দেওয়ানো যেতো, তবে সে মুখ খুললেই আমরা ধরা। নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলা দিতে পারো, কিন্তু সেটা প্রমাণের জন্য তোমার দেহে আঘাতের দাগ লাগবে, সেগুলো আবার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখবে, নির্যাতনের কারণও তেমন একটা দিতে পারবে না, তারপর তদন্ত করলে তো শেষমেশ আমার উপরেই সন্দেহ আসবে।"
"তাহলে কি কোনো উপায় নেই?"
"একটা উপায় রয়েছে!"
"কি?"
"সে যদি অন্য কারো সঙ্গে ব্যভিচার করতে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়, তাহলে।"
"সেটা কে করবে?"
"আমার পরিচিত একজন এই কাজটা করতে পারে।"
"তাহলে, তাড়াতাড়ি এটার ব্যবস্থা নাও।"
"কিন্তু তার আগে আমার কিছু শর্ত রয়েছে।"
"কেমন শর্ত?"
"তুমি যে আমাকে ধোঁকা দিয়ে যাবে না, সেটার প্রমাণ চাই।"
"তা কীভাবে প্রমাণ করব? একটা কাগজে লিখে, সেটায় স্বাক্ষর করে দিব?
"আরে, না! না! কি বলছ? তোমার মতো একজন অতি ভদ্র নারীর জন্য সবচেয়ে বড় প্রমাণপত্র হবে তোমার এই দেহ। একটা রাতের বিনিময় তোমায় চিরকালের জন্য মুক্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিব।"
"পাগল হয়ে গিয়েছ তুমি? আমার পক্ষে এসব সম্ভব না। যদি আমাকে প্রকৃতপক্ষে ভালবেসে থাক, তাহলে এমন বায়না আর ধরবে না।"
"কেনো গো? তোমার কষ্ট দূর করার জন্যই তো এই আয়োজন। তোমার তালাক হয়ে গেলে তো আমরা একত্রিত হয়ে পড়বই। তাহলে দ্বিধা কীসের?"
"একজন পুরুষ এবং মহিলার মাঝে মিলন ছাড়াও একটা বন্ধন থাকে, তার নামই ভালবাসা।"
"বাহ্! চমৎকার তো! কোন সিনেমার ডায়লগ এটা?"
"যা সত্য, তা ই বলছি।"
"তাহলে কি তুমি বলতে চাও; শারীরিক মিলন মিলন ভালবাসার কার্যকলাপের বহির্ভূত? এটি কি সম্পূর্ণরূপে একটি পৃথক সত্তা?"
"অবশ্যই! কেন, ভালবাসা কি শারীরিক মিলন ছাড়া সম্ভব না?"
"সম্ভব, কিন্তু পুরোপুরি না।"
"কেন? এর এমন কি দরকার?"
"সেটা বুঝতে হলে তোমার একটি উদাহরণের প্রয়োজন। দাঁড়াও! একটি উদাহরণের ব্যবস্থা করছি। এই রাফি! এই রাফি!"
অ্যাডভোকেট সাহেবের ডাক শুনার সঙ্গে সঙ্গে গ্লাস জায়গামতো রেখে দিয়ে, আস্তে আস্তে হেঁটে, নিজের রুমে গিয়ে, সেখান থেকে উনার রুমে গিয়ে হাজির হলাম। এভাবে করে গেলাম যাতে সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছানোর জন্য সন্দেহ করতে পারতেন। কিন্তু রুম থেকে হেঁটে আসার সময়ের কারণে এই সন্দেহ এড়াতে সক্ষম হলাম। রুমে প্রবেশ করার পরে এডভোকেট সাহেব আমাকে বললেন , "তিনটা ম্যাচ এর বাক্স এবং এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো। "
আমি কিছু না বলেই , চুপচাপ গিয়ে তিনটি ম্যাচ এর বাক্স আর এক গ্লাস পানি নিয়ে আসলাম। তা রেখে আবার পূর্বের মতো দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে, চলে যাবার ভান করলাম। কিন্তু এবার আমার কৌতহল ছিল দ্বিগুণ। কেননা এবার অ্যাডভোকেট সাহেব খুবই রসাত্মক এবং আকর্ষণীয় একটি বিষয়ে উদাহরণ দিতে যাচ্ছিলেন। এ দৃশ্য তো কোনোমতেই না দেখে থাকা যাবে না।
আমি আবার আস্তে করে দরজার বাহিরে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। উনাদের আলাপ শোনার পাশাপাশি কিছু গোপন দৃশ্য দেখার আশায় দরজার চাবির ছিদ্রের ফাঁকে, বাম চোখ রেখে সব দেখছিলাম।
দেখতে পাচ্ছিলাম;
অ্যাডভোকেট সাহেব ম্যাচের বাক্সগুলো টেবিলের উপর এমনভাবে সাজিয়ে রেখেছেন, যে তার মধ্যে মাঝের বাক্সটা উনার কাছের দিকে এবং অবশিষ্ট দুটো বাক্স ম্যাডামের কাছের দিকে। তাছাড়া পানির গ্লাসটি অ্যাডভোকেট সাহেবের হাতের ডান পাশে রাখা; ঠিক সেই অবস্থায়, যে অবস্থায় তা রেখেছিলাম। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের হাতের ডান পাশের ম্যাচের বাক্সটা হাতে নিয়ে তার ভিতরের কাঠিগুলো বেড় করে, সবগুলো কাঠি মুঠোয় নিয়ে, কাঠির মুখের অংশটুকু গ্লাসে দুবোলেন, কিন্তু অবশিষ্ট অংশটুকু শুকনো রেখেই গ্লাস থেকে উঠিয়ে ফেললেন। কাঠিগুলো বেড় করে, টেবিলে রেখে ম্যাডামের কাছে প্রশ্ন করলেন, "আচ্ছা বলতো, এই কাঠিগুলো এই বাক্সের পাশে ঘষলে কি আগুন জ্বলবে?"
তার উত্তরে ম্যাডাম বললেন, "এ কি ধরনের প্রশ্ন? ভিজা কাঠি দিয়ে কি আগুন জ্বলবে কখনও?"
"জ্বলবে না কেন?"
"কারণ ভিজা কাঠি তো আগুন জ্বালাতে অক্ষম।"
"এই তো! এবার এসেছ মূল কথায়। আচ্ছা এখন বলতো, এই বাক্সের পাশে যদি শুকনো কাঠি দিয়ে ঘষা দিই, তাহলে কি এটা জ্বলবে?"
"হ্যাঁ! অবশ্যই!"
"কেন?"
"কারণ সেটা আগুন জ্বালানোর জন্য উপযুক্ত।"
"ভেরি গুড! এ গেলো প্রথম উদাহরণ। এবার দ্বিতীয়টি।" বলেই অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের হাতের বাম পাশের ম্যাচের বাক্সটা হাতে নিয়ে, গ্লাসের মধ্যে নিজের ডান হাতের আঙ্গুল ভিজিয়ে, সেই ভিজা আঙ্গুলটা সেই বাক্সের দুপাশে ঘষে, ভিজিয়ে নিলেন। অতঃপর সেই বাক্স থেকেই একটা কাঠি বেড় করে, বাক্স এবং কাঠি উভয়ই দিলেন ম্যাডামের কাছে। ম্যাডামের কাছে তা দিয়ে বললেন, "এই বাক্সের পাশে ঘষা দিয়ে আগুন জ্বালানো যাবে?"
উত্তরে ম্যাডাম বললেন, "না! কারণ এবার বাক্সটাই অক্ষম।"
"সাব্বাশ! এবার তৃতীয় উদাহরণে যাওয়ার পূর্বে একটা ছোট্ট প্রশ্ন করবো।"
"হ্যাঁ, বলো।"
"দুটো ম্যাচের বাক্স এবং কাঠি একই ধরনের হবার সত্ত্বেও, এদের অক্ষম হবার কারণ ভিন্ন হলো কেন? অর্থাৎ, উভয় পক্ষের লক্ষ্য যদি একই হয়ে থাকে, তবে এদের ব্যর্থতার কারণ ভিন্ন কেন?"
"কারণ তাদের উভয়কেই সফল হতে একে অপরের সহায়তার প্রয়োজন এবং উভয়পক্ষকে অবশ্যই সমানভাবে সক্ষম হতে হবে। কেবল একটিমাত্র পক্ষও যদি অক্ষম হয়ে থাকে, তবে তার প্রভাব পড়বে উভয়ের কার্যকারিতার উপর।"
অ্যাডভোকেট সাহেব একটা ছোট্ট হাততালি দিয়ে বললেন, "বাহ্! এত সুন্দর করে তো আমিও বিশ্লেষণ করতে পারতাম না। অসাধারণ হয়েছে। চলো, এবার তৃতীয় উদাহরণের দিকে আসি।" বলেই উনি নিজের দেহের নিকটবর্তী ম্যাচের বাক্সটা হাতে নিয়ে, তার একটা কাঠি বেড় করে, সেই বাক্সের পাশে ঘষা দিয়ে, আগুন ধরিয়ে, তা ধরে রেখেছিলেন। কাঠিটা উনার হাতেই ছিল যখন পর্যন্তনা; সেই জ্বলন্ত কাঠিটি পুড়তে পুড়তে, নিজের দুই তৃতীয়াংশ সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে, নিজে নিজেই নিভে যায়। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব বললেন, "কিছু খেয়াল করেছ?"
কিছুটা চমকে উঠে ম্যাডাম জিজ্ঞাস করলেন, "কি?"
"এই আগুনটা হলো প্রেম, কাঠি এবং বাক্স হলো দেহ, পুড়ে যাওয়া অংশটুকু হলো প্রেমের গভীরতা এবং ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাওয়া অংশটুকু হলো দূরত্ব। দাম্পত্য জীবন নামক মাটিতে, প্রেম নামক বীজ রোপণ করার প্রক্রিয়া হলো এই শারীরিক মিলন। এবার বুঝতে পেরেছ ব্যাপারটা?"
"হুম! তবে আমার একটা জটিল প্রশ্ন রয়েছে। তার উত্তর দিতে পারলে মেনে যাবো।"
"হ্যাঁ, বলো! বলো!"
"বিয়ের রাত তো আমার স্বামীর সঙ্গে আমার সেই মিলন ঘটেছিল, তাহলে আমি কেন তাকে ভালবাসি না?"
"তুমি তো বলছিলা; প্রশ্নটা জটিল হবে। কিন্তু এ তো খুবই সহজ একটা প্রশ্ন।" এটা বলে অ্যাডভোকেট সাহেব এবার পুরোপুরি শুকনো এবং সক্ষম বাক্সটি থেকে একটা কাঠি বেড় করে, তার মুখের অংশটুকু নিজের ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে ধরে, উল্টো করে, কাঠির শরীরটা গ্লাসের ভিতরে দিয়ে, ভিজিয়ে নিলেন। তবে এবার কাঠির মুখখানা শুকনো রেখে দিলেন। সেই কাঠিটা নিজের বাম হাতে, সোজা করে ধরলেন। ম্যাচের বাক্সটা ডান হাতে নিয়ে, তার পাশে সেই কাঠির মুখ ঘষে, আগুন ধরালেন। আগুনটা গতবারের কাঠির মতো নিজের আগুন কাঠিটার দুই তৃতীয়াংশ জ্বালাতে পারল না। আগুন নেভার পরে অ্যাডভোকেট সাহেব সেই কাঠি দিলেন ম্যাডামের হাতে। কাঠিটা উনার হাতে দিয়ে বললেন, "এবার দেখো; কাঠিটা জ্বলেছে ঠিকই, কিন্তু নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। বলতো, সেটা কেন হলো? কেন বাকি অংশটুকু কেন পুড়েনি?"
"কারণ এবার পুরোপুরি অক্ষমতা না থাকলেও, আংশিক ত্রুটি ছিল।"
"আংশিক ত্রুটি কি করে? উভয়পক্ষই নিজ নিজ ভূমিকা পালন করল, ঘষা লাগার পর আগুনও ধরল, কোনো রকমের বাধাও ছিল না। আংশিক ত্রুটি আবার কোথায় পেলে?"
"কাঠির দেহটা আগুন দ্বারা পুরোপুরি পুড়তে পারেনি। কারণ কাঠির দেহ ছিল ভিজা, যা তার কার্যকারিতায় কোনো বাধা না সৃষ্টি করলেও, একটা ছোটখাটো সমস্যার সৃষ্টি করেছে। কাঠির অবশিষ্ট অংশটুকু আগুনের স্পর্শ হতে বঞ্চিত থাকল এই পানির কারণে। তাই কোনো প্রকার ত্রুটি না থাকা সত্ত্বেও তার একদিক দিয়ে দুর্বলতা বিদ্যমান ছিল।"
"অসাধারণ! চমৎকার উপস্থাপনা! এবার একটা জিনিস খেয়াল করো; তুমি সেই একটি রাতের বিনিময়ে অসংখ্য রাতের কর্মফল আশা করছো। তাহলে তুমিই এবার বলো; সেই একবারের পর আর কখনওই তার স্পর্শ না পাওয়া কি সেই আংশিক অক্ষমতা নয়?"
অ্যাডভোকেট সাহেবের উত্তরটা শোনার পর, ম্যাডামের চেহারায় আশ্চর্য ভাবটিকে দেখে, যে কেউই খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারবে যে উনার প্রশ্নের সন্তোষজনক একটি উত্তর দেয়া হয়েছে। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব আরো বললেন, "তবে এখানে তোমাদের উভয়ের মধ্যে কারও সম্মতি বা রুচি না থাকার ফলে, এখন জোর করে মিলন করলেও কাজ হবে না। কারণ যদি আদৌ তোমাদের মনে ভালবাসা উৎপাদিত হবার ছিল, তা এত বছরে নিজ থেকেই হয়ে যেত। না সে থাকতে পারত তোমার স্পর্শ না পেয়ে, আর না তুমি থাকতে পারতে তার স্পর্শ ছাড়া। এখন চেষ্টা করেও কিছু করা সম্ভব না। আলাদা হয়ে, নিজ নিজ সঙ্গী খুঁজে বেড় করো।"
কথাটি শুনে হঠাৎ চমকে উঠে ম্যাডাম বললেন, "খুঁজে বেড় করো মানে?"
"মানে, হতে পারে সেই সঙ্গী নই, বরং অন্য কেউও তো হতে পারে, তাই না?"
"এতক্ষণ এত কিছু বলার পর একথা বলছো? আগে বললেই তো পারতে। আমাদের দুজনের সময়ই বেঁচে যেত।" বলে অ্যাডভোকেট সাহেবের মূখের দিক থেকে দৃষ্টি চাপিয়ে, বাম দিকে মুখ করে নিলেন। এ দৃশ্য দেখে অ্যাডভোকেট সাহেবের চেহারায় হাসি ফুটে উঠল। দেখে মনে হচ্ছিল, উনি ম্যাডামের রাগ দেখে খুবই খুশি। যেমন কোনো বিশেষ প্রকারের সংকোচ দূর হয়ে এবার সন্তুষ্টি পেলেন। তবে সেই হাসিটার রহস্য কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পেলাম যখন অ্যাডভোকেট সাহেব বললেন, "খুবই ভাল লাগল তোমার এই প্রতিক্রিয়া দেখে।"
এ কথা শুনে, ম্যাডাম আশ্চর্য হয়ে, উনার দিকে ঘুরে, জিজ্ঞাস করলেন, "এ কি বোকছো? মাথা ঠিক আছে তো? চায়ের মধ্যে কিছু মেশানো ছিল না তো আবার?"
"না গো! আমি ঠিকই আছি।"
"তাহলে এসব কি বলছ হঠাৎ? কি প্রতিক্রিয়া দেখে ভাল লাগল?"
"তুমি যেভাবে ব্যাপারটা হজম করতে পারলে না, রাগ করে বলে; খুবই ভাল লাগল আমার কাছে।"
"কেন? এতে ভাল লাগার কি আছে?"
"তোমাকে অন্য কাউকে খুঁজতে বলাটা তোমার এক মুহূর্তের জন্যও সহ্য হয়নি। এটাই সেই ভালবাসা যার জন্য আমি এত বছর ধরে অপেক্ষায় রয়েছি। আমাদের মাঝে তো এই অনুভূতি শুরু থেকেই বিদ্যমান যা তোমার সঙ্গে মিলনের মাধ্যমেই নিজের সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছাতে পারবে।"
আমার ঢাকায় আসার গল্প ছিল কিছু এইরকম;
এসে গুলিস্থান থেকে আরেকটি বাস ধরে সোজা গেলাম নদীর ওপার কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন নামের স্থানে। এখনও মনে আছে, সেদিন বাসের মধ্যে দুজন বেশ শিক্ষিত যুবক যাচ্ছিল আমার ঠিক সামনের সিটে বসে। সেই দুজন কোন এক সিনেমা দেখার জন্য নাকি টিকেট কিনে আনল। তাদের মধ্যে একজন টিকেট নিয়ে টানাটানি করাতে আরেকজন চিৎকার করে উঠেছিল, "এমন করিস না তো! ছিড়ে গেলে ছয় শত টাকা পানিতে।" এই কথাটা শোনার পর এই শহরের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা হয়ে গেল। আমি সেই বাসের সিটে বসে হিসাব নিকাশে লেগে পড়লাম। মা আগেই বলেছিল, ঢাকা কিন্তু যশোরের মতো না। তাও আমি কোনোভাবেই বুঝতে পারছিলাম না, কীভাবে করে কেউ ছয় শত টাকা দিয়ে একটা চলচ্চিত্র দেখতে যায়। অদ্ভুত ব্যাপার লাগল আমার কাছে! বেশ অদ্ভুত! এই হিসাব নিকাশ করতে করতে পৌঁছে গেলাম কেরানীগঞ্জ। বাড়ির ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে মাথায় সেই একই হিসাব নিকাশ চলছিল। সেই এলাকার এক মুদি দোকানিকে অ্যাডভোকেট সাহেবের বাসার ঠিকানা জিজ্ঞাস করাতে চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে, স্পষ্টভাবে পথ দেখিয়ে দিল। আমি সেই অনুযায়ী চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম সেই ঠিকানায়। বাড়ির দরজায় ঠকঠক করায় একজন বেশ বৃদ্ধ লোক দরজা খুললেন। উনার চেহারা দেখে বয়স প্রায় সত্তর-পঁচাত্তর মনে হচ্ছিল। লোকটা আমার দিকে কিছুক্ষণ ভাল করে তাকিয়ে বললেন, "যশোর থেকে এসেছেন নাকি?"
"হ্যাঁ।"
“নাম কি?"
"জি, রাফি।"
"হুম! ভেতরে আসো।"
আমি ভেতরে প্রবেশ করার সাথে সাথে আমার কাঁধের ব্যাগটা রেখে, জুতো জোড়া খুলে, জুতোর তাকের উপর রাখার সময় কিছু অদ্ভুত খেয়াল করলাম। এত বিশাল বাড়ির মালিক হবার পরও তাকের মধ্যে অ্যাডভোকেট সাহেবের একটা জুতোও দেখতে পারছিলাম না। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ সেখানেই তাকিয়ে ছিলাম। আমার এইভাবে মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকা অবস্থা দেখে সেই বৃদ্ধ লোকটা খিটখিটে স্বরে বললেন, "কি হলো? এভাবে হা করে কি দেখছ?" আমি চমকে উঠলাম এবং তৎকালীন সময়ে উত্তর স্বরূপ বললাম, "জি, কিছু না।" তারপর একটু সামান্য নীরবতার পর জিজ্ঞাস করলাম, "আচ্ছা, অ্যাডভোকেট সাহেব কি বাসায় নেই?"
বৃদ্ধ লোকটি আমার প্রশ্নটা শুনে কেমন বিস্মিত হয়ে আমার চেহারার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলেন, "তুমি কি সেই খালি জুতোর তাক দেখে এই প্রশ্নটা করেছ, বাবা?" লোকটার কথার মধ্যে কেমন এক আজব ভাবভঙ্গি লক্ষ করলাম। প্রশ্নটা করা বোধহয় আমার অপরাধ হয়েছে। তবুও জানার কৌতুহোলের কারণে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, "জি!"
বৃদ্ধ লোকটা এক মুচকি হাসি দিয়ে চুপচাপ বাসার ভেতরের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। আমি এই আচরণটা দেখে খুবই অবাক হলাম। কিন্তু কোন কিছু না বলেই উনার পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগলাম। বাসাটা বাহির থেকেই এত বিশাল, ভেতর দিয়ে তো আরো বিশাল জায়গা রয়েছে। এখানে প্রতিদিন কমপক্ষে দশ বার হাঁটাহাটি করলেও একজন ডায়াবেটিস রোগীর আর কোনো চিন্তাই থাকবে না। তবে জমিনের দিকে তাকালে দেখতে পাই খুবই লম্বা লম্বা দুটো রেখা যা পরস্পরের চেয়ে সমান রয়েছে। দাগগুলো দেখতে অনেকটা সাইকেলের চাকার দাগের মতো। কিন্তু প্রশ্নের বিষয় হলো, বাসার ভিতরে দুটো সাইকেল কে চালাবে?
এই কথা চিন্তা করতেই না করতে এসে হাজির হলাম অ্যাডভোকেট সাহেবের সামনে, আর উনাকে দেখার পরে আমার মনে তৎকালীন জাগ্রত সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম।
অ্যাডভোকেট সাহেব দুটো হাত দুপাশে ছড়িয়ে, রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে রয়েছেন। উনি বসেছিলেন একটি হুইলচেয়ারে। উনার পা এর দিকে তাকিয়ে অনুমান করলাম, এটা নিশ্চয়ই কোনো দুর্ঘটনার ফল। কেননা জন্মগত পা না থাকা লোকের পায়ের গঠন কিছুটা ভিন্ন হয়। রুমে প্রবেশ করার আগেই অ্যাডভোকেট সাহেব আমাদেরকে হাত দিয়ে ইশারা করে, থেমে যেতে বললেন। তারপর সেই বৃদ্ধ লোককে উদ্দেশ্য করে আরেকটি অদ্ভুত ইশারা করলেন। ইশারা দেখে খুবই অবাক হলাম, কিন্তু কিছু জিজ্ঞাস করার সাহস পেলাম না। ইশারা পেয়ে, কোনো কথা না বলেই, চুপচাপ সেই বৃদ্ধ লোকটা আমাকে নিয়ে গেল বাথরুমের কাছে। সেখানে আমাকে বললেন, "তুমি মাত্র এত বড় একটা সফর কেটে এসেছ, তাই উকিলবাবু তোমার সঙ্গে এই অবস্থায় দেখা করবে না। উনি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন। তাই তোমাকে আগে গোসল করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে।" এটা শোনার পর কিছুক্ষণ অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। অতঃপর উনি জিজ্ঞাস করলেন, "কি হলো বাবা? কি চিন্তা করছ? বুঝতে পারনি আমার কথা?" আমি সাথেসাথে নাবোধকভাবে মাথা নাড়িয়ে বললাম, "না! বুঝতে পেরেছি।" এরপর গোসল করে, কিছুক্ষণের মধ্যে অ্যাডভোকেট সাহেবের সামনে উপস্থিত হলাম। উনার রুমের বাহির থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম, উনি একটা পুরাণ আমলের সাদাকালো চলচ্চিত্র দেখছেন। ছবির মান দেখে তো মনে হচ্ছিল, সিনেমাটির বয়স প্রায় সত্তর বছর তো হবেই। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব ইশারা করে আমাকে কাছে ডাকলেন। কাছে যাওয়াতে আবার ইশারা করে আমাকে উনার বাম পাশের সোফায় বসতে বললেন। সোফাটা দেখতে সামান্য সোফার মতো হলেও, বসার সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছিল আমি বাতাসের উপর বসে আছি। সোফাটার দামও নিশ্চয়ই তেমন মোটা অংকেরই হবে। অ্যাডভোকেট সাহেব ইশারা করে কাছে তো ডাকলেন ঠিকই, কিন্তু চুপচাপ টেলিভিশনের বিশাল পর্দার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। উনি এখন পর্যন্ত আমার চেহারা দেখেছেন কি না, সন্দেহ। অবশ্য, আমরা উভয়ই একে অপরের চেহারা দেখেছিলাম ছবির মাধ্যমে। ছবিতে অ্যাডভোকেট সাহেবের দেহের উপরিভাগটুকুই দেখা যাচ্ছিল, তাই কল্পনাও করতে পারিনি এমন কিছু দেখব। উনি তৎকালীন যে সিনেমাটা দেখছিলেন, সেটার মধ্যে খুবই অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলাম। সেখানে দেখলাম; একজন অত্যন্ত লম্বা ব্যক্তি খুবই আজব ভঙ্গিতে হাঁটছিল আর সেটা দেখতে আশেপাশের সবাই আতঙ্কে পালাচ্ছিল। সেখানে আরও দেখলাম; একজন চিকন মহিলা, দেখতে খুবই উদ্ভট, চুল উঁচু করে দাঁড়া করানো, সেই চুলের দুই পাশের দুটো অংশ সাদা। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ হাস্যকর মনে হলো বলে মুখ থেকে অল্প একটু হাসি বেড়িয়ে গেল। সেই মুহূর্তে নিজেকে থামাতে পারিনি। তবে মুখে চাপ দিয়ে হাসি থামানোর চেষ্টা করেছিলাম ঠিকই।
সিনেমা দেখা শেষ হবার পর টেলিভিশন বন্ধ করে আমাকে ইশারা করে দাঁড়াতে বললেন। আমি চুপচাপ দাড়িয়ে রয়ে গেলাম। অতঃপর একটু কাশি দিয়ে, গলা পরিষ্কার করাতে এই প্রথম উনার কন্ঠ শুনতে পেলাম। কি স্বর ছিল সেই কন্ঠের! সেই একটুকু শুনেই সিংহের গর্জনের কথা মনে পড়ে গেল। বাবা আসার আগেই বলেছিল উনার তুখোড় কণ্ঠস্বরের ব্যাপারে। বলেছিলেন, "অ্যাডভোকেট সাহেব যখন বিতর্কে নামেন, তখন যুক্তিও কান পেতে শুনে। আর উনার দক্ষতা এতটাই, যে চাঁদও যদি সূর্যের বিরুদ্ধে চুরি করা আলোর দাবি করে আদালতে মামলা করে, আর সেই মামলা যদি অ্যাডভোকেট সাহেব লড়েন, তাহলে সেই মামলাও অ্যাডভোকেট সাহেব মূহুর্তের মধ্যে জিতে যাবেন আর সূর্য নিজের আলো চাঁদকে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হবে।" বাবার কথাগুলো তখন তো বেশ হাস্যকর মনে হচ্ছিল, কিন্তু আজ সেই কথাগুলোই সত্য বলে মনে হচ্ছে। অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে প্রায় দশ মিনিটের মতো সেখানে দাঁড়া করিয়ে রাখাতে আমি আর সহ্য করতে না পেরে, হঠাৎ জিজ্ঞাস করে বসলাম, "অ্যাডভোকেট সাহেব, সারাদিন কি এভাবেই দাড়িয়ে থাকবো?" আমার প্রশ্নটি শুনে, মুখে এক মুচকি হাসির সঙ্গে বললেন, "খুবই অবাক করার মতো বিষয়, তাই না? কেউ দশ মিনিটও দাড়িয়ে থাকা সহ্য করতে পারে না, আর কেউ দশ বছরেরও বেশি সময় যাবত বসেই আছে। আমারও একসময় এই দাড়িয়ে থাকাটা বেশ বিরক্তিকর লাগত, কিন্তু এখন সেই বিরক্তি যেমন এক চাহিদায় পরিণত হয়েছে। উনার এই কথাগুলো শুনে, পুরোপুরিই নীরব হয়ে গিয়েছিলাম।
কিছু সেকেন্ডের সামান্য বিরতির পর হঠাৎ একজন কবির মতো করে, কবিতা আবৃত্তি শুরু করে বলতে লাগলেন, "অদ্ভুত এই অনুভূতি, অদ্ভুত এই বিরক্তি, অদ্ভুত এই জগৎ!
অদ্ভুত নদ-নদী, অদ্ভুত এই মানবজাতি, অদ্ভুত পাহাড় পর্বত।"
সেই লাইনগুলি অন্য কেউ আবৃত্তি করে থাকলে এতো মর্মান্তিক অনুভূতি কখনওই অনুভব করতে পারতাম না। শুধু উনি বলেই; সেই কন্ঠের ভার, সেই বলার রাজকীয় ভঙ্গি, সেই নিখুঁত উপস্থাপনা। এ সকল কিছুর একটির উপস্থিতিও না থাকলে, খুব একটা আবেগাপ্লুত হতাম না, কিন্তু এই সকল উপাদান আমাকে সেসময়ে বাধ্য করেছিল।
এ বিষয়ে কথা যেহেতু শুরু হয়েই গেল, তখন আর চুপ থেকে তো লাভ নেই। তাই সাহস করে জিজ্ঞাস করে উঠলাম, "জি, আপনার পায়ের এই দুর্দশা হলো কি করে?"
আবার একটি মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "খুশিতে। অতিরিক্ত মাত্রার খুশিতে।"
শুনে অবাক হলাম। সাথে সাথে আবার জিজ্ঞাস করলাম, "কি?"
"কাহিনীটা বেশ বড়। শুনতে হলে অধিক পরিমাণের মনোযোগের প্রয়োজন হবে। পারবে তো?"
"জি! অবশ্যই!"
"ঘটনাটি এখন থেকে প্রায় বারো বছর আগের। গ্র্যাজুয়েশন পার করে মাত্র আইনজীবী হলাম। সেই উপলক্ষে আমি এবং আর ল কলেজের সহপাঠীরা সবাই মিলে রাতে পার্টি করছিলাম। দারুণ মজা হচ্ছিল। যে মেয়েটাকে পছন্দ করলাম, তারই সঙ্গে সারাটা রাত নাচলাম। মেয়েটার নাম ছিল মারজিয়া।"
"বাহ! কি সৌভাগ্য আপনার!"
"হূ!"
"মেয়েটাকে আপনার মনের কথা বলেননি?"
"বলেছিলাম। সে বলছিল, সেও নাকি আমাকে অনেক আগ থেকেই পছন্দ করত।"
একটা মুচকি হাসি দিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "তারপর কি হয়েছিল?"
উনি ও একটা মুচকি হাসি দিয়ে আবার বলতে লাগলেন, "হায়, কি পরিমাণের মদ পান করলাম না সেই রাত! আহাহা! বলার বাইরে! নেশাও চড়েছিল প্রচুর পরিমাণের।"
"আপনি মদও খান?"
উনি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালেন।
আমি জিজ্ঞাস করলাম, "তারপর কি হয়েছিল?"
"তারপর আর কি হবার? যা কপালে ছিল, সেটাই হলো। মারজিয়ার সঙ্গে তিনটা ঘণ্টার মতো নাচার পরে বাসার জন্য বেল হলাম। সেই নাচটা কখনওই ভোলার মতো না রে! জীবনের শেষ নাচ ছিল। এখন শুধু চিন্তা করি, পা দুটো যদি শেষ পর্যন্ত নাচানাচির কাজে না লাগাতাম! এখন তো সারাজীবন এই সত্যটা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে।"
"আপনে তো তাও আপনার পছন্দের কাজটা করেই পা হারালেন, তাই না? অন্তত সেই স্বপ্নটা তো পুরণ হলো।"
"তা তো আছেই! তবে সারাটা জীবন হাঁটাচলার তুলনায় এই তিন ঘণ্টার নাচানাচি কিছুই না।"
"তা তো অবশ্যই! তারপর কি হয়েছিল, বলুন?"
"বাসার জন্য যখন বের হলাম, তখন মাথাটা প্রচুর টাল হয়েছিল। এত রাতে নেশা নামানোর জন্য লেবুও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সেই রাত বৃষ্টি হয়েছিল। রাস্তাঘাট বেশ পিচ্ছিল ছিল। আমি এত অন্ধকারের মধ্যে পায়ে হেঁটে সড়ক পার করতে গিয়ে, পা পিছলে, পিঠের উপর পড়ে গেলাম। ঠিক সেই সময়ই একটা বিশাল ট্রাক সেই সড়ক দিয়ে যাচ্ছিল। ট্রাকটার চাকা গেল আমার পায়ের উপর দিয়ে। সেখানে আশেপাশের কিছু লোক এই কাণ্ড দেখে দ্রুত ট্রাককে থামায় এবং আমাকে নিয়ে যায় নিকটবর্তী হাসপাতালে।"
“কপালটা বড়ই খারাপ ছিল আপনার।"
"তা তো ছিলই। ছয় ঘণ্টা অপারেশনের পরে জ্ঞান ফিরে পেয়েছিলাম। জ্ঞান ফেরার পরে উঠে প্রথমেই যা দেখলাম, তা দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।"
"বড়ই কষ্টের ব্যাপারটা।"
"কিন্তু তার চেয়েও বেশি কষ্ট লাগল, যখন দেখলাম সেই মেয়েটিই আমাকে দেখতে আসল না, যার প্রেমে এত মদ খেয়ে মাতাল হয়ে এই কাণ্ডটা ঘটালাম।"
"ফোন করেও জিজ্ঞাস করেনি?"
"কীসের! উল্টো যখন আমি তার খবর নিতে ফোন দিলাম, তখন আমাকে কত আজেবাজে কথা শোনাল।"
"সত্যি?"
"তোমার কাছে মিথ্যা বলে আমার কোনো লাভ আছে?"
"সেটা না। আমি ভীষণ ঝটকা খেলাম কথাটা শুনে। এত জঘন্য কেউ হতে পারে? তাও আবার একটা মেয়ে! এতটাই নিষ্ঠুর! আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না।"
"হুম! অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্য।"
"আপনি পাল্টা কোনো জবাব দেননি?"
"না!"
"কেন? সে আপনাকে অপমান করেই গেল, আর আপনি শুনেই গেলেন!"
"হ্যাঁ! ছোটবেলায় বাবা শিখিয়েছিলেন, শিক্ষকদের কখনও পাল্টা জবাব দিতে হয় না।"
আমি এই কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "মেয়েটা আপনার শিক্ষিকা ছিল?"
"হ্যাঁ! কিন্তু পড়া লেখার জগতে নয়, বরং জীবনের।"
"মানে বুঝলাম না!"
"আরে বাবা, শিক্ষকেরা তো সাধারণত পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান দিয়ে থাকে, সেখানে তাদেরও যদি কোনো কথার পাল্টা জবাব দেয়া উচিত না, তাহলে তো যেই শিক্ষিকা জীবনের এত বড় একটা শিক্ষা দান করেছে, তাকে কি করে পাল্টা জবাব দেয়া যায়? সেই তো সেরা শিক্ষা দান করেছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই শিক্ষাই কাজে আসবে। ঐ পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান সবই এর সামনে তুচ্ছ।"
"হুম! বুঝতে পেরেছি।"
"তবে একটা কথা না বললেই নাই।"
"সেটা কোনটা?"
"আমার জীবনের প্রথম মামলা লড়েছিলাম সেই ট্রাক ড্রাইভারের বিরুদ্ধে। ঘটনাটা ঐতিহাসিক হয়ে রয়ে গেল।"
"বাহ্! এভাবে তো ভেবে দেখিনি।"
"সেটাই! জীবনে ঘটা প্রত্যেকটি মুহূর্তের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে কিছু অমৃত স্মৃতি। অনেকেই তা অবহেলা করে এড়িয়ে যায়।"
"আপনি কি সেই সকল কিছুই স্মরণ করেন?"
"না! তবুও অনুভব করতে পারি।"
"বাবা আপনার সম্বন্ধে যা কিছু বলেছিলেন, সবই দেখি সত্য।"
একটি মুচকি হাসি দিয়ে আমার চেহারার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাস করলেন, "কেন? তুমি কি মিথ্যে মনে করছিলে?"
"ব্যাপারটা ঠিক তা না। কিন্তু অন্য কারো সম্বন্ধে এত প্রশংসা উনার মুখে খুবই কম শুনেছি। তাই অনেকটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল আমার কাছে।"
"আচ্ছা? এমন কি বললেন আমার ব্যাপারে?"
"বলছিলেন; আপনি নাকি এতই জ্ঞানী এবং দক্ষ, যে সূর্য থেকেও আলো হস্তক্ষেপ করে চাঁদকে দিয়ে দিতে পারবেন।"
"হা হা হা! কথাটা কিছু ঘুলিয়ে ফেলেছ, বাবা। কথাটা একটু অন্যরকম ছিল। আর এটা তোমার বাবা সর্বপ্রথম বলেননি, এটা আমাকে জাপানে এক থেকে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সেখানের খুবই বিখ্যাত একজন বিতর্ককারী আমার কাছে হারার পর বলেছিলেন। সেই উক্তিটাই তোমার বাবা টেলিভিশনে দেখার পর আমাকে সেটার বাংলা অনুবাদ জিজ্ঞাস করেছিলেন। আমি সেটাই উনাকে অনুবাদ করে বলেছিলাম।"
"ওহ্! বুঝতে পেরেছি।"
"এবার নিজের সম্পর্কেও কিছু বলো।"
"আমার নাম রাফি। নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। পড়াশোনা ছাড়ার কিছু বছর গেল।"
"এর মাঝের কয়টা বছর কি করলে?"
"জি, এলাকার রাজনীতিতে ঢুকেছিলাম। মিছিল-টিছিলে যেতাম। বক্তৃতাগুলোতে হাজিরা দিতাম। আর মাঝেমধ্যে চাঁদাবাজি করে বেড়াতাম। বাস! এতটাই।"
"এতটাই? অনেক কিছুই তো করেছিলা! পদ পাওনি কোনো?"
"না! সেটার জন্য তো অনেক সময় লাগে। আর রাজনীতিতে বড় কোনো আত্মীয় না থাকলে তো সারাজীবন পদ ছাড়াই থাকা লাগে।"
"ওহ্! ওদের সঙ্গে অন্য কোনো ধরনের অন্যায় কাজে জড়াওনি তো?"
"অনৈতিক বলতে?"
"খুনখারাবি, লুঠপাট, ধর্ষণ ইত্যাদি ইত্যাদি।"
"তেমন কিছু না। কিন্তু যে নেতার অধীন কাজ করতাম, সে একটা খুন করেছিল। সেই খুনের সহায়ক হিসেবে একটা ছোট্ট ভূমিকা পালন করেছিলাম আমি।"
"কেমন ভূমিকা?"
"আমি গেটের বাহিরে দাড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলাম।"
"এটিকে ছোট ভূমিকা বলছো, মিঞা! এটা তো একটা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছ।"
"আমি জানতাম না, তারা যে খুন করে ফেলবে।"
"যাক! অনেক কথাই হলো। আজকের জন্য এইটুকুই। বাকি কথা বলার জন্য অনেক সময় পড়ে আছে। এবার গিয়ে বিশ্রাম করো। কাল থেকে তো তোমার কাজ শুরু।"
"জি!" এটা বলেই আমি উনার রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলাম।"
সেদিন আমাদের মাঝে এতটাই কথা হলো। বাকিটা সময় কাটল নীরবতার মাঝে। পরের দিনই বৃদ্ধ লোকটি অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাড়ির জন্য বের হলেন। সেদিন থেকেই মূলত আমার কাজ করার দিন শুরু হলো। অ্যাডভোকেট সাহেবের মক্কেলরা প্রায় প্রতিদিনই দেখা করতে আসতেন। অনেকে আসতেন পরামর্শ করতে, আবার অনেকে আসতেন নতুন কোনো মামলার প্রস্তাবনা নিয়ে। অনেক বড় বড় রাজনৈতিক দলীয় নেতাদের সঙ্গেও উনার বেশ ওঠাবসা ছিল। উনার দেখা করার সময় নির্ধারিত ছিল সকাল এগারোটা হতে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। এর মাঝেই দু ঘণ্টার বিরতি নিতেন খাবার এবং বিনোদনের জন্য। আমি প্রথম যেদিন এসেছিলাম, সেদিন ঠিক উনার বিরতির সময়টায়। কি ভাগ্য আমার! প্রথম দিনেই এলাম বিরতির সময় আহাসা! তবে বিকেল পাঁচটার পর যে উনার সকল কাজ শেষ হয়ে পড়ে, ঠিক তাও না। উনি বাকিটা সময় বিশেষ কিছু মামলার দলিলপত্র যাচাই করেন এবং বাকিটা রাত একা একা শান্তিপূর্ণভাবে আরাম করেন। শুধুমাত্র রাত দশটার দিকে খাবারের সময় উনাকে ডাক দেয়া যাবে, তার আগে বা পড়ে হলে খবর আছে।
এক বিশেষ সন্ধ্যা; অ্যাডভোকেট সাহেবের সঙ্গে উনার অফিস রুমে বসেছিলাম। হঠাৎ করে দরজা জোড়ে জোড়ে ঠকঠক করার শব্দ আসছিল। মনে হচ্ছিল যেমন দরজাটা ভেঙেই ফেলবে। আমি তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে দেখলাম দুজন বেশ লম্বা এবং মাস্তান প্রকৃতির লোক। তাদের মধ্যে একজন পড়েছিল সাদা একটা পাজ্ঞাবী, স্বর্ণের মোটা একটা চেইন এবং হাতে একটি স্বর্ণের হাতঘড়ি। দেখে বোঝাই যাচ্ছিল কোনো এক নেতা হবে। তার সাথের জন বেশ সাদাসিধে কাপড়ে ছিল, তবে চেহারার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝাই যাচ্ছিল সে যে একটা নিতান্ত চামচা। আমি তাদের জিজ্ঞাস করলাম, "জি, কাকে চাই?"
দুজনের মধ্যে চামচা প্রকৃতির লোকটা আমাকে জিজ্ঞাস করলো, "উকিল সাহেব বাসায় আছেন?"
"জি আছেন! আপনারা কারা?"
তখন নেতা প্রকৃতির লোকটা উত্তর দিল, "আমি তার অনেক পুরনো মক্কেল। নাম; দীপু।"
"জি, ভিতরে আসুন। উকিল সাহেব অফিস রুমে আছেন। আমি ডেকে আনি।"
"না থাক্! আমরা অফিসের কাজেই এসেছি।" এ বলে তারা আমার দুপাশ দিয়ে অফিস রুমের দিকে চলে গেল।
অ্যাডভোকেট সাহেব তাদেরকে অফিসের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখে, চিৎকার করে আমাকে ডাক দিলেন। আমি দৌড় দিয়ে সেখানে হাজির হলে আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, "তুমি কি মনে করে এদেরকে ভেতরে আসতে দিলা? দেখতে পারছ না আমি ব্যস্ত আছি?"
আমি কিছু বলার আগেই দীপু নামক ব্যক্তিটি বলে উঠলেন, "উকিল সাহেব, অনেক জরুরি কাজ ছিল। হাতে একটুও সময় ছিল না।"
"কি হয়েছে এবার? কাকে খুন করে এসেছ?"
"আরে, এবার আমি কিছু করিনি।" বলে লোকটা নিজের সাথের লোককে উদ্দেশ্য করে বললেন, "এই আমার খুব কাছের এক ছোট ভাই, নাম; নয়ন।"
"হ্যাঁ! তারপর?"
"এলাকার মধ্যে একটা ছোটখাটো গণ্ডগোল হয়েছিল জমিনের ব্যাপারে।"
"সরি! আমি জায়গা-জমিনের মামলা লড়ি না। অন্য কারো কাছে যাও।"
"আরে ভাই, কথাটা তো আগে ঠিকমতো শুনেন!"
"আমার কাছে এতো গল্প শোনার সময় নেই। অনেক কাজ বাকি আছে। যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।"
"ঠিক আছে! ঠিক আছে! আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে গিয়ে; সেই গণ্ডগোলের মধ্যে এই বেচারাটা একটু মারধর করে বসল একজনকে। সে এটা রাগের মাথায় করেছিল। একটা শয়তান ছেলে, সেটার ভিডিও রেকর্ড করে অনলাইনে ছেড়ে দিল। তারপর সে ঐ ছেলেটিকে বোঝাতে গেলে ছেলেটা বেয়াদবি করে বসাতে সে ছেলেটাকে শাসন করে। শাসন করতে গিয়ে ছেলেটা ভুলবশত মারা যায়।"
অ্যাডভোকেট সাহেব রাগান্বিত সরে বললেন, "আপনা কথাগুলো শুনলাম। এবার জান। এই কেস আমি লড়তে পারব না।"
"উকিল সাহেব, আপনার কাছে অনুরোধ করছি। আমাকে তো একবার সাহায্য করেছিলেন, এর বেলায়ও একটু দেখেন না!"
"তোমার বেলায় তোমার বিরুদ্ধে এত মজবুত মজবুত দলিল ছিল না। এর তো মারধর করার ভিডিও অনলাইনে রয়েছে। আর যে আপলোড করেছিল, তাকেই মেরে ফেলল! শালা গাধা কোথাকার! নিয়ে যাও একে এখান থেকে। গেট লস্ট!"
অতঃপর সেই চামচা প্রকৃতির লোকটা রেগে, চিৎকার করে, অ্যাডভোকেট সাহেবকে বললো, "বাস! অনেক শুনে ফেললাম। কখন থেকে দেখছি, যা মনে আসছে বকেই যাচ্ছেন। আমাকে যা বলেন না বলেন, দীপু ভাইকে উল্টাপাল্টা কিছু বললে কিন্তু আমি সহ্য করব না।" এই দৃশ্যটি দেখে, সেই নেতা প্রকৃতির লোকটা তাকে থামানোর প্রয়াসে, তাকে ধরে অফিস থেকে বের হতে লাগল। তবুও সেই চামচা প্রকৃতির লোকটা চিৎকার করে বলছিল, "শালা লুলার বাচ্চা, জেলে যেতে হলে তোর খুনটাও করেই যাব।"
এটা শুনে অ্যাডভোকেট সাহেব ভ্রূ কুচিয়ে বললেন, "আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি কেসটা লড়তে রাজি।" এটা শুনে তারা উভয়ই অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়ে গেল। তাদের কিছু বলার আগেই উনি আরো বলে উঠলেন, "কিন্তু একটা শর্ত রয়েছে।"
"কি শর্ত?" জিজ্ঞাস করলেন নেতা প্রকৃতির লোক।
"এই লোককে আমার কাছে কালকে এসে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।"
"উকিল সাহেব, কালকে কেন, এখনই সে ক্ষমা চাবে।" বলে তার চামচাকে বললেন, "এই এক্ষুনি ক্ষমা চাও উকিল সাহেবের কাছে, বেয়াদ্দব। এখনই ক্ষমা চাও।" এই কথাটা শুনে সেই চামচা প্রকৃতির লোকটা অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছে ক্ষমা চাওয়া শুরু করলো।
এই দৃশ্য দেখে অ্যাডভোকেট সাহেব বললেন, "এখানে আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে কোনো লাভ নেই। তুমি আমাকে এইমাত্র 'লুলার বাচ্চা' বলে গালি দিয়েছ। অর্থাৎ, এখানে তুমি মূলত আমার বাবাকে গালিটা দিয়েছ। তাই আমি চাই, কালকে দুপুরে তুমি আমার বাবার কবরের কাছে এসে, উনার কাছে ক্ষমা চাও।"
এটা শুনে নেতা প্রকৃতির লোকটা বলে উঠল, "ঠিক আছে! ঠিক আছে! সে কালকে দুপুরে সেখানে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিবে।"
"ঠিক আছে। তাহলে এবার তোমরা যেতে পারো।"
অ্যাডভোকেট সাহেবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নেতা প্রকৃতির লোকটা বললেন, "ধন্যবাদ, উকিল সাহেব। অনেক অনেক ধন্যবাদ।" এরপর নিজের চামচাকে বললেন, "চলো! কাজ হয়ে গিয়েছে।"
তারা বাসা থেকে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর অ্যাডভোকেট সাহেব একজনকে ফোন করলেন। ফোনের লোকটাকে বলছিলেন, "শুনো, তোমাদের জন্য নতুন একটা কাজ আছে। করতে পারবা তো?" আমি দূর থেকে শুধু এইটুকুই শুনতে পেরেছিলাম। পরবর্তীতে রাতে, খাবারের টেবিলে উনাকে জিজ্ঞাস করলাম, "আপনি কি আসলেই কেসটা লড়বেন? লোকটার বিরুদ্ধে তো অনেক বেশি পরিমাণের প্রমাণ রয়েছে।" আমার প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট সাহেব একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "আগে শর্তটা তো পূরণ হতে দাও রে, বাবা!"
শুনে অবাক লাগলেও, তখন এই ব্যাপারে বেশি একটা চিন্তা করিনি। শুধু অপেক্ষায় ছিলাম তার পরের দিনের দুপুরের।
পরের দিন সকালে অ্যাডভোকেট সাহেব তাদেরকে ফোন করে কবরস্থানের ঠিকানা জানিয়ে দিলেন এবং ছেলেটিকে একা পাঠাতে বললেন। আমরা দুপুরে ঠিক দুটার দিকে সেখানে অপেক্ষায়, কবরস্থানের ভেতরে দাড়িয়ে ছিলাম। অ্যাডভোকেট সাহেবের বাবার কবরের পাশেই দাড়িয়ে ছিলাম। খেয়াল করলাম ছয়টি বড় বড় গাছ কবরটিকে ছায়া দিচ্ছে। বেশ দারুণ একটি স্থানে ভদ্রলোকটিকে দাফন দেয়া হয়েছে। আশেপাশে মানুষ খুবই কম ছিল। হাতেগোনা কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছিল। অ্যাডভোকেট সাহেবের বাবার কবরটা খুবই ভিতরের দিকে অবস্থিত। এত নিরিবিলি জায়গায় কেউ মরে পড়ে থাকলেও কেউ দেখতে আসবে না। কারণ জায়গাটা ভীষণ বড় এবং আশেপাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই। এসব জায়গায় সহজেই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই হওয়ার প্রবণতা থাকে। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করার মতো ব্যাপার ছিল, যেখানে অ্যাডভোকেট সাহেবের বাবার কবরের পাশেই আরেকটা কবর খুদে রাখা। আমি এর সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাস করব আর এতক্ষণে সেই চামচা প্রকৃতির লোকটা এসে হাজির হলো।
"অপেক্ষার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত, উকিল সাহেব। রাস্তাঘাটে যেই জেম! তার উপর দিয়ে এখানে এসে শেষ মাথা খুঁজছিলাম। সরি! সরি!" সেই লোকটি বললো।
"আরে! কোনো ব্যাপার না। ইটস ওঁকে!" বলে অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের বাবার কবরের তরফ ইশারা করে বললেন, "এই হলেন আমার বাবা; মোঃ সিবলি ক্বারি। এনার কাছে ক্ষমা চাও।"
"জি, অবশ্যই।" বলে কবরের দিকে ঘুরে, হাত জোড় করে বলতে লাগল, "আমি অতিরিক্ত রাগের মাথায় আপনার ছেলেকে গালি দিতে গিয়ে ভুলবশত আপনাকেও গালি দিয়ে ফেলেছিলাম। আপনি পরকাল থেকে আমার ডাক শুনে থাকলে, আপনার কাছে অনুরোধ করছি, দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।" এটা বলা শেষ হবার সাথেসাথে অ্যাডভোকেট সাহেব উনার বন্দুকটি বের করে, সেই লোকটার দু পায়ের হাঁটুর মধ্যে গুলি করলেন। লোকটা সঙ্গেসঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল। এই দৃশ্যটি দেখে আমি চমকিত হয়ে পিছনে চেপে গেলাম। অতঃপর আশেপাশের যারা ছিল, তারা দৌড় দিয়ে আসলো। প্রথমে মনে করেছিলাম তারা অ্যাডভোকেট সাহেবকে থামাতে আসছে, কিন্তু না, তারা এসেছিল সেই চামচাকে ধরে রাখতে। তারা সবাই মিলে সেই চামচা প্রকৃতির লোককে ধরে মাটিতে শুয়িয়ে রেখেছিল। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব তার হুইলচেয়ার নিয়ে লোকটার গলায় চড়িয়ে দিলেন। হুইলচেয়ার এবং তার উপর বসে থাকা অ্যাডভোকেট সাহেবের পুরো ভাড়টা ছিল লোকটার গলার উপরে। লোকটার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এমতাবস্থায় সে একটি পানে থেকে বের হওয়া মাছের মতো ছটফট করতে লাগল। দম বের হতে তাড়াতাড়ি করতে, অ্যাডভোকেট সাহেব হুইলচেয়ার আগে-পিছনে করছিলেন। লোকটা অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করার পর শেষমেশ মারা গেল। পাশের সেই খালি কবরটির ব্যাপারটা তখন বুঝতে পারলাম। লোকটিকে মেরে ফেলার পরে বাকিরা তার লাশ সেখানে ফেলে দিল। গর্তের মধ্যে কিছু শুকনো পাতাও ফেলে, তার উপর কেরোসিন ঢেলে দিল। অতঃপর একটা ম্যাচের কাঠি ধরিয়ে সেখানে ফেলে দিল। লাশটি পুড়তে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। এই সময়টুকুর মধ্যে আরো কয়েকবার কেরোসিন ঢালা হলো। পুরোভাগে পোড়ানোর পরে তার উপর মাটি দিয়ে দিল। দৃশ্যটি দেখে অ্যাডভোকেট সাহেবের চেহারায় মুচকি হাসি দেখতে পাচ্ছিলাম। অ্যাডভোকেট সাহেবের মুখে সেই হাসিটা দেখে সেদিন ভীষণ ভয় পেলাম। সব শেষে তারা সবকিছু গুছিয়ে রেখে দিল। সবাই কলের পানি দিয়ে নিজের শরীর থেকে রক্ত পরিষ্কার করে নিল। আমি নিজ হাতে অ্যাডভোকেট সাহেবের হুইলচেয়ার এবং কাপড়ে লাগা রক্তের দাগ ধুয়ে দিলাম। রক্তের দাগ ধোয়ার সময় উনি আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, "আশা করি মুখটা পরবর্তীতেও এভাবেই বন্ধ থাকবে।" হঠাৎ উনার এই কথা শুনে চমকে জিজ্ঞাস করলাম, "জি! আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। মুখ বন্ধ বলতে?"
"থাক্! আপাতত বাসায় চলো। মাথায় এখন অনেক কিছু ঘুরছে তো। এখন সোজা কথাও বাকা মনে হবে। তার তুলনায় আমার কথা তো এমনিতেই বাকা।"
কিছু না বুঝেই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালাম। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব ড্রাইভারকে ফোন করে গাড়ি ডাকালেন এবং আমরা বাসার জন্য বের হলাম। গাড়িতে বসে পুরোটা সময় শুধু সেই হত্যার ব্যাপারেই ভাবছিলাম। চোখের সামনে সেই দৃশ্যগুলি ভাসছিল। কিভাবে লোকটা ছটফট করছিল, কিভাবে তার নাক-মুখ থেকে রক্ত বের হচ্ছিল, কিভাবে তাকে সবাই ধরে রেখেছিল- ওগুলোই বারবার মনে পড়ছিল। ঐ একজন লোক তো তার চোখের মধ্যে নিজের হাতের আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে দিয়েছিল। জানি, সেই লোকটাও একটা খুনি, তাও এমন নির্মমভাবে কারো হত্যা নিজের বিবেককে স্বাভাবিক রাখা যায় না। এই ব্যাপারে অবশ্যই গুরুতর অনেক কথাই ছিল অ্যাডভোকেট সাহেবের সঙ্গে। এটা চিন্তা করতে করতে আমরা বাসায় পৌছে গেলাম। বাসায় প্রবেশ করতেই না করতে অ্যাডভোকেট সাহেবের ফোন বেজে উঠলো। ফোন করেছিলেন সেই নেতা প্রকৃতির লোকটা। ফোনে অ্যাডভোকেট সাহেবকে জিজ্ঞাস করছিলেন তার সেই ছোট ভাইয়ের কথা। অ্যাডভোকেট সাহেব বলে দিলেন, "তোমার সেই ছোট ভাইয়ের জন্য তো আজ প্রায় তিন ঘণ্টার মতো সেখানে অপেক্ষা করছিলাম, সে তো আসেনি।" তার উত্তরে সেই লোকটা অবাক হয়ে বললেন, "কি বলেন, উকিল সাহেব? এটা তো অসম্ভব। সে তো সেখানে পৌছানোর পর আমাকে ফোনও করেছিল।"
"তাহলে সে গেল টা কোথায়?"
"আশ্চর্য! আপনার সাথেই তো দেখা করতে গিয়েছিল।"
"আমি বললাম তো, আমি সেখানে ছিলাম প্রায় তিন ঘণ্টার মতো। আমি তো তার কোনো দেখাসাক্ষাৎ পাইনি!"
"আপনি সিওর তো?"
"অবশ্যই! চাইলে আমার কাজের লোককে জিজ্ঞাস করতে পরো। সেও আমার সঙ্গেই ছিল।"
"কি বলেন এসব, উকিল সাহেব? আপনার উপর তো পুরো ভরসা রয়েছে। আমি তো চিন্তিত আছি অন্য বিষয় নিয়ে।"
"তা কি?"
"তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল নাকি! সেটা।"
"সেটা আমার চিন্তার কোনো বিষয় না। এবার কথাটা শেষ হয়ে থাকলে ফোনটা রাখো, এমনিতেই অনেক কাজ পিছিয়ে গিয়েছে এসব নিয়ে।"
"জি, উকিল সাহেব! অবশ্যই।"
এটা বলেই ফোনটা রেখে দিল। অ্যাডভোকেট সাহেব ফোনটা হাত থেকে রেখে, সেই হাত দিয়ে কপাল ধরেছিলেন। উনার ধরনের আন্দাজ দেখে মনে হচ্ছিল, উনার মাথা ধরেছে। উনার দলিলপত্রের কাজ শেষ হবার পর, সাহস করে উনার কাছে গেলাম সেই ঘটনা নিয়ে কিছু আলাপ আলোচনার জন্য। অ্যাডভোকেট সাহেব আমার কিছু বলার আগেই বললেন, "এসো! এসো! বসে পড়ো।"
আমি চুপচাপ বসে পড়লাম। অ্যাডভোকেট সাহেব আমার দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে দু-চারবার একটা মুচকি হাসি দেওয়ার খুব চেষ্টা করছিলেন। দেখে এমন মনে হচ্ছিল, যেমন উনি আমাকে কিছু বলতে দ্বিধা বোধ করছিলেন। ব্যাপারটা এত সাংঘাতিক না হলে সে মুহূর্তে হেসেই দিতাম। তবে অবশেষে বলেই ফেললেন, "আজকে তুমি নিজ চোখে যা কিছু দেখেছ, সেটা কখনওই তোমার স্মৃতি থেকে বের করা সম্ভব না। তবে, এটা মনে রেখেও নিজের বাকি জীবন কাটানো সম্ভব। কারণ যদি আমি এটা করতে পারি, তবে তুমিও অবশ্যই পারবে।"
আমি কোনো অতিরিক্ত বিষয়ে আলোচনা না করেই সরাসরি মূল কথায় এসে পড়লাম, "একজন জীবিত লোককে এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করাটা কি ঠিক হয়েছে?"
অ্যাডভোকেট সাহেব আমার প্রশ্নটা শুনে কিছুটা অবাক হলেও, উনার চেহারা দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল; এটা উনার প্রথমবার নয়। উনি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "সেই লোকটা একজন খুনি ছিল, সেটা মনে আছে তো?"
"জি! অবশ্যই। কিন্তু তার জন্য তো আইনি ব্যবস্থা আছে, তাই না?"
"হা হা হা! কোন যুগে বসবাস করছ, বাবা? আইন কি আর আগের অবস্থায় আছে?"
"না থাকলেই বা কি? একজন আইনজীবী হিসেবে কি আপনার কোনো নৈতিক দায়িত্ব নেই?"
"আমার নৈতিক দায়িত্ব সর্বপ্রথম আমার নিজের জন্য। আর আমি না মারলে, সে কিছুদিন পর এমনিতেও মারা যেত। তার বিরুদ্ধে খুবই মজবুত দলিল ছিল। আমি এমন কোনো কেস লড়ি না, যেটা নিঃসেন্দহে হেরে যাবো।"
"আপনি তো তাদেরকে একবার মানা করেছিলেনই, আবার হ্যাঁ বলে এসব করার কি দরকার ছিল?"
"আরে বাবা, তুমি তো শুধু এই একটা ঘটনা দেখলে। আরো কত যে এমনই অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। কিছুদিন আমার সঙ্গে থাকলে এসবের অভ্যাস হয়ে যাবে।"
"আমি তো এসবের অভ্যাস লাগাতে চাই না।"
"তাহলে চাও টা কি, হ্যাঁ? বাহিরে গিয়ে সবাইকে বলে ফেলতে চাও? এতটা মনে রেখ, তুমিও আমার সঙ্গে ছিলে, একথা কিন্তু দীপু ভাল করে জানে। কোনো ধরনের মামলায় আমি পড়লে, সেখানে তোমার নামও অবশ্যই আসবে। আর আমি নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে সহজেই ছুটে যেতে পারব।"
"আমি তো সেই লোকটাকে কখনও হাতও লাগাইনি। আমাকে তো কোনোভাবেই দোষী প্রমাণ করতে পারবেন না।"
"হা হা হা! সেটা তো একদম যৌক্তিক একটা কথা বলেছ। আমি তো কোনোভাবেই তোমাকে দোষী প্রমাণ করতে পারব না। তবে এখানে প্রমাণে ততটা প্রয়োজন নেই, যতটা দরকার যুক্তির।"
"ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।"
"নিজের বাবার কথাগুলো মনে করলে সবই বুঝতে পারবা।"
"বাবার কোন কথাগুলো?"
"আরে বাবা, যে ব্যক্তি সূর্যের আলোর প্রকৃত অধিকারী হিসেবে যদি চাঁদকে প্রমাণ করতে পারে,সেই ব্যক্তি কি এমন একটা হত্যার আসামি হিসেবে তোমাকে দোষী প্রমাণ করতে পারবে না? এটা কি কখনও হতে পারে, বলো?"
"দেখুন, আমি কখনওই আপনার বিরোধিতা করার কথা বলিনি। আমি শুধু সহজ একটা প্রশ্ন করেছিলাম।"
"সেটার উত্তর কি আমি দেইনি?"
"দিয়েছেন, কিন্তু আংশিক; পুরোপুরি এখনও দেননি।"
"সেই প্রশ্ন নিয়ে আমরা সারাটা রাত আলোচনা করতে পারি, কিন্তু সেই আলোচনার মাধ্যমে না সেই লোকটা ফিরে আসবে যাকে আমি খুন করেছি, আর না সেই লোকটা ফিরে আসবে যাকে সে খুন করেছিল। তাই সর্বোত্তম কাজটা হলো এই ব্যাপারে আর কোনো কথা আগে না বাড়ানো।"
"ঠিক আছে! যেভাবে আপনি ভাল মনে করেন।"
"এই তো! শাবাশ! বুঝতে পেরেছ এতক্ষণে।"
"তবে আমার একটা বিষয় নিয়ে বিশাল কৌতূহল ছিল।"
"হ্যাঁ! বলো।"
"সেই লোকজনকে দিয়ে যে এত কিছু করালেন, তারা কি আদৌ নিজের মুখ বন্ধ রাখতে পারবে?"
"অবশ্যই পারবে! তাদের কাজই এটা। তারা হলো আমার ব্যক্তিগত সুইপারের মতো। তাদেরকে দিয়েই নিজের জীবন থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করি।"
"খরচও তো নিশ্চয়ই বড় মাপের হওয়ার কথা।"
"সেটা তো আছেই। প্রত্যেকটা কাজের জন্য এক লক্ষ করে দেই প্রত্যেককে। আজকাল তো টাকা ছাড়া পোষা কুকুরও পাশে থাকতে চায় না, এরা তো তাও রাস্তার কুকুর।"
"হুম! বুঝতে পেরেছি।"
"তবে, এই হত্যাগুলো না করলেই হয় না? তাহলে তো আর এত টাকাও খরচ করতে লাগত না।"
"আরে বাবা, যেদিন জীবনে শীর্ষ কোনো পর্যায়ে পৌছাবা, সেদিন বুঝতে পারবা; দুনিয়ার সামনে নিজের সম্মান কীভাবে নিজের জীবনের চাইতেও মূল্যবান হয়ে ওঠে। সেদিন মৃত্যুর চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর হবে অপমান।"
আমি একটু মাথা নিচু করে, আবেগাপ্লুত হয়ে বললাম, "এমন কোনোদিন দেখা কপালে আছে কি না, তা জানি না। তবে আপনার কথাগুলো শুনে সেই জগৎটা দেখার অনেক ইচ্ছা আছে। কিন্তু সেটার জন্য দরকার আপনার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা এমং কর্মদক্ষতার, যা আমার মধ্যে বিদ্যমান না।"
"সেটা থেকে একটা কথা মনে পড়ল। তোমার বাবা বলেছিলেন, তুমি নাকি ছোটবেলায় অনেক মেধাবী ছাত্র ছিলে, নবম শ্রেণীতে ফেল করলে কি করে?"
আমি ভীষণ লজ্জার সঙ্গে বললাম, "আসলে, ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়।"
"মানে?"
"মানে হলো গিয়ে, আমি নবম শ্রেণীতে ফেল করিনি। তবে পাশ করার সুযোগও পাইনি।"
"কেন? কি হয়েছিল?"
"কাহিনীটা বেশ একটা বড় না হলেও, আমার জীবন বিশাল প্রভাব ফেলেছে। আমি তো পড়তাম একটা সরকারি স্কুলে। আপনার তো জানার কথা, সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সুন্দরী এবং জুয়ান কর্মী দেখা খুবই সচরাচর। তাই একটা শিক্ষিকাও যদি অল্প সুন্দরীও হয়, তাও সবাই তার প্রতি সর্বোচ্চ আগ্রহ প্রদর্শন করে। আমার বেলায়ও সেটাই ঘটেছিল। একদিন ক্লাসে বসে সবাই গণিত ক্লাস শুরুর অপেক্ষা করছিলাম। সেদিন নতুন একজন শিক্ষিকা আমাদের স্কুলে যোগদান করলেন। ধবধবে ফর্সা ত্বক, কোমল গোলাপি ঠোঁট, ঘন কালো চুল, চিকন দেহের আকৃতি এবং সেই সুন্দর দেহের উপর সাদাকালো শাড়ি। উনার চলার ধরন তো ছিল টেলিভিশনের নায়িকাদের মতো। আমি তো প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে আহত হয়ে গেলাম। নতুন ম্যাডাম নিজের পরিচয় দেয়ার পরই পড়ানো শুরু করলেন। সেদিন জ্যামিতি পড়াচ্ছিলেন। চিত্র আঁকতে বোর্ডের দিকে ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে উনার পিঠের দিকে আমার নজর পড়ল। নজর পড়তেই আমার মুখ থেকে শিস বেজে উঠল। আমি মাঝারি সারিতে বসেছিলাম, তাই আমাকে প্রথম দেখায় খুঁজে পাননি। কিন্তু তার কিছুক্ষণ পরই, চিত্র আঁকা শেষ করে একটা ঘোষণা করলেন। একটা মিষ্টি হাসির সঙ্গে পুরো ক্লাসকে জিজ্ঞাস করে উঠল শিসটা কে মেরেছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক, আমি স্বীকার করিনি। তবে উনার ছলনা হতে আর কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারতাম? উনি আরেকবার মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, উনার নাকি শিসের শব্দ বেশ পছন্দ এবং উনি নাকি তাকে পুরস্কার দিতে চান, যে শিসটা বাড়িয়েছিল। আমি তো সেই কোমল কোমল গোলাপি ঠোঁটের হাসি দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পুরস্কারের কথা শুনতেই মনের মধ্যে অসংখ্য লাড্ডু ফোটা শুরু হলো এবং আমি দাড়িয়ে স্বীকার করে নিলাম শিসটা যে আমিই মেরেছিলাম। এটা স্বীকার করার কিছুক্ষণের মধ্যে আমি নিজেকে পাই মাননীয় অধ্যক্ষের, ভয়াবহ কক্ষে। কয়েকটা চর-থাপ্পড় খেলাম, বকাঝকা শুনলাম। পুরস্কার নেওয়ার আশায় দাঁড়িয়েছিলাম, তিরস্কার নিয়ে বেড়িয়েছিলাম। অনেক হাত-পা জোর করার পর তারা বাসায় না জানানোর জন্য রাজি হলো। আমি বাসায় গিয়ে বলেছিলাম, বার্ষিকী পরীক্ষায় কোনো এক বিষয়ে ফেল করলেও স্কুল থেকে বের করে দিবে। পরবর্তীতে সেই অজুহাত বাস্তবায়নের জন্য পরীক্ষার বাহানা করে, স্কুলের পাশের গলির মধ্যে টঙের বেঞ্চে বসে বসে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতাম। পরীক্ষার ফলাফলের দিন বাসায় বলে দিলাম ফেল এসেছে বলে টি সি। এভাবেই শেষ হলো আমার শিক্ষাগত জীবনযাত্রা।"
অ্যাডভোকেট সাহেব আমার কাঁধে নিজের ডান হাত রেখে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "তোমাকে তো বড়ই সহজ সরল ভাবছিলাম। তুমি তো মিঞা জিনিস একটা। পরিবার জানলে কষ্ট পাবে বলে, হাত-পা জোর করলা! আমি তো কখনওই এত ধৈর্য ধরে রাখতে পারতাম না।"
আমিও সামান্য হেসে বললাম, "অ্যাডভোকেট সাহেব, আপনার সঙ্গে আমার তুলনা হয় নাকি?" ডান হাত দিয়ে উপরে ইশারা করে বললাম, "কোথায় আপনি!" এবং বাম হাত নীচের দিকে ইশারা করে বললাম, "আর কোথায় আমি!"
অ্যাডভোকেট সাহেব জোড়ে একটা হাসি দিয়ে বললেন, "হা হা হা হা হা! ঠিকই বলেছ, বাবা! তোমার দু পা জমিন স্পর্শ করতে পারছে, কিন্তু আমি জমিনে থাকা সত্ত্বেও জমিনকে স্পর্শ করার মতো একটি পাও নেই। আমি ভাল করে জানি তুমি কি বুঝাতে চেয়েছ, তবে আমার এসবের প্রতি তেমন একটা রুচি নেই। কারণ লোকে তো বহু প্রশংসা করবে, কিন্তু দিন শেষে সেই প্রশংসাগুলোর কোনো মূল্য নেই। যদি থাকতো, তাহলে কারো প্রশংসার আর কোনো দরকারই পড়ত না।"
আমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করে বসলাম, "জি, প্রশংসার মূল্য থাকলে প্রশংসার দরকারই পড়ত না! কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।"
"সেটা এখন বুঝতে পারবাও না। এই জিনিসটা বুঝতে বুঝতে এতগুলি চুল পেকে গেল। তোমাকে যদি সহজ ভাষায় বলেই দেই, তাহলে সেটা শিক্ষণীয় নয় বরং প্রশিক্ষণীয় হবে।"
অ্যাডভোকেট সাহেবের অধিকাংশ কথাগুলো মাথার উপর দিয়ে গেল বললেই চলে। তবে কথাগুলো স্মরণে রাখতে চেষ্টা সর্বদাই। আমাদের কথার শেষে আমি আমার রুমে ফিরলাম। রুমে ফেরার কিছুক্ষণ পরই আবার মনে পড়ল সেই দুপুরবেলার ঘটনা। মনে পড়াতে নিজেই অবাক হলাম নিজের উপর। এত বিশাল ঘটনা কি সুন্দরভাবে ভুলে গেলাম কিছু মজাদার মজাদার গল্পের মাঝে! মা আসলে ঠিকই বলেছিল। আমার মাথায় আসলেই কিছু সমস্যা আছে। তবে ঘটনাটা যতক্ষণ ভুলে গিয়েছিলাম, ততক্ষণ প্রচুর শান্তিতে ছিলাম। আসলে, ব্যাপারটা একটু নতুন নতুন মনে হলেও, আমার জন্য প্রথম না। কারণ অ্যাডভোকেট সাহেবের সঙ্গে যতক্ষণ গল্প চলছিল, ততক্ষণ উনি আমার কথাগুলো বেশ গুরুত্ব দিয়ে শুনছিলেন। উনার চেহারার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝাই যাচ্ছিল উনি আরো শুনতে আগ্রহী। এমন দীর্ঘ আগ্রহ দিয়ে আমার কথা গতবার শোনা হয়েছিল সেদিন, যেদিন বাসায় এসে সবাইকে বলেছিলাম; আমাকে স্কুল থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সেদিনই আমার কথাগুলো সর্বোচচ গুরুত্ব, আগ্রহ এবং নিন্দা পেয়েছিল। তার আগে কখনও স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারিনি, এমন হতে পারে। ছোট থেকে বড় হলাম এ মনে করে, গুরুত্ব কখনও নিন্দনীয় বস্তুর প্রতি দেয়া যায় না। কিন্তু স্কুল থেকে বের হবার পর সেই শিক্ষাও পেয়েই গেলাম। সেদিন যা ঘটেছিল, তাকে স্বপ্ন বলে ভুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই মানসিকতা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে, নাহলে দুনিয়াতে আরো অনেক অজানা রহস্যই আছে যা মানুষের না জানাটাই উত্তম। এসব গভীর চিন্তা শেষে ঘুমোতে গেলাম। চোখ বন্ধ করার কিছু সময়ের মধ্যেই সেই লাশটি চোখে ভেসে উঠছিল। সাথে সাথে চমকে উঠে বসে পড়লাম। এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল দম আটকে গিয়েছে। নিশ্বাস ফেলতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছিল। সেই রাত আরো কয়েকবার এমন হবার পর সিদ্ধান্ত নিলাম জেগে থাকার। তবে এই সিদ্ধান্তে আসার কিছুক্ষণ পর পানি পান করতে গেলাম রান্নাঘরের দিকে। তখন বুঝতে পারলাম আমিই একমাত্র ব্যক্তি নয় যার ঘুমোতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। অ্যাডভোকেট সাহেবের রুমের বাতিটা জ্বালানো ছিল। দরজা লাগানো থাকার কারণে, আস্তে করে, দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে, উঁকি মেরে দেখলাম। দেখলাম উনার রুমে টেলিভিশন চালু আছে এবং অ্যাডভোকেট সাহেবের হুইলচেয়ারটির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম; উনি টেলিভিশনের ঠিক বিপরীত দিকে ঘুরে আছেন। আমি দেখে খুবই অবাক হলাম। একটা লোক টেলিভিশন চালু রেখে কেনই বা তার ঠিক উল্টো পাশে ঘুরে থাকবেন? ব্যাপারটা খুবই অযৌক্তিক ছিল। কিন্তু তখনই রুমের ডান পাশ দিয়ে দেখি দুটো পা হেঁটে, হুইলচেয়ারের দিকে আগে বাড়ছে। আমি "চোর! চোর!" বলে চিৎকার দেবার আগেই খেয়াল করে দেখলাম পা দুটো মোটেও স্বাভাবিক নয়। বরং আরো ভাল করে নজর দেওয়াতে বুঝতে পেলাম পা দুটো তো আলাদা পা। একবার একটি পত্রিকার খেলার পাতায় দেখেছিলাম এমন পা। সেখানে একজন পা বিহীন মেয়ে সেটার মাধ্যমে একটি বিশ্বসেরা দৌড় প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করেছিল। ইহার নাম ঠিক মনে নেই, তবে বাস্তবে দেখার অনেক আগ্রহ ছিল। কিন্তু আগ্রহ তো তখনই পুরণ হবে, যখন জীবনটা বাকি থাকবে। আমি সেখানে চোরের মতন লুকিয়ে লুকিয়ে দৃশ্যগুলো দেখার কারণে মনে এক বিশাল দুশ্চিন্তা কাজ করছিল। যদি ধরা খেয়ে যাই? যদি আমাকে চোর মনে করে, আমাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেন? যদি আমার এই আচরণে অ্যাডভোকেট সাহেব আমার উপর অসন্তুষ্ট হন? আরো অনেক দুশ্চিন্তা তখন মাথার ভেতর ঘুরঘুর করছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে হৃৎপিন্ডের গতি তো বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়ে ফেলার মতো অবস্থা হয়ে যায়। সেই অত্যন্ত জটিল একটি পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছিল আমার হৃৎপিন্ডের শব্দ আমি জোরে জোরে শুনতে পাচ্ছিলাম। মানুষ এমতাবস্থায় নিজেরই হৃৎপিন্ডের শব্দ শুনে আরো বেশি ঘাবড়ে যায়। তখন তার সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান করণীয় হয়ে পড়ে সেখান থেকে পালানো। ভাগ্যবশত, টেলিভিশনের শব্দের কারণে আমার হৃৎপিন্ডের কোনো শব্দ ভেতরে শোনা যাচ্ছিল না। একদিক দিয়ে চিন্তা করছিলাম রুমে ফিরে যাওয়ার, আরেকদিকে মনের সেই দৃঢ় আগ্রহ বলছিল; সেখানে বসে থেকে আরো দেখতে। কিন্তু আমি এত সহজে নিজের মনের ফাঁদে ফাঁসার লোক না। আস্তে করে সেখান থেকে উঠলাম এবং খুবই সাবধানে নিজের রুমের দিকে ফিরে গেলাম। রুমে ফেরার পর বড় একটা দম ছাড়লাম। তৎকালীন অনুভূতিটা অতি ভয়ঙ্কর হলেও, রুমে ফেরার পর বেশ তৃপ্তি পেয়েছিলাম। আসলে, তৃপ্তি না বলে এটাকে এক বিশেষ ধরনের আনন্দও বলা যেতে পারে। একটি বিপদ থেকে বেঁচে থাকতে পারাটা যেমন সৌভাগ্য, বিপদে পড়ে আবার ঠিকঠাক অবস্থায় ফিরে আসাও একটি অন্যতম প্রাপ্তি।
পরের সকালে ঘটল বেশ সাংঘাতিক এক ঘটনা। সকালে প্রায় নয় ঘটিকায় কলিং বেল বেজে উঠল। সাধারণত এত সকালে তো কেউ আসে না। আমি দরজা খুলে দেখতে পাই কমলা রঙের শাড়ি পড়া একজন সুন্দরী মহিলা। উনার গলায় ঝোলানো ছিল একটি পরিচয়পত্র, ডান কাঁধে ঝোলানো ছিল একটি কালো রঙের হ্যান্ডব্যাগ এবং হাতে ছিল একটি বেশ উন্নতমানের ক্যামেরা। দেখে বুঝতে পারলাম উনি একজন সাংবাদিক। জীবনে অনেক তো সংবাদ এবং সাংবাদিক দেখলাম, তবে উনার সঙ্গে তাদের তুলনা হয় না। উনাকে জিজ্ঞাস করলাম, "জি, কে আপনি?" যাহার উত্তর না দিয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, "তুমিই নতুন কাজের লোক নাকি?" উত্তরে আমি বললাম, "জি! আপনি কি উকিল সাহেবের পরিচিত কেউ?" উনি সামান্য একটু বিরক্তির স্বরে জিজ্ঞাস করলেন, "আমি ওর কি হই না হই, এসব জেনে তুমি কি করবা?" উনার মেজাজ দেখে আমি সামান্য ঘাবড়ে গেলাম। এমন ঘাবড়ানো অবস্থায় বলে উঠলাম, "জি, আমি শুধু উকিল সাহেবের নির্দেশনা অনুযায়ী আপনাকে প্রশ্নটা করেছিলাম। আমাকে ভুল মনে করবেন না।" উনি কিছুটা মেজাজ ঠান্ডা করে বললেন, "ঠিক আছে! নতুন কাজের লোক তো, তাই ভুল মনে করে মাফ করে দিলাম। আগের থেকে যাতে এমন না দেখি, ঠিক আছে?"
"জি, অবশ্যই!"
"হুম! সাব্বির আছে বাসায়?"
"জি! উনি উনার রুমের ভেতর বসে সংবাদপত্র পড়ছেন। আপনি ওয়েটিং রুমে বসুম, আমি উনাকে দেকে নিয়ে আসি।"
"না, থাক্! আমি যাই ওর কাছে।"
আমি উনার সামনে গিয়ে থামানোর চেষ্টা করতে লাগলাম আর বললাম, "ম্যাডাম! ম্যাডাম! ম্যাডাম! উনার রুমে বিনা অনুমতি কারো প্রবেশ করার অনুমতি নেই।"
কিছুটা রেগে বললেন, "আবার বেয়াদবি! কি বলেছিলাম একটু আগে?"
"আমার সব মনে আছে, ম্যাডাম। কিন্তু একটু বোঝার চেষ্টা করুন। এটার কারণে আমার চাকরি চলে যেতে পারে।"
"চাকরি চলে গেলে আমার বাসায় নিয়োগ দিয়ে দিব। এখন সড় আমার সামনে থেকে।"
"ম্যাডাম, একটু তো বোঝার চেষ্টা করুন। প্লিজ!"
আমি উনাকে অনুরোধ করেই যাচ্ছিলাম, এমতাবস্থায় অ্যাডভোকেট সাহেব এসে আমার পেছন থেকে বললেন, "আরে বাবা, তাকে আসতে দাও। সে আমার খুব পরিচিত একজন।" এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি উনার কাছে ক্ষমা চেয়ে, উনার রাস্তা ছেড়ে দিলাম। উনি আমার দিকে বেশ ক্রোধের দৃষ্টিতে তাকিয়ে অ্যাডভোকেট সাহেবকে জিজ্ঞাস করলেন, "সাব্বির! তুমি এই ছেলেটাকে আমার প্রসঙ্গে এর আগে কিছু বলোনি?"
উত্তরে অ্যাডভোকেট সাহেব সামান্য হেসে বললেন, "না! বলার সময়ই পাইনি। এত ব্যস্ততার মাঝে শুধু হাতেগোনা কয়েকজনের সাথেই পরিচয় করানো হলো।"
"অন্তত আমার কথাটা তো একবার উল্লেখ করে দিতা! জানো, এতক্ষণ ধরে কি আজগুবি আজগুবি প্রশ্নর সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমার?"
"হা হা হা! সাংবাদিকতার মাধ্যমে কয়জনের কাছে কতগুলো আজগুবি প্রশ্ন করেছিলা, সেটা মনে আছে তো? এই সামান্য কিছু প্রশ্ন সেগুলোর সামনে কিছুই না।"
"আমি কিন্তু মোটেও হাসিঠাট্টা করার মুডে নেই।"
"আরে সরি বাবা! ভুল হয়ে গিয়েছে।"
আমি মাঝখান দিয়ে বলে উঠলাম, "উকিল সাহেবের কোনো দোষ নেই। উনি সারাদিন কাজের ব্যস্ততার মাঝে মোটেও সময় খুঁজে পান না।" আমার উত্তরটি শুনে ম্যাডামের চেহারায় কেমন অবাক একটা ভাব এসে পড়ল। মুখে হাত দিয়ে, সামান্য একটি কাঁসি এবং তার সঙ্গে একটি হাসি দিয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "ঠিকই বলেছ।" আবার অ্যাডভোকেট সাহেবের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিম্ন স্বরে বললেন, "তার জীবনে কাজ ছাড়া আর আছেই টা কি!" এটা বলে এক মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে, নিচের দিকে চেয়ে, আবার আমার দিকে চেয়ে, আমার ডান কাঁধে নিজের বাম হাত রেখে বললেন, "সরি! দোষটা আমারই ছিল। মনে কিছু নিও না, ঠিক আছে বাবা?" বলে একটা মায়াবী হাসি দিলেন। এরপর তারা উভয়ই অ্যাডভোকেট সাহেবের রুমের দিকে এগোলেন। আমি নিজের স্থান থেকে মোটেও নাড়াচাড়া করিনি। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, "দুই কাপ গ্রিন টি নিয়ে আসো। একটার মধ্যে চিনি বেশি এবং অপরটা চিনি ছাড়া। আর দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যেও।"
আমি উনার কথা অনুযায়ী দরজা ভিড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলাম গ্রিন টি তৈরি করতে। গ্রিন টি বানানোর সময় সর্বদা আমার মাথায় একটি প্রশ্ন ঘুরপাক করতো; "এটা আগের থেকেই এত তিক্ত, স্বাদে আমি বিরক্ত; তবুও দেখি ইহা পান করেই যাচ্ছে অহরহ ব্যক্তিত্ব।" এটা ছিল আমার অবসর সময়ে কবিতা চর্চার ছোট্ট একটি নমুনা। অতঃপর গ্রিন টিও তৈরি হয়ে গেল। ট্রেতে করে তাদের উভয়ের জন্য গ্রিন টি পরিবেশন করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু রুমের কাছে যাওয়ার সময় শব্দ পেলাম তাদের ঝগড়ার। এত আপন মানুষ হয়েও, এত তীব্র স্বরে ঝগড়া! বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে তাদের নিয়ে। আমি প্রথমে রুমে প্রবেশ করার সাহস পাচ্ছিলাম না, তাই চা এর ট্রে হাতে নিয়েই, ভেড়ানো দরজাটার ঠিক বাহিরেই, কিছুক্ষণ দাড়িয়ে ছিলাম। আমাকে দরজার ফাঁক দিয়ে খেয়াল করতে পেরে, ম্যাডাম ভিতরে ডেকে জিজ্ঞাস করলেন, "কি হলো? এভাবে বাহিরে দাড়িয়ে ছিলা কেন?"
আমি ঘাবড়ে গিয়ে এক মোটা ঢোঁক গিললাম। সাহস করে উনার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম, "জি, আসলে হয়েছিলটা কি; আমি আসার সময় কিছু চিল্লাচিল্লির শব্দ শুনে থমকে গিয়েছিলাম। মনে করেছিলাম, এমন সময়ে হঠাৎ প্রবেশ করা উচিত না।"
কিছুটা চিন্তিত স্বরে, সন্দেহের নজরে আমার তরফ তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলেন, "কতক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছো এখানে এবং আমাদের কথাবার্তার কতটুকু শুনেছ?"
আমি উনার প্রশ্ন শুনে চমকে উঠে উত্তরে বললাম, "জি, আমি তো মাত্র আসলাম এবং কথাগুলো তেমন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না। তাই চিল্লানোর শব্দ শুনতে পেলেও, কিছুই বুঝতে পারিনি।"
"সত্যি তো?"
"জি, আপনার বিশ্বাস না হয়ে থাকলে, আপনি স্বয়ং দরজার বাহিরে দাড়িয়ে দেখতে পারেন।"
"আচ্ছা! এ কথা? ঠিক আছে! তাহলে দেখে আসি তো আমিও।" এটা বলেই উনি দরজার দিকে এগোতে লাগলেন। তখনই অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের বাম হাত দিয়ে উনার হাত ধরে উনাকে থামিয়ে বললেন, "এই! এসব কি শুরু করেছ? বসো তো। মাথা ধরে গেল তোমার এসব কান্ড দেখে। উফ্!" এটা বলেই নিজের ডান হাতটা নিজের কপালে রাখলেন।
অ্যাডভোকেট সাহেবের স্পর্শ পাওয়াতে; ম্যাডামের চোখে কেমন আজব এক ঝলমলে ভাব দেখা যাচ্ছিল। আমি দেখে বেশ অবাক হলাম। উনার চেহারায় তো নেতিবাচক কোনো মনোভাবের লক্ষণই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অ্যাডভোকেট সাহেব যেমন শুধু হাতই থামাননি, তারই সঙ্গে থামিয়েছিলেন উনার অত্যাধিক মাত্রার ক্রোধ। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি; একটি বড়সড় আগুন নিমেষেই নিভে গেল শুধু একটি সামান্য ফুঁয়ের মাধ্যমে। আমি তো সেখানেই দাড়িয়ে এই বিস্ময়কর দৃশ্য দেখছিলাম। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে বললেন, "এই রাফি, তুমি এখন যেতে পারো।" উনার আদেশ অনুযায়ী আমি রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমের দিকে ফিরলাম। তবে এই কৌতহলী মনকে সামলাতে পারছিলাম না মোটেও। মন তো চাচ্ছিলো; এক্ষুনি গিয়ে তাদের সকল কথাবার্তা কান পেতে শুনি। এমন একটা সময়ে মনকে বোঝানো বেশ কঠিন একটা কাজ। এমন কি অতি গুপ্ত আলাপ আলোচনা চলছিল তাদের মধ্যে, যে আমার এতই কঠিনভাবে প্রশ্ন করা হলো? এগুলো তো জানার পুরোপুরি অধিকার রয়েছে আমার। কেননা, আমি শুধু একজন কাজের লোক নই, আমি অ্যাডভোকেট সাহেবের জীবনের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশও। আমার কাছে কিছু লুকোনো উনার মোটেও উচিত না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম; যেভাবেই হোক, উনাদের কথা শুনেই ছাড়ব।
অ্যাডভোকেট সাহেবের রুম ছিল ঠিক রান্নাঘরের সাথে লাগানো। আমি খুব আস্তে আস্তে হেঁটে গেলাম রান্নাঘরের ভিতরে। সেখানে একটি কাচের গ্লাস নিয়ে তার প্রান্তের পাশটা রাখলাম সেই দেয়ালে যেটা সেই রুমের সঙ্গে জড়িত। ছোটবেলায় একটা সিনেমার মধ্যে এমন করে গোপন আলাপ শুনতে দেখেছিলাম। এখনও এই পদ্ধতি মনে রাখাটা এভাবে কাজে আসবে, কখনও চিন্তাও করতে পারিনি। নিজেকে কেমন গুপ্তচরের মতো লাগছিল। আমি গ্লাসের নিচের অংশটিতে নিজের বাম কান রেখে অপর কান আমার ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে বন্ধ করে রাখলাম। যেসব কথা হচ্ছিল তাদের মধ্যে, তা শুনে তো আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি শুনতে পারছিলাম; ম্যাডাম বলছিলেন, "চা বেশ ভালই হয়েছে। ছেলেটার মধ্যে চা সম্পর্কে ভালই জ্ঞান আছে।"
অ্যাডভোকেট সাহেব বলছিলেন, "তা তো আছেই! ট্রেইনার কে, বুঝতে হবে না? হা হা হা!"
"বাহ্! আজকাল এই কাজও নিজের ব্যস্ততার বাহানাগুলোর মধ্যে তালিকাভুক্ত করে ফেলেছ? সুন্দর তো!"
"করতেই পারি। অবসর সময় থেকে তো আমার এলার্জি আছে, এটা তো তুমি ভাল করেই জানো।"
"জানি দেখেই তো বেশি প্রশংসা করিনি।"
"প্রশংসা থেকে মনে পড়ল; গতরাতে তোমার উপহার ট্রায়াল দিয়ে দেখেছিলাম।"
"তাই? দুইটা বছর পর!"
"হ্যাঁ! সরি!"
"যাক্! কেমন লাগল?"
"ভালই! বেশ উন্নতমানের। আর এডজাস্ট করার ফিচারটি আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।"
"তোমার পায়ের উঁচু-নিচু গঠনের জন্যই এটা নিয়েছিলাম।"
"কত্ত খেয়াল রাখো আমার! কিন্তু আমি এটা ব্যবহার করবো না।"
"কেন? কি সমস্যা এটায়?"
"এটায় কোন সমস্যা নেই। সমস্যাটা মূলত আমার।"
"কি সমস্যা তোমার?"
"দেখো, ব্যাপারটা একটু জটিল হলেও, সহজ ভাষায় বলতে গেলে; এটা আমার জন্য লজ্জাজনক একটি বস্তু।"
"সেটা কিভাবে?"
"দেখো, আমি বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে থাকি। আমাকে ডাকার মূল কারণটাই হচ্ছে গিয়ে; আমি হাঁটতে অক্ষম, কিন্তু কথায় আমার দম। অচল হলেও, অসীম মর্যাদার অধিকারী। আমি এই হুইলচেয়ারের সাহায্য ছাড়া নিজের রুমেও প্রবেশ করতে পারি না, কিন্তু আমার সাহায্য নিয়ে অনেকে কারাগার থেকে বের হবার সুযোগ পেয়ে থাকে। এগুলো হলো এখনকার বিশেষ একটি চলমান ট্রেন্ড। আমাকে দেখে অসংখ্য মানুষ অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকে। আমার দেহের নিচ থেকে এই হুইলচেয়ার সরিয়ে ফেললে, আমার পরিচয়ের একটি ক্ষুদ্র এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই আমি নিজের সামান্য মানসিক তৃপ্তির উদ্দেশ্যে, অসংখ্য অসংখ্য মানুষের কাছে নিজের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে রাজি নই।"
"অসংখ্য অসংখ্য অজানা লোকের কথা চিন্তা করে শুধু নিজের নয়, আমার ইচ্ছাকেও মাটি দিচ্ছ।"
"তোমার ইচ্ছাকে শ্রদ্ধা করি বলেই এটা ট্রায়াল দিয়ে দেখেছিলাম। এবার তোমাকে অনুরোধ করছি আমার ইচ্ছাকেও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য।"
"বাহ্! অনেক সুন্দর একটু উত্তর তো! এত সুন্দর উত্তর কোথা থেকে শিখলে? আমিও শিখতে চাই।"
"হা হা হা! শিষ্যকে স্য়ং গুরুই প্রশ্ন করছে! মজা পেলাম।"
"মজা তো পাবেই! তোমার কাছ থেকে আর কি আশা করা যায়?"
"আশা করার কোনো সীমাবদ্ধতা আছে নাকি? আমিও তো তোমাকে নিয়ে কত আশা প্রত্যাশা করেছিলাম, তার সবই কি পূরণ হয়েছে? সেগুলোর কোনোটাই তো পূরণ হয়নি।"
"পূরণ হবে কি করে? তোমার অহংকার তো আর কমার নাম নেয় না।"
"আমার অহংকার!"
"জি!"
"তোমার বাবার দুর্ব্যবহার ভুলে গিয়েছ বোধহয়। একটু স্মরণ করিয়ে দিই?"
"কোন দুর্ব্যবহারের কথা বলছো তুমি?"
"আমাকে প্রথম দেখাতেই তোমার দিকে ঘুরে অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকানো, নাক সিটকানো, কথায় কথায় ঘরের চারপাশে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকানো। এগুলো কি শিষ্টাচার? আমাকে তো উনি মানুষ হিসেবে গণ্য করতেই রাজি না। এমন লোকের সঙ্গে কীভাবে ভাল আচরণ করা যায়?"
"উনি দেশের সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রাপ্ত একজন রিটায়ার্ড কর্নেল হয়েও, একমাত্র আমার অনুরোধে তোমার বাসায় প্রস্তাব নিয়ে আসলেন। তাও উনার ছোটখাটো কথাগুলো এভাবে ধরলে?"
"উনার চেয়ে বেশি মর্যাদা তো এখন আমারই। কিন্তু আমি তো এসব বৈষম্য থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছি। আমি তো মানুষের বাসায় গেলে এমন উদ্ভট আচরণ করি না।"
"তোমার এই মন-মানসিকতার জন্যই আজ আমাকে একজন এমন লোকের সঙ্গে সংসার করতে হচ্ছে, যে থাকেও দেশের বাহিরে, আর ফিরলেও সারাদিন-সারারাত বাহিরে কাঁটায়।"
"রাতটা কোথায় কাঁটায়? জুয়ার আড্ডায়? মদের আড্ডায়? নাকি পতিতালয়ে?"
"সে যেখানে খুশি সময় কাঁটাক! এতে আমার কিছু যায়-আসে না।"
"স্বামী তোমার, আর তোমারই কিছু যায়-আসে না? অদ্ভুত তো!"
"কিছু তো আর করার নেই। একা একাই রাত্রি যাপন করতে হয়।"
"সেই রাত্রিগুলো আমার সাথেই কাটাতে পারো। আমি তো তোমার জন্যই আছি।"
"তোমার মাথায় কি সারাটা দিন এসব ঘুরে?"
"মানে কি? তুমি তোমার সমস্যা আমার কাছে বললা আর আমি তার সমাধান বললাম। আমার এইসব পরামর্শের জন্য তো আমি অন্যদের কাছে টাকা চার্জ করি। ফ্রিতে পাচ্ছ বলে দাম দিচ্ছ না!"
"দাম কি শুধু তোমার পরামর্শের রয়েছে? আমার দেহের, আমার ভাবনার কোনো দাম নেই?"
"দাম আছে বলেই তো মূল্যায়ন করতে চাই।"
"এভাবে তুচ্ছ করে, যৌন হয়রানিমূলক কথাবার্তা বলে, মনের ভাব নিয়ে হাসিঠাট্টা করে মূল্যায়ন করতে চাচ্ছিলে?"
"বহুবছর আগেই এগুলো বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখন তোমার মাথায় সংসার করার ভূত চড়ে ছিল। তখন তো আদর্শ স্ত্রী হবার কথা বলেছিলে। সেগুলি আজ মনে করাচ্ছি তোমাকে বোঝানোর জন্য, তখন আমার মনটা কেমন করছিল।"
"তখন আমার আর কি করার ছিল, বলো? আমার পরিবার তো মোটেই রাজি ছিল না।"
"তোমার গর্ভে আমার সন্তান থাকলে তারা সবাই রাজি হতে বাধ্য হতো।"
"এসব নোংরা কথা ছাড়া অন্য কিছু বলার থাকলে বলো।"
"এতে নোংরামি কীসের? তুমি কি জন্মগ্রহণ করোনি? তোমার দুনিয়াতে আসায় কি তোমার মা নোংরা হয়ে গিয়েছিল?"
"আমার মা এসব বিয়ের পর করেছিল।"
"এটার আদৌ কোনো প্রমাণ রয়েছে তোমার কাছে? কোনো প্রমাণ আছে তোমার মায়ের কুমারীত্বের? কোনো দলিলপত্র, কোনো প্রমাণপত্র, কোনো ডাক্তারের মেডিক্যাল রিপোর্ট?"
"সেই একই যুক্তি তোমার মায়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।"
"আমি তো এমন কোনো দাবি করিনি।"
"এমন দাবি তো আমিও করিনি।"
"কুমারীত্বর দাবি কি আমার ছিল?"
"আমার মানে ছিল; বিয়ের পূর্বে এসবকে নোংরামিই বলা হয়।"
"সেক্ষেত্রে আমিও তো বলতে পারি; আমরা একটা কাজী অফিসে গিয়ে, পালিয়ে বিয়ে করে, এসব করতে পারতাম।"
"সেসময় তো পালিয়ে বিয়ে করার কোনো আগ্রহ পোষণ করোনি! হঠাৎ কেন?"
"সেসময়ও আমার মাথায় এটা ছিল, কিন্তু তুমি যখন ফোনে কেঁদে কেঁদে বলছিলে যে কোনোভাবেই কিছু সম্ভব না, কিছুই করার নেই, সবই শেষ হয়ে গিয়েছে, তোমাকে ভুলে যেতে; আর কি কি হাবিজাবি, তখন আমার মাথাও গরম হয়ে গিয়েছিল। তখন তো তোমার মুখ দেখবার জন্য প্রতিই রুচি চলে গিয়েছিল, ভালবাসা তো অনেক দূরের কথা। আমি মনে করেছিলাম অনেক বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছ, তাই আর জোরপূর্বক কিছু করাতে চাইনি।"
"বাদ দাও। এখন এসব কথার কোনো লাভ নেই।"
"লাভ আছে কি না, সেটা যদি বোঝার মতো জ্ঞান যদি তোমার থাকতো, তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না আমাদের। এভাবে রিপোর্ট নেওয়ার বাহানা করে ঘর থেকে বের হওয়া, আমার সঙ্গে এসে এই সামান্য কিছু সময় কাটানো, প্রতিটা রাত এই কষ্টে শুয়ে থাকা।"
"তাহলে তুমিই বলো এটার কি সমাধান রয়েছে? সেও আমাকে তালাক দিচ্ছে না, আর আমিও তার সম্মতি ছাড়া তালাক নিতে পারব না। সে বিদেশে কার কার সাথে কি কি করে বেড়ায় আর এখানে এসে দিনরাত কোথায় থাকে, সেসব নিয়ে আমার হাতে কোনো মজবুত প্রমাণও নেই। তাহলে কীভাবে কি করবো উকিল সাহেব? বলুন! একজন মক্কেল হিসেবে প্রশ্ন করছি আপনাকে। বলুন!"
"যদি মক্কেল হিসেবে প্রশ্নটা করে থাকেন, সেটার মূল্য অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। তা কি পারবেন?"
"আপনার সেবার মূল্যটুকু বলুন। সাধ্যে থাকলে অবশ্যই পারব।"
"সেক্ষেত্রে কাছে আসতে লাগবে।"
"জি, এতটা কাছে ঠিক আছে?"
"আরেকটু কাছে।"
"জি, এবার ঠিক আছে?"
"হ্যাঁ! এবার আমার কৃষ্ণবর্ণ গালে আপনার গোলাপি ঠোঁটের দ্বারা একটা ছাপ বসিয়ে দিন।"
"একটু বেশিই চড়া দাম চেয়ে বসলেন না?"
"এই দাম ছাড়া আমার সেবা প্রদান করা সম্ভব না।"
"তাহলে থাক, বাবা! অন্যথায় গিয়ে দেখতে হবে তাহলে।"
"আরে মিস, কোথায় যাচ্ছেন? আপনার পরামর্শ তো নিয়ে যান!"
"কমে দিলে দেন, নাহলে যাই।"
"ঠিক আছে, বাবা! ঠিক আছে! ইশশ! এত্ত ড্রামা!"
"এবার আসল কথায় আসি। কিছু করা যাবে এক্ষেত্রে?"
"তাকে খুন করা যেতো, কিন্তু তার ঠিক পরপর তোমাকে বিয়ে করলে আমরা সন্দেহের শিকার হতাম। আবার তাকে কোনো কেসে ফাঁসিয়ে, জোর করে তালাক দেওয়ানো যেতো, তবে সে মুখ খুললেই আমরা ধরা। নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলা দিতে পারো, কিন্তু সেটা প্রমাণের জন্য তোমার দেহে আঘাতের দাগ লাগবে, সেগুলো আবার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখবে, নির্যাতনের কারণও তেমন একটা দিতে পারবে না, তারপর তদন্ত করলে তো শেষমেশ আমার উপরেই সন্দেহ আসবে।"
"তাহলে কি কোনো উপায় নেই?"
"একটা উপায় রয়েছে!"
"কি?"
"সে যদি অন্য কারো সঙ্গে ব্যভিচার করতে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়, তাহলে।"
"সেটা কে করবে?"
"আমার পরিচিত একজন এই কাজটা করতে পারে।"
"তাহলে, তাড়াতাড়ি এটার ব্যবস্থা নাও।"
"কিন্তু তার আগে আমার কিছু শর্ত রয়েছে।"
"কেমন শর্ত?"
"তুমি যে আমাকে ধোঁকা দিয়ে যাবে না, সেটার প্রমাণ চাই।"
"তা কীভাবে প্রমাণ করব? একটা কাগজে লিখে, সেটায় স্বাক্ষর করে দিব?
"আরে, না! না! কি বলছ? তোমার মতো একজন অতি ভদ্র নারীর জন্য সবচেয়ে বড় প্রমাণপত্র হবে তোমার এই দেহ। একটা রাতের বিনিময় তোমায় চিরকালের জন্য মুক্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিব।"
"পাগল হয়ে গিয়েছ তুমি? আমার পক্ষে এসব সম্ভব না। যদি আমাকে প্রকৃতপক্ষে ভালবেসে থাক, তাহলে এমন বায়না আর ধরবে না।"
"কেনো গো? তোমার কষ্ট দূর করার জন্যই তো এই আয়োজন। তোমার তালাক হয়ে গেলে তো আমরা একত্রিত হয়ে পড়বই। তাহলে দ্বিধা কীসের?"
"একজন পুরুষ এবং মহিলার মাঝে মিলন ছাড়াও একটা বন্ধন থাকে, তার নামই ভালবাসা।"
"বাহ্! চমৎকার তো! কোন সিনেমার ডায়লগ এটা?"
"যা সত্য, তা ই বলছি।"
"তাহলে কি তুমি বলতে চাও; শারীরিক মিলন মিলন ভালবাসার কার্যকলাপের বহির্ভূত? এটি কি সম্পূর্ণরূপে একটি পৃথক সত্তা?"
"অবশ্যই! কেন, ভালবাসা কি শারীরিক মিলন ছাড়া সম্ভব না?"
"সম্ভব, কিন্তু পুরোপুরি না।"
"কেন? এর এমন কি দরকার?"
"সেটা বুঝতে হলে তোমার একটি উদাহরণের প্রয়োজন। দাঁড়াও! একটি উদাহরণের ব্যবস্থা করছি। এই রাফি! এই রাফি!"
অ্যাডভোকেট সাহেবের ডাক শুনার সঙ্গে সঙ্গে গ্লাস জায়গামতো রেখে দিয়ে, আস্তে আস্তে হেঁটে, নিজের রুমে গিয়ে, সেখান থেকে উনার রুমে গিয়ে হাজির হলাম। এভাবে করে গেলাম যাতে সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছানোর জন্য সন্দেহ করতে পারতেন। কিন্তু রুম থেকে হেঁটে আসার সময়ের কারণে এই সন্দেহ এড়াতে সক্ষম হলাম। রুমে প্রবেশ করার পরে এডভোকেট সাহেব আমাকে বললেন , "তিনটা ম্যাচ এর বাক্স এবং এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো। "
আমি কিছু না বলেই , চুপচাপ গিয়ে তিনটি ম্যাচ এর বাক্স আর এক গ্লাস পানি নিয়ে আসলাম। তা রেখে আবার পূর্বের মতো দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে, চলে যাবার ভান করলাম। কিন্তু এবার আমার কৌতহল ছিল দ্বিগুণ। কেননা এবার অ্যাডভোকেট সাহেব খুবই রসাত্মক এবং আকর্ষণীয় একটি বিষয়ে উদাহরণ দিতে যাচ্ছিলেন। এ দৃশ্য তো কোনোমতেই না দেখে থাকা যাবে না।
আমি আবার আস্তে করে দরজার বাহিরে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। উনাদের আলাপ শোনার পাশাপাশি কিছু গোপন দৃশ্য দেখার আশায় দরজার চাবির ছিদ্রের ফাঁকে, বাম চোখ রেখে সব দেখছিলাম।
দেখতে পাচ্ছিলাম;
অ্যাডভোকেট সাহেব ম্যাচের বাক্সগুলো টেবিলের উপর এমনভাবে সাজিয়ে রেখেছেন, যে তার মধ্যে মাঝের বাক্সটা উনার কাছের দিকে এবং অবশিষ্ট দুটো বাক্স ম্যাডামের কাছের দিকে। তাছাড়া পানির গ্লাসটি অ্যাডভোকেট সাহেবের হাতের ডান পাশে রাখা; ঠিক সেই অবস্থায়, যে অবস্থায় তা রেখেছিলাম। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের হাতের ডান পাশের ম্যাচের বাক্সটা হাতে নিয়ে তার ভিতরের কাঠিগুলো বেড় করে, সবগুলো কাঠি মুঠোয় নিয়ে, কাঠির মুখের অংশটুকু গ্লাসে দুবোলেন, কিন্তু অবশিষ্ট অংশটুকু শুকনো রেখেই গ্লাস থেকে উঠিয়ে ফেললেন। কাঠিগুলো বেড় করে, টেবিলে রেখে ম্যাডামের কাছে প্রশ্ন করলেন, "আচ্ছা বলতো, এই কাঠিগুলো এই বাক্সের পাশে ঘষলে কি আগুন জ্বলবে?"
তার উত্তরে ম্যাডাম বললেন, "এ কি ধরনের প্রশ্ন? ভিজা কাঠি দিয়ে কি আগুন জ্বলবে কখনও?"
"জ্বলবে না কেন?"
"কারণ ভিজা কাঠি তো আগুন জ্বালাতে অক্ষম।"
"এই তো! এবার এসেছ মূল কথায়। আচ্ছা এখন বলতো, এই বাক্সের পাশে যদি শুকনো কাঠি দিয়ে ঘষা দিই, তাহলে কি এটা জ্বলবে?"
"হ্যাঁ! অবশ্যই!"
"কেন?"
"কারণ সেটা আগুন জ্বালানোর জন্য উপযুক্ত।"
"ভেরি গুড! এ গেলো প্রথম উদাহরণ। এবার দ্বিতীয়টি।" বলেই অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের হাতের বাম পাশের ম্যাচের বাক্সটা হাতে নিয়ে, গ্লাসের মধ্যে নিজের ডান হাতের আঙ্গুল ভিজিয়ে, সেই ভিজা আঙ্গুলটা সেই বাক্সের দুপাশে ঘষে, ভিজিয়ে নিলেন। অতঃপর সেই বাক্স থেকেই একটা কাঠি বেড় করে, বাক্স এবং কাঠি উভয়ই দিলেন ম্যাডামের কাছে। ম্যাডামের কাছে তা দিয়ে বললেন, "এই বাক্সের পাশে ঘষা দিয়ে আগুন জ্বালানো যাবে?"
উত্তরে ম্যাডাম বললেন, "না! কারণ এবার বাক্সটাই অক্ষম।"
"সাব্বাশ! এবার তৃতীয় উদাহরণে যাওয়ার পূর্বে একটা ছোট্ট প্রশ্ন করবো।"
"হ্যাঁ, বলো।"
"দুটো ম্যাচের বাক্স এবং কাঠি একই ধরনের হবার সত্ত্বেও, এদের অক্ষম হবার কারণ ভিন্ন হলো কেন? অর্থাৎ, উভয় পক্ষের লক্ষ্য যদি একই হয়ে থাকে, তবে এদের ব্যর্থতার কারণ ভিন্ন কেন?"
"কারণ তাদের উভয়কেই সফল হতে একে অপরের সহায়তার প্রয়োজন এবং উভয়পক্ষকে অবশ্যই সমানভাবে সক্ষম হতে হবে। কেবল একটিমাত্র পক্ষও যদি অক্ষম হয়ে থাকে, তবে তার প্রভাব পড়বে উভয়ের কার্যকারিতার উপর।"
অ্যাডভোকেট সাহেব একটা ছোট্ট হাততালি দিয়ে বললেন, "বাহ্! এত সুন্দর করে তো আমিও বিশ্লেষণ করতে পারতাম না। অসাধারণ হয়েছে। চলো, এবার তৃতীয় উদাহরণের দিকে আসি।" বলেই উনি নিজের দেহের নিকটবর্তী ম্যাচের বাক্সটা হাতে নিয়ে, তার একটা কাঠি বেড় করে, সেই বাক্সের পাশে ঘষা দিয়ে, আগুন ধরিয়ে, তা ধরে রেখেছিলেন। কাঠিটা উনার হাতেই ছিল যখন পর্যন্তনা; সেই জ্বলন্ত কাঠিটি পুড়তে পুড়তে, নিজের দুই তৃতীয়াংশ সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে, নিজে নিজেই নিভে যায়। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব বললেন, "কিছু খেয়াল করেছ?"
কিছুটা চমকে উঠে ম্যাডাম জিজ্ঞাস করলেন, "কি?"
"এই আগুনটা হলো প্রেম, কাঠি এবং বাক্স হলো দেহ, পুড়ে যাওয়া অংশটুকু হলো প্রেমের গভীরতা এবং ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাওয়া অংশটুকু হলো দূরত্ব। দাম্পত্য জীবন নামক মাটিতে, প্রেম নামক বীজ রোপণ করার প্রক্রিয়া হলো এই শারীরিক মিলন। এবার বুঝতে পেরেছ ব্যাপারটা?"
"হুম! তবে আমার একটা জটিল প্রশ্ন রয়েছে। তার উত্তর দিতে পারলে মেনে যাবো।"
"হ্যাঁ, বলো! বলো!"
"বিয়ের রাত তো আমার স্বামীর সঙ্গে আমার সেই মিলন ঘটেছিল, তাহলে আমি কেন তাকে ভালবাসি না?"
"তুমি তো বলছিলা; প্রশ্নটা জটিল হবে। কিন্তু এ তো খুবই সহজ একটা প্রশ্ন।" এটা বলে অ্যাডভোকেট সাহেব এবার পুরোপুরি শুকনো এবং সক্ষম বাক্সটি থেকে একটা কাঠি বেড় করে, তার মুখের অংশটুকু নিজের ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে ধরে, উল্টো করে, কাঠির শরীরটা গ্লাসের ভিতরে দিয়ে, ভিজিয়ে নিলেন। তবে এবার কাঠির মুখখানা শুকনো রেখে দিলেন। সেই কাঠিটা নিজের বাম হাতে, সোজা করে ধরলেন। ম্যাচের বাক্সটা ডান হাতে নিয়ে, তার পাশে সেই কাঠির মুখ ঘষে, আগুন ধরালেন। আগুনটা গতবারের কাঠির মতো নিজের আগুন কাঠিটার দুই তৃতীয়াংশ জ্বালাতে পারল না। আগুন নেভার পরে অ্যাডভোকেট সাহেব সেই কাঠি দিলেন ম্যাডামের হাতে। কাঠিটা উনার হাতে দিয়ে বললেন, "এবার দেখো; কাঠিটা জ্বলেছে ঠিকই, কিন্তু নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। বলতো, সেটা কেন হলো? কেন বাকি অংশটুকু কেন পুড়েনি?"
"কারণ এবার পুরোপুরি অক্ষমতা না থাকলেও, আংশিক ত্রুটি ছিল।"
"আংশিক ত্রুটি কি করে? উভয়পক্ষই নিজ নিজ ভূমিকা পালন করল, ঘষা লাগার পর আগুনও ধরল, কোনো রকমের বাধাও ছিল না। আংশিক ত্রুটি আবার কোথায় পেলে?"
"কাঠির দেহটা আগুন দ্বারা পুরোপুরি পুড়তে পারেনি। কারণ কাঠির দেহ ছিল ভিজা, যা তার কার্যকারিতায় কোনো বাধা না সৃষ্টি করলেও, একটা ছোটখাটো সমস্যার সৃষ্টি করেছে। কাঠির অবশিষ্ট অংশটুকু আগুনের স্পর্শ হতে বঞ্চিত থাকল এই পানির কারণে। তাই কোনো প্রকার ত্রুটি না থাকা সত্ত্বেও তার একদিক দিয়ে দুর্বলতা বিদ্যমান ছিল।"
"অসাধারণ! চমৎকার উপস্থাপনা! এবার একটা জিনিস খেয়াল করো; তুমি সেই একটি রাতের বিনিময়ে অসংখ্য রাতের কর্মফল আশা করছো। তাহলে তুমিই এবার বলো; সেই একবারের পর আর কখনওই তার স্পর্শ না পাওয়া কি সেই আংশিক অক্ষমতা নয়?"
অ্যাডভোকেট সাহেবের উত্তরটা শোনার পর, ম্যাডামের চেহারায় আশ্চর্য ভাবটিকে দেখে, যে কেউই খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারবে যে উনার প্রশ্নের সন্তোষজনক একটি উত্তর দেয়া হয়েছে। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব আরো বললেন, "তবে এখানে তোমাদের উভয়ের মধ্যে কারও সম্মতি বা রুচি না থাকার ফলে, এখন জোর করে মিলন করলেও কাজ হবে না। কারণ যদি আদৌ তোমাদের মনে ভালবাসা উৎপাদিত হবার ছিল, তা এত বছরে নিজ থেকেই হয়ে যেত। না সে থাকতে পারত তোমার স্পর্শ না পেয়ে, আর না তুমি থাকতে পারতে তার স্পর্শ ছাড়া। এখন চেষ্টা করেও কিছু করা সম্ভব না। আলাদা হয়ে, নিজ নিজ সঙ্গী খুঁজে বেড় করো।"
কথাটি শুনে হঠাৎ চমকে উঠে ম্যাডাম বললেন, "খুঁজে বেড় করো মানে?"
"মানে, হতে পারে সেই সঙ্গী নই, বরং অন্য কেউও তো হতে পারে, তাই না?"
"এতক্ষণ এত কিছু বলার পর একথা বলছো? আগে বললেই তো পারতে। আমাদের দুজনের সময়ই বেঁচে যেত।" বলে অ্যাডভোকেট সাহেবের মূখের দিক থেকে দৃষ্টি চাপিয়ে, বাম দিকে মুখ করে নিলেন। এ দৃশ্য দেখে অ্যাডভোকেট সাহেবের চেহারায় হাসি ফুটে উঠল। দেখে মনে হচ্ছিল, উনি ম্যাডামের রাগ দেখে খুবই খুশি। যেমন কোনো বিশেষ প্রকারের সংকোচ দূর হয়ে এবার সন্তুষ্টি পেলেন। তবে সেই হাসিটার রহস্য কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পেলাম যখন অ্যাডভোকেট সাহেব বললেন, "খুবই ভাল লাগল তোমার এই প্রতিক্রিয়া দেখে।"
এ কথা শুনে, ম্যাডাম আশ্চর্য হয়ে, উনার দিকে ঘুরে, জিজ্ঞাস করলেন, "এ কি বোকছো? মাথা ঠিক আছে তো? চায়ের মধ্যে কিছু মেশানো ছিল না তো আবার?"
"না গো! আমি ঠিকই আছি।"
"তাহলে এসব কি বলছ হঠাৎ? কি প্রতিক্রিয়া দেখে ভাল লাগল?"
"তুমি যেভাবে ব্যাপারটা হজম করতে পারলে না, রাগ করে বলে; খুবই ভাল লাগল আমার কাছে।"
"কেন? এতে ভাল লাগার কি আছে?"
"তোমাকে অন্য কাউকে খুঁজতে বলাটা তোমার এক মুহূর্তের জন্যও সহ্য হয়নি। এটাই সেই ভালবাসা যার জন্য আমি এত বছর ধরে অপেক্ষায় রয়েছি। আমাদের মাঝে তো এই অনুভূতি শুরু থেকেই বিদ্যমান যা তোমার সঙ্গে মিলনের মাধ্যমেই নিজের সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছাতে পারবে।"
Comments
Post a Comment